ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

কবির জন্যে অন্তরের ভালোবাসা চিরকাল

টোকন ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবির জন্যে অন্তরের ভালোবাসা চিরকাল

আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)

 

|| টোকন ঠাকুর ||

কবির বাসায় গেছি আগেও, পরেও, কিন্তু সেইদিন আর যাওয়া হলো না, আদতে গেলাম না। কিন্তু কেন?

কবি আল মাহমুদকে আমরা দীর্ঘসময় পেয়েছি মগবাজারের বাসিন্দা হিসেবে, কিন্তু দুইহাজার সাতের দিকে তিনি ছিলেন গুলশানে। তাঁর সেই গুলশানের বাসায় আমি ‘সেইদিন’ যাইনি; ইচ্ছে করেই। জগৎবাসীর কাছে হতে পারে তা তুচ্ছ কারণ, কিন্তু সেদিন তুচ্ছকেই আমার উচ্চ বলে মনে হলো। মনে হলে আর কি করা- শেকসপিয়রের বাড়িতে যাওয়ারও টাইম নেই! অথচ এর আগে আমি মাহমুদ ভাইয়ের মগবাজারের বাসায় কবিতা আনতে গেছি, কবিতার সম্মানী দিতে গেছি। অবশ্য এই দু’টি কাজই ছিল সাহিত্যপাতায় চাকরি করার সুবাদে। চাকরি করতাম অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘মুক্তকণ্ঠ’র সাহিত্য বিভাগ ‘খোলা জানালা’য়। ঘরোয়াভাবে কবিকে দেখেছি একটুখানি। একদিন আমি আর খোকন গেছি মাহমুদ ভাইয়ের বাসায়; ঈদের দিন। মাহমুদ ভাইয়ের মা খুব অসুস্থ তখন। আলফ্রেড খোকন তখনও আমার মতো অসংসারি। তো খোকন আমি সেদিন সারাটা দুপুর ছিলাম মাহমুদ ভাইয়ের বাসায়। মাহমুদ ভাইয়ের বাসায় সেদিন আমরা গেছিই খেতে, যদিও দু’তিন ঘণ্টা থেকেও খাওয়া-দাওয়া হয়নি। মাহমুদ ভাই আমাদের সঙ্গে বসে; তাঁর যা স্বভাব তখন, একটার পর একটা গোল্ডলিফ টানছেন, আমি আর খোকন খাচ্ছি বিস্কুট এবং একসময় কবি বলেই দিলেন- ‘শোনো, আমার আম্মার শরীরটা তো খুব খারাপ, তোমরা আজকে যাও, আরেকদিন এসো।’ কবির বসার ঘর থেকে আমরাও কিছুটা দেখতে পাচ্ছিলাম, অনতিদূরের ঘরে তাঁর অশীতিপর মা’কে শুইয়ে রাখা হয়েছে, মায়ের পাশে আরো দু’একজন মহিলা আছেন। সত্যিই তো, এরকম অবস্থায় যতই তা ঈদের দিন হোক, ব্যাপক করে খাওয়া-দাওয়ার সুযোগই বা কোথায়? এর কিছুদিন পর সম্ভবত আল মাহমুদের মা মারা গেলেন। একদিন মাহমুদ ভাইয়ের সদ্যপ্রকাশিত একটি কবিতা পড়ে শুধু ভালোলাগা জানাতেই গেছি তাঁর কাছে। জাফর আহমদ রাশেদ, অলকা নন্দিতা আর কে ছিল আমাদের সঙ্গে, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। যথারীতি গোল্ডলিফ চলে। চা-পুরি খাই আমরা। মাহমুদ ভাই নিজেকে সবসময় একটা আত্মবিশ্বাসের মধ্যে জিঁইয়ে রাখতে চাইতেন, অবশ্যই তাঁর কবিতা সেই আত্মবিশ্বাসের খুঁটি।
আল মাহমুদের সঙ্গে বাইরে দেখা হয়েছে বাংলামোটরে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আগের সেই বাড়ির উঠোনে। দেখা হলেই, গোল্ডলিফ পর্যায়ের সেই ডাক শুনতে পাই কানে- ‘কি মিয়া, তোমরা না তরুণ কবি, সিগারেট আছে? গোল্ডলিফ দাও?’  হোটেল শেরাটনে দেখা হলো এক অনুষ্ঠানে, কী বেশ সেদিন তাঁর! আমি আর মারজুক রাসেল সেই বেশ নিয়ে মাহমুদ ভাইয়ের সামনেই খানিকটা মজা করলাম। শাহবাগ আজিজ মার্কেটের নতুন বইপাড়ায়, দোতলায় মনীষী আহমদ ছফা দফতর খুলেছিলেন। সেই দফতরে আমরা কেউ কেউ অবৈতনিক দাফতরিক হাজিরা দিতামই। বললাম, ‘ছফা ভাই, নিচতলায় বইয়ের দোকানে দেখলাম আল মাহমুদকে।’ ছফা ভাই আর্লি সেভেনটিজে আল মাহমুদ সম্পাদিত দৈনিক গণকণ্ঠে ধারাবাহিকভাবে যে লেখাগুলো লিখেছিলেন, সেই লেখাই কিন্তু একত্রিত করে তার গ্রন্থের নাম, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আল মাহমুদ সে-সময় জেলজীবন পেয়েছিলেন। জেলে ছিলেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনও; সে-সময়। তো আল মাহমুদ নিচতলায় আছেন শুনে ছফা ভাই বললেন, ‘মামু, মামু কোথায়?’ মজা লাগল শুনে। এরও কত আগে আমি যখন শৈলকুপার এক গ্রামে বসে বাল্যবেলা কাটাচ্ছিলাম, মেট্রিক পরীক্ষার কিছুদিন আগেই আমি আল মাহমুদকে দেখেছিলাম। শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের পিতা কবি গোলাম মোস্তফা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, মনোহরপুরে শীতের রাতে আল মাহমুদ মঞ্চে বসেছিলেন, ক্লিন সেভড। দাঁড়ি-গোঁফ তো রাখা শুরু করলেন আরও পরে। স্কুল মাঠের ঘাসের উপরে দাঁড়িয়ে হাজারখানেক লোকের মধ্যে আমি দেখছিলাম কবিকে। মসনদে ছিলেন এরশাদ।
 


শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদকে নিয়ে ফটোগ্রাফার নাসির আলী মামুন ‘প্রথম আলো’য় সাক্ষাৎকারভিত্তিক অয়োজন করেছিলেন একবার। সেই সাক্ষাৎকারের একটি বা দু’টি জায়গা নিয়ে আমি একটা প্রতিক্রিয়া লিখলাম ‘প্রথম আলো’ সাময়িকীতে- ‘দুই অন্ধ কবির খপ্পরে বাংলা কবিতা’। লিখেছিলাম, ‘অন্ধ হলেই হোমার হওয়া যায় না...।’ আমার প্রতিক্রিয়ায় শামসুর রাহমানের মতামত জানা হয়নি, কিন্তু আল মাহমুদ সেটি নিতে পারেননি। ‘প্রথম আলো’তে লেখার প্রতিক্রিয়া মাহমুদ ভাই ‘প্রথম আলো’য় করলেন না, করলেন নয়া দিগন্তে। পরপর দুই শুক্রবার হাফপেইজ করে লিখলেন সরাসরি আমার বিরুদ্ধে, ‘নয়া দিগন্ত’র সাহিত্যপাতায়। বাহাসটা হচ্ছিল ‘প্রথম আলো’র পাতায়, উনি সেটা নিয়ে গেলেন ‘নয়া দিগন্ত’র সাহিত্যপাতায়। ফলে, খেলা আর জমল না। কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। সাক্ষাৎ নেই ষোলো বছর। অবশ্য এখন থেকে দেড়-দু’বছর আগে আবার আমাদের দেখা হলো; পুনরায় মগবাজারে, কবির বাসায়। এবার এই দেখা করানোর অনুঘটক ‘প্রথম আলো’ এবং তরুণ কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ। আল মাহমুদ আর আমাকে মুখোমুখি বসিয়ে আলতাফ শাহনেওয়াজ নানান প্রশ্ন করবেন এবং কবি ও কবিতার একটা সেকাল-একাল সম্পর্ক ধরবেন। পরের সপ্তাহে পহেলা বৈশাখি আয়োজনে সে-সব ছাপা হলো। আামার আর মাহমুদ ভাইয়ের ছবিও একসঙ্গে ছাপা হলো। অবশ্য কিছু বছর আগে দৈনিক ‘সমকাল’ সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের সঞ্চালনে একবার আল মাহমুদকে পেয়েছিলাম, কিন্তু সেদিন ‘সমকাল’ অফিসে রফিক আজাদসহ আরো ১২/১৩ জন কবি থাকায় আমাদের দ্বান্দ্বিকতার রেশ আর আছে না নেই, সেটা ধরা যায়নি।

তো যে কথা বলব বলে এ লেখা সূচিত আজ, কেন সে-দিন আল মাহমুদের বাসায় যাওয়া হলো না আমার?

