ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বেড়েছে কামারপট্টির কদর

মহিউদ্দিন অপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২২, ১০ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেড়েছে কামারপট্টির কদর

মহিউদ্দিন অপু : ‘কয়লার আগুনের পাশে ভারী হাতুড়ি দিয়ে উত্তপ্ত লোহা পেটানো খুবই কষ্টের। তাছাড়া কয়লার ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে ভোগাচ্ছে আমাদের। কোনোরকম খেয়ে-পড়ে আছি। শুধুমাত্র ঈদ ও পূজাপার্বণ এলেই কাজ ও কদর বাড়ে আমাদের।’ কথাগুলো বলছিলেন, উপকূলীয় বরগুনা জেলার কামারশিল্পী ধ্রুব কর্মকার। তিনি আরো বলেন, ‘আর্থিক সমস্যা ছাড়াও অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে বছর পার হলেও বাপদাদার এই হাতুড়ি পেটানো পেশা ছেড়ে যেতে পারিনি অন্য পেশায়। তবে লোহা ও কয়লার দাম কমলে কিছুটা ভালো থাকতাম, লাভবান হতাম। আর সরকারের সহযোগিতা পেলে আগের মতো বদলে যেতো আমাদের কর্মকারদের জীবন।’

কামার পেশা প্রাচীন। এ পেশার মানুষের কাজ হলো লোহা দিয়ে মানুষের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা। ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দু ধর্মের জনগোষ্ঠীরাই এই পেশায় বেশি জড়িত। তবে বর্তমানে অনেক মুসলমানকেও এ পেশায় দেখা যায়। দূর অতীতে কৃষিকাজ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বঙ্গভূমিতে কামার পেশার উৎপত্তি হয় এবং হিন্দু সমাজের শূদ্র সস্প্রদায়ের মধ্যে লোহার কারিগর তথা এই কর্মকার শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। ক্রমান্বয়ে এ পেশার মানুষ বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম, বাজার ও পাড়া-মহল্লায় গড়তে থাকেন তাদের বসতি ও কর্মসংস্থান। গড়ে ওঠে কামার পাড়া। তখন এই বঙ্গে অতি সাধারণ দৃশ্য ছিল- লোহা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামাদি বানানো, চারিদিকে লোহা পেটানোর টুং টাং শব্দ, বাতাসে লোহা পোড়া গন্ধ। সেই থেকেই শূদ্র সস্প্রদায় গ্রামাঞ্চলে কামার পেশার সঙ্গে জড়িত। তবে কামাররা এখন শুধু গ্রামেই বসবাস করেন না, তারা বিভিন্ন শহর-বন্দরেও ছড়িয়ে পড়ছেন তাদের পেশাসহ। অনেক কামার আবার তাদের পছন্দ অনুযায়ী গ্রাম এবং শহর উভয় অঞ্চলেই গ্রহণ করেছেন ভিন্ন পেশা।

প্রচলিত লোককাহিনি থেকে কামার পেশা সম্পর্কে জানা যায়, কোনো এক শূদ্র মহিলার সঙ্গে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার প্রণয়ে জন্ম হয় কর্মকার বা কামারের। বসুন্দরী, রানা, গঙ্গালিরি এবং বাহাল অথবা খোটা এই চার শ্রেণিতে কামারদের ভাগ করা হয়েছে এবং এরা একই শ্রেণিভুক্ত না হলে বৈবাহিক সস্পর্ক স্থাপনে বাধা রয়েছে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন উপজাতি ও জাতিগুলোর উপর বিস্তারিত গবেষণা চালানো ব্রিটিশ জনপরিসংখ্যানবিদ ও ঔপনিবেশিক প্রশাসক স্যার হারবার্ট হোপ রিসলের গবেষণা মতে আরো জানা যায়, বুষ্ণপতি, ঢাকাই এবং পশ্চিমা হচ্ছে পূর্ব বাংলায় কামারদের তিনটি সামাজিক শ্রেণী। নালদিপতি, চৌদ্দসমাজ ও পঞ্চসমাজ এই তিনটি শ্রেণীতে আবার ভাগ করা হয়েছে বুষ্ণপতিকে এবং এরা একই শ্রেণিভুক্ত না হলেও নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বৈবাহিক সস্পর্ক স্থাপন করতে পারে। বাংলাদেশের অধিকাংশ কামার বৈষ্ণব। তবে কিছু শাক্ত ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর কামারও রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এসব জনগোষ্ঠীর কামারদের প্রিয় দেবতা হলেন বিশ্বকর্মা। যাকে ভাদ্র মাসের শেষদিন মিষ্টান্ন, চিড়া, গুড়, ফুলফল, চন্দনের রস বা বাটা, গঙ্গাজল, কাপড় ও রৌপ্যালঙ্কার দিয়ে পূজা করা হয়। মহিলারা অনন্তা, সাবিত্রী, ষষ্ঠী, পঞ্চমী ইত্যাদি ব্রত পালন করেন এবং নিস্তারিণী ও মঙ্গলচণ্ডীর কাহিনি পরিবেশন করেন। এসময় মহিলা ও শিশুরা মিষ্টান্ন, দুধ, ফলমূল ইত্যাদি দিয়ে বিশ্বকর্মার পূজা করেন। গোঁড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শূদ্র সস্প্রদায়ের কামাররা মোটামুটি ভালো অবস্থাতেই রয়েছেন। অন্য সম্প্রদায়ের কামারদের মতো তারা সমাজে খুব একটা অবহেলিত নন। তারা তাদের কার্যক্রম, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য নিয়ে পৃথকভাবে বসবাস করছেন। তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী নিয়ে বিভিন্ন মেলায়ও অংশগ্রহণ করে থাকেন।

