ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শাপলার বহু গুণ

হুরণ আজাদী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১২ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শাপলার বহু গুণ

হুরণ আজাদী : শাপলা ফুলের নাম মনে হতেই একরাশ ভালোবাসা ছুঁয়ে যায় অন্তরজুড়ে। গর্বিত মনে হয় নিজেকে। আমার ধারণা আমাদের দেশের সবারই কম-বেশি এমন হয়। কারণ শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। এ কারণে শাপলা পৃথিবীর সেরা ফুল বলে মনে হয়। শাপলা ফুলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা অপরিসীম।

শাপলা Nymphaeaceae পরিবারের সদস্য। এটা একটি গ্রীক শব্দের অনুবাদ। প্রাচীনকালে গ্রীসে জলদেবীদের এই ফুল উৎসর্গ করে উপাসনা করার নিয়ম ছিল। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ নীল শাপলা, শাদা শাপলা ফুলের অনুরাগী। মানুষ এই ফুল রান্না করে এবং কাঁচা সালাদেও খেত এক সময়। তাছাড়া শাপলা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন জাতির প্রার্থনার সময় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর মধ্যে মিশর, চীন, জাপান ও এশিয়ার বিভিন্ন এলাকা উল্লেখযোগ্য। এটি এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম: Nymphaea. শাপলার প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি প্রজাতি আছে পৃথিবীতে। এদের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন নামে ডাকা হয়। বাংলা ভাষায় এদের শাপলা, শালুক বলা হয়। ইংরেজিতে Water Lily বলা হয়, তামিল ভাষায় ভেলাম্বাল, সংস্কৃততে কুমুদ, অসমিয়া ভাষায় নাল বলা হয়। এমন আরো অনেক নাম আছে এদের বিশ্বের অন্যান্য দেশে। শাপলা ফুল নানা রঙের হয়। যেমন শাদা, লাল, গোলাপি, নীল, বেগুনী, হলুদ ইত্যাদি।

শাপলা ফুল আমাদের দেশের পুকুর, হাওড়-বাওড়, নদী-নালা ও হ্রদে জন্মে। এই ফুল সাধারণত ভারত উপমহাদেশেই বেশি দেখা যায়। শাদা শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। এই ফুল অনেক রঙের হলেও শুধুমাত্র শাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশের পয়সা, টাকা, দলিলপত্রে জাতীয় ফুল শাপলার জলছাপ আঁকা থাকে। শাদা শাপলা ফুলের অনেক জাত আছে। এই ফুল একসময় অত্যন্ত সুলভ ছিল, এই কারণে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হিসেবে Nymphaea pubescens শাদা শাপলা ফুলের প্রজাতি বেছে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে অধিক জনসংখ্যার কারণে, জলাশয় কমে যাওয়ায় এই উদ্ভিদ দুর্লভ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এই ফুল থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশের পুকুর ও হ্রদেও এই ফুল প্রচুর দেখা যায়। শ্রীলংকার জাতীয় ফুলও শাপলা। তবে শাদা শাপলা নয়, নীল শাপলা। শ্রীলংকায় এই ফুল নীল মাহানেল নামে পরিচিত। নর্থ আমেরিকা, সাউথ আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকায়ও বিভিন্ন রঙের শাপলা জন্মে।

 



শাপলা ফুল রাতে পূর্ণাঙ্গভাবে ফোটে। এরা দিনের বেলায় কিছুটা সঙ্কুচিত হয়। এর কিছু প্রজাতির ফুল দিনের বেলায়ও ফোটে। এই ফুল সরাসরি কাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকে। ফুলের কাণ্ড বা ডাঁটা পানির নিচে মূলের সাথে যুক্ত থাকে এবং এই মূল জলাশয়ের তলদেশের ভূমিতে যুক্ত থাকে। এর পাতাগুলো পানির উপর ভেসে থাকে। পাতার আকার প্রায় গোল, তবে এর একটি পার্শ্ব বিভক্ত থাকে। পাতার রং সবুজ, পাতার প্রান্ত ঘিরে ধারালো খাঁচ থাকে। এর কলি দেখতে অনেকটা গম্বুজের মতো লাগে। এর বাইরের দিকের রং সবুজাভ। যখন ফুল ফোটে তখন এর ভেতরের পাপড়িগুলো ছড়িয়ে পড়ে। একটি শাপলা ফুলের স্থায়িত্ব এক নাগাড়ে সাত থেকে দশদিন পর্যন্ত হতে পারে।

