ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

আদালতের বারান্দাতেই যৌবন পার বিদেশিনীর

মেহেদী হাসান ডালিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০৪, ১১ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আদালতের বারান্দাতেই যৌবন পার বিদেশিনীর

ওকিয়াং। উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষিণ কোরিয়ার ধনী পরিবারের মেয়ে।  নিজের জমানো টাকা আর ভালোবাসার মানুষ নিয়ে ৩৪ বছর বয়সে আসেন বাংলাদেশে।  চোখে মুখে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে   গাজীপুরে গড়ে তোলেন প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি।  ভালোবাসার মানুষ বো সান পার্কের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

সবকিছু ভালোই চলছিল।  স্ত্রীর নগদ অর্থ হাতে পেয়ে স্বামী বো সান পার্ক এক সময় হুন্ডি ব্যবসা এবং অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়েন।  বাধ সাধেন স্ত্রী।  শুরু হয় দ্বন্দ্ব।  পাকেজিং ইন্ডাস্ট্রির সব শেয়ার নিজের নামে লিখে নেন স্বামী। তিল তিল গড়ে তোলা স্বপ্নের ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিতারিত হন ওকিয়াং। ভেঙে যায় ভালোবাসার সংসার।  উপায়ন্তর না পেয়ে অধিকার আদায়ে আদালতের দ্বারস্থ হন।  মামলার জালে জড়িয়ে পড়েন।  মামলা  চালাতে গিয়ে তিনি খুঁইয়েছেন কোটি টাকা।  আদালতের বারান্দাতে ঘুরতে ঘুরতে পার হয়ে গেছে সোনালী যৌবন।  এখন কখনও  জজকোর্ট, কখনও  হাইকোর্ট, আবার কখনও আপিল বিভাগে একাই আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ৫৭ বছরের এই নারী।  রাইজিংবিডির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন এই বিদেশিনী।

বাংলাদেশে আসার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে ওকিয়াং রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি অনেক শিক্ষিত ছিলাম।  এমবিএ পাশ করে কোরিয়াতে ভালো চাকরি করতাম। তবে আমার লাভার এতটা শিক্ষিত ছিল না। সে ট্যাক্সি চালাতো। আমি ৩৪ বছর বয়সে চাকরি থেকে অবসর নেই। পেনশনের টাকা ও জমানো টাকা নিয়ে ১৯৯৬ সালে আমরা দুজন বাংলাদেশে আসি। তাকে প্রতিষ্ঠিত করাই আমার উদ্দেশ্যে ছিল। স্বপ্ন ছিল নিজের একটা ইন্ড্রাস্টি হবে, ব্যবসা বাণিজ্য থাকবে।  বাংলাদেশে এসে গাজীপুরে যৌথভাবে প্যাকেজিং  ইন্ডাস্ট্রি করি।  তিনজন বাংলাদেশি ও চারজন কোরিয়ান নাগরিক মিলে।  আমি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলাম। এর মধ্যে আমি বো সান পার্ককে বিয়ে করি।  ভালোই চলছিল।’

ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরুর কথা বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে যান ওকিয়াং। তিনি বলেন, ‘এক সময় বো সান পার্ক হুন্ডি ব্যবসা শুরু করেন। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু। আমাকে খুব অত্যাচার করতো। মারধর করতো। এক পর্যায়ে কোম্পানিতে আমার শেয়ার প্রতারণা করে নিজের নামে লিখে নেয়।  এরপর তো আদালতের দ্বারস্থ হই। ’

স্বামীর বিরুদ্ধে প্রথমে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন ওকিয়াং।  তারপর প্রতারণার মামলা ও শেয়ার ট্রান্সফার নিয়ে মামলা করেন।  এভাবে প্রায় ২০টির বেশি মামলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি।  মামলায় আইনজীবীদের পেছনে ব্যয় করেন কোটি টাকা।

তার ভাষায়, ‘মামলায় কোটি টাকা ব্যয় করেছি।  মামলা চালাতে গিয়ে কোরিয়াতে আমার নামে থাকা দুটো বাড়িও বিক্রি করেছি।’

