ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ৯ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে অর্থছাড় পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে অনিয়ম ও ‍দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির প্রাতিষ্ঠানিক টিমের অনুসন্ধানে চিহ্নিত করা হয়েছে দুর্নীতির ১০ উৎস।

দুর্নীতির উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে- নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রাক্কলন, টেন্ডারের তথ্য ফাঁস, নেগোসিয়েশনের নামে অনৈতিক সুবিধায় এজেন্ট ঠিকাদার নিয়োগ, ডিজাইন পরিবর্তন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, টেন্ডার অনুসারে কাজ বুঝে না নেয়া, ভুয়া বিল-ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ, প্রভাবশালী ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের নামে ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর অনৈতিক সুবিধা ইত্যাদি।

বুধবার সচিবালয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কাছে মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন দুদকের কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান।

এ বিষয়ে দুদকের কমিশনার বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রাক্কলন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন।  কারণ, এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপকতা রয়েছে। এমনকি ইজিপি প্রক্রিয়াতেও ঠিকাদার-কর্মকর্তার যোগশাজশের ঘটনা ঘটছে। যেসব কর্মকর্তার নৈতিকতার বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে, তাদেরকে বড় বড় প্রকল্পে নিয়াগ না দেওয়াই সমীচীন।

এক প্রশ্নের জবাবে দুদকের কমিশনার বলেন, ছোট-বড় বুঝি না, দুর্নীতি করলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলো হলো-

যথাযথ প্রক্রিয়ায় টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করা : গণপূর্ত অধিদপ্তরের বৃহৎ পরিসরের কাজ ছাড়াও মেরামত, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কোটি কোটি টাকার কাজগুলো পছন্দের ঠিকাদারদের দেয়ার জন্য গোপন টেন্ডার হয়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তার আত্মীয়-স্বজন বা তাদের নামে-বেনামেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

অপছন্দের ঠিকাদারকে নন-রেসপনসিভ করা : অনেক ক্ষেত্রে ঠুনকো কারণে অপছন্দের ঠিকাদারকে নন-রেসপনসিভ করা হয় এবং কৌশলগত হিসাবের মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদারকে রেসপনসিভ করা হয়। যেমন: পছন্দের ঠিকাদারকে রেট জানিয়ে দেয়াসহ নানা কৌশলে অন্য কোনো ঠিকাদারকে অংশ না নেয়ার পরিবেশ তৈরি করা হয়। বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে সিডিউল রেটের বাইরে গিয়েও অস্বাভাবিক মূল্যে প্রাক্কলন তৈরি করা।

অনুমোদনের দায় এড়ানোর ভিন্ন কৌশল : ৩০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের দায় এড়ানোর জন্য ছোট ছোট প্যাকেজ করে অধিদপ্তর কর্তৃক প্রাক্কলন প্রণয়ন, অনুমোদন ও ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়।  যেমন: ‘রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ছয়টি ভবনে আসবাবপত্র সরবরাহসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ গণপূর্ত অধিদপ্তর অনুমোদন করে। এখানে মন্ত্রণালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।

টেন্ডারের শর্তানুসারে কাজ বাস্তবায়ন না করা : প্রভাবশালী ঠিকাদারের চাপে ও এক শ্রেণির প্রকৌশলীর যোগসাজশে গণপূ্র্তের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। কাজ পাওয়ার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি, পরামর্শক সংস্থা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়।

নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার : গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প বা নির্মাণকাজে নিম্নমানের ইট, রড, সিমেন্ট ও বালু ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সিমেন্ট, বালি কিংবা রড অনুপাত অনুসারে দেয়া হয় না।

প্রকল্প প্রণয়ন ও তদারকিতে ধীর গতি : সরকারের ভবন নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিধি বহুগুণ বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় কম তদারকি ও পরিবীক্ষণে ধীর গতির অভিযোগ রয়েছে।

প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ কম : গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত ভবনের মেরামত, সংস্কার ও সংরক্ষণে প্রয়োজনের এক তৃতীয়াংশ বরাদ্দ পাওয়া যায় না। যথাসময়ে বরাদ্দ ছাড়ের অভাবেও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে বিঘ্নিত হয়।

অনাবশ্যক প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি : আর্থিক মুনাফার প্রত্যাশায় প্রয়োজন না থাকা সত্বেও ঠিকাদার ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যয় বাড়ানো হয়।

নকশা চূড়ান্তকরণে বিলম্ব : পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে স্থাপত্য অধিদপ্তর প্রায়ই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নকশা সরবরাহ করতে পারে না।

প্রত্যাশী সংস্থার প্রয়োজনমতো কার্য সম্পাদন না করা : গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অবহেলা, সদিচ্ছা ও মনিটরিংয়ের অভাবে প্রাক্কলন তৈরি থেকে শুরু করে টেন্ডার আহ্বান, কার্যাদেশ প্রদান এবং কাজের সমাপ্তি প্রত্যাশী সংস্থার চাহিদামতো হয় না।

সেবা প্রদানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতা : বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর বা সরকারি কোয়ার্টারের মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণসহ সেবা প্রদানের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।

ঠিকাদারদের বিল সময়মতো পরিশোধ না করা: অনেক সময় কাজ শেষে ঠিকাদার বিল দাখিল করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নানা অজুহাত কিংবা আর্থিক সমঝোতা না হওয়ায় বিল সময়মতো পরিশোধ হয় না। বরাদ্দ থাকা সত্বেও অনেক ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের আংশিক বিল পরিশোধ করা হয়।

প্রতিবেদনে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি প্রতিরোধে ২০ দফা সুপারিশ করা হয়। দুদক মনে করে, সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে দুর্নীতি অনেক কমবে।



ঢাকা/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়