প্রায় সারা বছরই শাপলা ফুল দেখা যায়। তবে বর্ষা ও শরতে এই ফুল বেশি দেখা যায়। তখন দেখে মনে হয় অসংখ্য তারা ফুটে আছে জলে। এর ফল সামান্য লম্বাটে। এই ফুল যেমন দেখা যায় চাষের জমিতে, তেমনই দেখা যায় বন্য এলাকায়। কাটা ধান ক্ষেতের জমে থাকা অল্প জলে এই ফুল ফুটে থাকতে দেখা যায়। ভরা বর্ষায় শাপলা যেন প্রাণ ফিরে পায়, তখন খাল-বিল, ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, পুকুর, নদ-নদী ইত্যাদিতে এরা রাজত্ব করে দৃষ্টিনন্দন ফুল ফুটিয়ে। তখন সে দৃশ্য যেন বর্ষাকালে অপরূপ সৌন্দর্য মহিমায় ভরিয়ে দেয়। বহুযুগ ধরে আমাদের দেশে শাপলা সবজি হিসেবে খাওয়া হয়, বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে। বিশ্বের অনেক দেশেই সবজি হিসেবে শাপলার ফুল ও ডাঁটা খাওয়া হয় রান্না করে এবং কাঁচা। উদ্ভিদটির গোড়ায় থাকে আলুর মতো এক ধরনের কন্দ যার নাম শালুক, অনেকে একে সবজি হিসেবে খায়। শাপলার ফল সাধারণত আমরা ঢ্যাঁপ বলে থাকি। এই ঢ্যাঁপ হয় সবুজ গোলাকার। ঢ্যাঁপ যখন কঁচি থাকে তখন এর ভেতরের বীজগুলোর রং থাকে লাল, যখন বীজ পেকে যায় তখন কালো রঙ ধারণ করে। এই ফল পাকলে ফেটে যায়, এর মধ্যে অনেকগুলো কোষ থাকে। কোষগুলোর মধ্যে থাকে অসংখ্য বীজ। বীজগুলো আকারে খুবই ছোট।

শাপলা বিভিন্নভাবে রান্না করে খাওয়া হয় আমাদের দেশে। বিশেষ করে ইলিশ ও চিংড়ি মাছের সাথে রান্না করলে অতুলনীয় স্বাদ লাগে খেতে। শাপলার ডাঁটা ছোট করে কেটে চিংড়ি মাছ আর নারকেল বাটা দিয়ে মাখা মাখা ঝোল করে রান্না করা হয়। এর ডাঁটা ছোট করে কেটে শুধু নারকেল কোরা দিয়ে ভাজি করলেও চমৎকার স্বাদ লাগে খেতে। শাপলার ডাঁটা একটু লম্বা করে কেটে ইলিশ মাছ দিয়ে ঝোল করে খেতেও খুব স্বাদের। এই রকম আরও নানা পদ্ধতিতে শাপলা রান্না করে খাওয়া হয়। বর্ষাকালে শাপলা প্রচুর পরিমাণে জন্মে, তখন বাজারে বিক্রি করা হয়। সেজন্যই বর্ষাকালে আমাদের দেশে শাপলা বেশি খাওয়া হয়। শাপলার ঢ্যাঁপের ভিতরের বীজ কচি অবস্থায় কাঁচা খাওয়া হয় এবং পুষ্ট হলেও রান্না করে খাওয়া হয়। পাকা বীজ ঢ্যাঁপ থেকে বের করে ছাই দিয়ে ঘষে বীজের গায়ের পিচ্ছিল আস্তরণ ছাড়ানো হয়। এরপর বীজ রোদে শুকানো হয়। ঠিকমত শুকিয়ে গেলে বীজগুলো দিয়ে ঢ্যাঁপের খৈ বানানো হয়। এই খৈয়ের সাথে গুড় দিয়ে বানানো হয় ঢ্যাঁপের মোয়া, মুড়কি, যা ছোট বড় অনেকের খুব প্রিয়। আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলেই এই ধরনের খাবারের খুব প্রচলন ছিল অতীতে। এখনো কিছুটা আছে তবে আধুনিকতার জোয়ারে অনেকটা কমে গেছে। এই সব খাবার আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।

 



গ্রাম বাংলার দুরন্ত কিশোর-কিশোরীদের খেলার সামগ্রী শাপলা। তারা জলে নেমে সাঁতার কেটে এগুলো তুলে আনে। এর ফুল দিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা গলার মালা, হাতের চুড়ি, মাথার মুকুট ইত্যাদি বানিয়ে খেলাধুলা করে। এ ছাড়া ঘর সাজাতেও শাপলা ফুল ব্যবহার করা হয়। শাপলা বাগানের জলাধারে বা অ্যাকুয়ারিয়ামে লাগানোর জন্য খুব জনপ্রিয় একটি উদ্ভিদ। বর্তমানে আমাদের দেশে অনেকে ছাদ বাগানেও এর চাষ করে থাকেন সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য।

বহু রকমের ঔষধি গুণ বিদ্যমান শাপলাতে। ভারতে আম্বাল নামের আয়ুর্বেদিক ওষুধ বানাতে শাপলা ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ অপরিপাকজনিত রোগের পথ্য হিসেবে কাজ করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে এই উদ্ভিদে ডায়াবেটিক রোগের জন্য প্রয়োজনী ঔষুধি গুণ রয়েছে। সাধারণত ফুল ও বীজ দিয়ে তৈরি ওষুধ বিভিন্ন রোগে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে হৃদযন্ত্রের শক্তি যোগানো, অতিরিক্ত পিপাসা নিবারক, প্রসাবের জ্বালা, আমাশয় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শাপলা বহু গুণে গুণান্বিত একটি উদ্ভিদ।

লেখিকা : প্রবাসী এবং উদ্ভিদবীদ



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জানুয়ারি ২০১৮/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়