২০০৭ সম্ভবত। আমার বাসা তখন নিউ এলিফ্যান্ট রোড। একদিন আমাকে ফোন করলেন মারুফ রায়হান। বললেন, ‘টোকন, আগামীকাল বিকালে কি তুমি ফ্রি আছ?’

বললাম, ‘কাহিনী কি?’

মারুফ ভাই বললেন, ‘কালকে আমরা কবি আল মাহমুদের বাসায় যাব।’

বললাম, ‘যান, যেখানে মন চায় চলে যান, আমাকে ফোন দিলেন কেন?’

মারুফ ভাই বললেন, ‘কলকাতা থেকে কবি জয় গোস্বামী এসছেন, উনি একটা হোটেলে উঠেছেন। জয়দা-ই মূলত আল মাহমুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চান। জয়দা বললেন, রাইসু ও টোকনকে খবর দেওয়া যায়? আড্ডাটা একসঙ্গে দিতে চান।’

এ পর্যন্ত ভালোই ছিল কিন্তু মারুফ ভাই যখন বললেন, ‘শোনো, এটা খুব সিলেকটিভ, সঙ্গে আর কোনো কবিকে আনা যাবে না।’

বললাম, ‘কবি আনতে যাব, কবি পাব কোথায়? কিন্তু আমার সঙ্গে তো সবসময় একজন ফটোগ্রাফার থাকে। ফটোগ্রাফারও আসবে না?’

মারুফ ভাই বললেন, ‘ফটোগ্রাফার আমাদের সঙ্গে থাকবে।’
এই যে একটা ইস্যু, ইস্যুটা ততটা বড়ও নয় হয়তো, কিন্তু আমার কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছও বড় ব্যাপার হয়ে যায়। হলোও সেদিন। পরদিন বিকেলে মারুফ ভাই যখন আমাকে একটার পর একটা ফোন দিয়ে চলেছেন, আমি ফোন না ধরেই চলেছি। আমি সেদিন এক বালিকার সঙ্গে মোহাম্মদপুরের ও-পারে বসিলা নদীতে ঘণ্টা চুক্তিতে নৌকা ভাড়া করে সূর্যাস্ত দেখতে বেরিয়েছি। হঠাৎ ফোন ধরে মারুফ ভাইকে বলে দিলাম, ‘আপনারা যান আল মাহমুদের বাসায়, আমি যাব না।’
মারুফ ভাই বেশ অস্বস্তিতেই পড়েছেন, টের পাচ্ছিলাম। তিনি বললেন, ‘আমি জয়দাকে কথা দিয়েছি তুমি আসবে, এখন না এলে কেমন হয়ে যাচ্ছে না?’ মারুফ ভাই তখন বললেন, ‘তুমি তোমার ফটোগ্রাফার নিয়েই আসো।’ কিন্তু ‘নৌকার পালে বাতাস লাগিয়াছে, পোস্টমাস্টার আর ফিরিবে কেমনে?’ একপর্যায়ে মারুফ ভাই ফোন ধরিয়ে দিলেন জয় গোস্বামীর হাতে। জয়দা বললেন, ‘আড্ডা দিতে চেয়েছিলাম, আল মাহমুদ-রাইসু-আপনার সঙ্গে।’

জয়দাকে বললাম, ‘সেটি হবে আরেকদিন, ঢাকায়, নয় কলকাতায়। কিন্তু এখন আমি আছি নদীর মধ্যে, আমরা সূর্যাস্ত দেখতে যাচ্ছি।’

আল মাহমুদকে সামনাসামনি আমাদের আড্ডা হবে না। আল মাহমুদের কবিতা থাকবে আমাদের আড্ডায়। কারণ, আল মাহমুদ গতকাল চিরদিনের জন্যে চলে গেছেন আমাদের কলহবান্ধব জীবনযাপন ছেড়ে।

আল মাহমুদ বড় মাপের কবি ছিলেন, যেমন এ-কালে জন্মানো কঠিন। কবির জন্যে অন্তরের ভালোবাসা ঢেলে যাব চিরকাল।

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৩৬ ভূতের গলি, নারিন্দা, ঢাকা



 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়