কামারশিল্পীদের কর্মস্থলকে সাধারণত বলা হয় কামারশালা। কামারশালা ক্ষুদ্রশিল্পের আওতায় পড়ে। কামারশালায় কামাররা হাপর দিয়ে কয়লার আগুন উস্কে রাখে। সেই আগুনে লোহা গরম করে পিটিয়ে বিভিন্ন আকারের যন্ত্রপাতি ও লৌহজাত জিনিস তৈরি হয়। যদিও আগের মতো এখন আর নেই আগেকার সেই কামার শিল্পের কাজ। ক্রমাগতভাবে লোহা ও কয়লার দাম বাড়ায় অনেকে এ পেশাই ছেড়ে চলে গেছেন অন্য পেশায়। আসন্ন পবিত্র কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কামারশালার ন্যায় উপকূলীয় বরগুনা জেলার কামারশালাগুলোতে বেড়েছে কামারদের কাজ ও কদর। কোরবানির গবাদিপশু জবাই করতে এবং গবাদিপশুর মাংস তৈরিতে দা, ছুরি, চাপাতি ও কাটারি প্রয়োজন। তাই মানুষ গবাদিপশু জবাই ও মাংস কাটার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি বানিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে পুরাতন সরঞ্জামাদি মেরামত করতে আসছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের ও কসাইদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারী ব্যবসায়ীরাও কোরবানির এসব সরঞ্জামাদি অর্ডার করছেন, এসে নিয়েও যাচ্ছেন।

সদর বরগুনার কামারপট্টিতে কোরবানির সরঞ্জামাদি কিনতে এসেছেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ঈদ এলে লোহার দাম না বাড়লেও কয়লার দাম বাড়িয়ে দেয় অনেক ব্যবসায়ী। ফলে কামাররাও তাদের শ্রমের দাম বাড়িয়ে শোধ নেয়। তাছাড়া ঈদের সময় কামারদের তৈরি সরঞ্জামাদির চাহিদা বেশি থাকে। কাল বাদে পরশু ঈদ। তাই যে দামই হোক মাংস কাটার সামগ্রী এখন না কিনলে পরে আর পাওয়া যাবে না।’ প্রায় ৪০ বছর কামার পেশার সঙ্গে আছেন সদর বরগুনার কামারশিল্পী ৬০ বছর বয়সি বাদল কর্মকার। তিনি বলেন, ‘আমি বাবার কাছ থেকে এই কাজ শিখেছি। ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর বাবার সঙ্গে থেকে এই কাজ শুরু করি। ছেলেমেয়েদের এই পেশায় আনিনি। কারণ বর্তমানে লোহা কয়লার দাম বেড়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের হাতে তৈরি সরঞ্জামাদির দাম বাড়েনি।’

তালতলী উপজেলার কামারশিল্পী সন্তোষ কর্মকার বলেন, ‘আগে আমাদের কামারশিল্পীদের প্রচুর কাজের চাপ ছিল। বর্তমানে বিশেষ সময় ছাড়া কাজের তেমন একটা চাপ থাকে না।’ এর কারণে প্রসঙ্গে গান্ধী কর্মকার বলেন, ‘বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি তৈরি করার ফলে আমাদের হাতের তৈরি সরঞ্জামাদির প্রতি মানুষের আগ্রহ দিনদিন কমে যাচ্ছে।’

বরগুনা কামার সমিতির সভাপতি হরিদাস কর্মকার বলেন, ‘লোহা ও কয়লার দাম ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। খরচ কমাতে এখন তাই গাছের কয়লা দিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। কিন্তু গাছের কয়লায় কাজ করতে বেশি কষ্ট হয়। এসব কারণে অনেকে এখন এই পেশাই ছেড়ে দিচ্ছেন।’

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশের নজরদারি। বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘ঈদ ও পূজাপার্বণ এলে বাড়ে দেশীয় অস্ত্র ও সরঞ্জামাদির অবাধ বিচরণ। অনেক কিশোর-কিশোরী এসময় বিভিন্ন প্রকার দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহ করে ও পরবর্তীতে বড় ধরনের অপরাধ ঘটায়। তাই পুলিশের পক্ষ থেকে কামার পট্টিগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’

বি.দ্র.: লেখাটি তৈরি করতে বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়ার সাহায্য নেয়া হয়েছে


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ আগস্ট ২০১৯/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়