মামলা চালাতে গিয়েও তার নানান অভিজ্ঞতা হয়। ওকিয়াং বলেন, ‘অনেকে  নিজেদের স্বার্থে মামলা প্রবলিম্বত করে।  মামলার ক্ষতি করে থাকে।  এটা দুঃখজনক।   কোরিয়াতে একটি মামলায় আইনজীবীকে একবারই টাকা দিতে হয়।  কিন্তু এদেশে একজন আইনজীবী যতদিন মামলায় মুভ করেন ততদিনই টাকা দিতে হয়।  এটা সত্যিই কষ্টদায়ক।’

কয়েকজন আইনজীবীর সহযোগিতার কথা স্বরণ করতেও ভুলেননি ওকিয়াং।  ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ, অ্যাডভোকেট একরামুল হক টুটুল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার ও অ্যাডভোকেট মাসুম বিল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।  ড. বশির উল্লাহর প্রশংসা করে বলেন, ‘তার কাছে যতবার এসেছি আমাকে সহযোগিতা করেছেন।  আপ্যায়ন করেছেন।’

আদালত চত্বরে ওকিয়াং

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কোরিয়ার এ নাগরিক বলেন, ‘আগে খুব প্রবলেম ছিল।  ২০০৭ সাল থেকে প্রবলেম অনেকটাই কমে গেছে।  বিচারকরা ইংরেজি পারে, ইংরেজি  জানে।  তবে বিচার প্রক্রিয়া অনেক লম্বা।  কোরিয়াতে একটা মামলা নিস্পত্তি হতে এত দীর্ঘ সময় ব্যয় হয় না।’

মামলায় কখনও হেরেছেন, কখনও জিতেছেন।  কিন্তু উচ্চ আদালতের রায়ের প্রশংসা করতে কৃপণতা করেননি তিনি।  ওকিয়াং বলেন, ‘বাংলাদেশের আপিল বিভাগ দীর্ঘ জাজমেন্ট  দিয়ে থাকে।  যেখানে মামলা হারা বা জিতার কারণগুলোর বিস্তারিত বিবরণ থাকে। কিন্তু কোরিয়ার আদালত ছোট জাজমেন্ট দেয়। বাংলাদেশের জাজমেন্ট খুব ক্লিয়ার।  যদিও একটি মামলায় হেরেছি।  তবুও বলব আপিল বিভাগ থেকে আমি সব সময় ন্যায়বিচার পেয়েছি।’

২০০২–২০১৯ সাল।  পেরিয়ে গেছে ১৭ বছর।  আইনজীবীদের খরচ দিতে না পেরে এখন নিজেই আদালতে মুভ করেন।  এদেশে থেকেই আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে চান। তার বিশ্বাস আদালতের মাধ্যমেই একদিন অধিকার ফিরে পাবেন।

তার ভাষায়, ‘কোরিয়াতে ভাই, বোন, মা আছে।  তারা সবাই আলাদা আলাদা থাকেন।  দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।  এদেশেই থাকব।  আশা করি এক সময় মামলাগুলোতে জিতব।  ইন্ডাস্ট্রির শেয়ারগুলো ফিরে পাব।’

ওকিয়াং এর বিশ্বস্ত আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা করেছেন ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম।  তিনি ওকিয়াং এর সম্পর্কে বলেন, ‘আমি তাকে ২০০২ সাল থেকে চিনি। তার অনেকগুলো মামলায় আইনজীবী ছিলাম। কোম্পানির শেয়ার ট্রান্সফারসহ আরো অনেকগুলো মামলা এখনও বিচারাধীন আছে।  কয়েকটি মামলায় রায় তার পক্ষেও এসেছে।  সবগুলো কেসে প্রবল আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যেতে চান তিনি। ওকিয়াং মনে করেন তিনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।  তার মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে।  তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে।  উনি বিশ্বাস করেন একদিন না একদিন তিনি ফ্যাক্টরির মালিকানা পেয়ে যাবেন।  আমি তাকে অনেকবার বলেছি, তুমি তো ধনী পরিবারের মেয়ে।  তোমার এখানে থাকার মানে হয় না।  দেশে চলে যাও।  জবাবে সে আমাকে বলেছে, সারা জীবন তো এখানেই পার করলাম।  এখান থেকে যাব না।  শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।  দরকার হলে এদেশেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করব।’


ঢাকা/মেহেদী/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়