ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নদী দূষণ প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

সাইফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ১১ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নদী দূষণ প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

রাইজিংবিডি ডেস্ক : নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে নদী দূষণ প্রতিরোধে এগিয়ে আসার জন্য সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পানিসম্পদ দূষণের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাপীই এটি একটি সমস্যা। এই সমসাটি নদীতেই কেবল নয়, সাগরেও দেখা দিচ্ছে, সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে বর্জ্য ফেলা। আমি সকলকে বলব যে, নদীতে বর্জ্য ফেলা সকলকে বন্ধ করতে হবে। কারণ এটি একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।’

‘কাজেই প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠান যারা গড়ে তুলবেন তারা যেন নদী দূষণ না করেন। সেজন্য তাদের আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নির্মাণ করতে হবে, পানি শোধনাগার করতে হবে, যোগ করেন তিনি।

সেই সাথে রাস্তা-ঘাটে চলাচল করার সময়ও এদিক সেদিকে বর্জ্য না ফেলার প্রতি লক্ষ্য রাখতে সবার প্রতি আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটা আমরা জানি। আর সেজন্যই নিজস্ব অর্থ দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে এই জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মুক্ত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য সব থেকে বেশি প্রয়োজন প্রচুর বৃক্ষরোপণ করা।

তিনি বলেন, ‘এজন্য আমি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে বলব  কেবল নদী ড্রেজিং করলেই হবে না, সেখানে বৃক্ষরোপণটাও করে দিতে হবে। প্রতিটি উপকূল অঞ্চলে সবুজ বেস্টনির সৃষ্টি করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় নদী ড্রেজিংয়ের মাটি আবার নদীতেই না ফেলে পাড়ে জুট জিও টেক্সটাইলের সাহায্যে পকেট সিস্টেম করে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, তাহলে সেখান থেকে অনেক ভূমিও উদ্ধার করা সম্ভব হবে যেখানে পরবর্তীতে কৃষি এবং শিল্পায়ন দুটি কাজই করা যাবে।

নদী দূষণমুক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নদী সংরক্ষণের সঙ্গে যারা জড়িত তারা যার যার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি।’

শেখ হাসিনা এ সময় শহরাঞ্চলে দৈনন্দিন কাজে পানির অপচয় রোধ করা প্রত্যেকের নাগরিক কর্তব্য বলেও উল্লেখ করেন।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আমাদের দেশের পানি ব্যবস্থাপনা উজানের দেশের উপর নির্ভরশীল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেই জাতির পিতা আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭২ সালে ‘যৌথ নদী কমিশন-জেআরসি’ গঠন করেন।

তিনি বলেন, তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরও বাস্তবায়ন করে।

তিনি বলেন, আমরা ভারতের সঙ্গে অন্যান্য নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে ‘ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন কো-অপারেশন ফর ডেভেলপমেন্ট।’

বিভিন্ন কারণে এক সময়ের খর স্রোতা নদীগুলো মরে গেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর গতিপথ ও নাব্যতা পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ শক্তিশালীকরণ এবং প্লাবনভূমির সঙ্গে নদীর সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষায় নদীর তীর বরাবর বাফারজোন তৈরির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

সরকার প্রধান বলেন, নদ-নদীর সুরক্ষা ও নৌপরিবহনকে নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার ৭টি ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন। এর দীর্ঘ সময় পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯-’১৩ মেয়াদকালে আরো ১৪টি ড্রেজার সংগ্রহ করে। বর্তমানে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২২টি, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনীর আওতায় ৪০টি ড্রেজার রয়েছে। আরো ৮০টি ড্রেজার সংগ্রহ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

শেখ হাসিনা দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘চলতি মেয়াদে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ পুনঃখনন করে নৌ চলাচলের উপযোগী করা হবে।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় বালু মহল করা নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সতর্ক করে বলেন, ‘এজন্য আমি ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছি এক জায়গায় বেশি দিন বালু মহাল করা যাবে না। বালু মহালগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে করতে হবে যাতে করে আমাদের ঐ অঞ্চলটা নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে।’

তিনি এ সময় হাওর-বাওড় ও জলাধার সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রথমবার (’৯৬ সালে) সরকারে এসেই এ সংশ্লিষ্ট ‘জলাধার সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে আমরা পানি আইন ২০১৩ করেছি এবং এর বিধিমালাও ২০১৮ প্রণয়ন করেছি। যা বাস্তবায়ন করা একান্তভাবে দরকার।

সরকার প্রধান বলেন, ‘বৃষ্টির পানিকে সংরক্ষণ করা। ভূ-উপরিস্থ পানি যত বেশি সম্ভব ব্যবহার করা এবং ভূগর্ভস্থ পানি যথা সম্ভব ব্যবহার না করা-সেদিকেও আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি।’

‘অর্থাৎ আমাদেরকে প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করতে হবে সেদিকে লক্ষ্য রেখে পানিকে সংরক্ষণ করা এবং পানির যথাথভাবে ব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে,’ বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী সর্বাগ্রে নদী শাসন, নদী ড্রেজিং এবং খাল, বিল, নদী-নালা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা একটা নির্দেশ দিয়েছি- যেখানে আমাদের পুকুর-খাল যত যা আছে তার কোনটা যেন নষ্ট না হয়।’

এ সময় তিনি সুন্দরবনের ঘষিয়া খাল বন্ধ করে দিয়ে চিংড়ি চাষের কঠোর সমালোচনা করেন

তিনি বলেন, ‘আমি মোংলা বন্দরের ঘষিয়া খালটি যখন ড্রেজিংয়ের নির্দেশ দেই তখন দেখি প্রায় আড়াইশো খালের মুখ বন্ধ। তবে, এগুলো অধিকাংশই খুলে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। যার ৮০টি এখনও বাকি আছে, সেগুলোও খুলে দেওয়া হবে। এরফলে পশুর নদী ও ঘষিয়া খাল এবং সর্বোপরি সুন্দরবনও রক্ষা পাবে।’

বাংলাদেশটাকে টিকিয়ে রেখেছে সুন্দরবন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দেশের স্থলভূমিকে যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় খেকে রক্ষার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে সুন্দরবনের আদলে ম্যানগ্রোভ বন বেস্টনি গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বন্যার দুর্ভোগের কথা স্মরণ করে বলেন, এর একটি ভাল দিকও রয়েছে যে, এটি প্রচুর পলি মাটি বহন করে আনে। কাজেই দেখা যায়-যে বছর বন্যা হয় তার পরের বছর ফসলও ভালো হয়।

তিনি বলেন, ‘প্রকৃতি যেমন নেয়, তেমনি ফিরিয়েও দেয়। এখন আমরা কতটুকু এই প্রকৃতির কাছ থেকে গ্রহণ করে কাজে লাগাতে পারি সেটাই হল বড় কথা।’

প্রধানমন্ত্রী ‘ব্লু ইকোনমির’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০১৪ সালে প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করে আমরা সর্বমোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল লাভ করেছি। এই বিস্তীর্ণ সমুদ্র অঞ্চল ‘ব্লু ইকোনমির’ বিকাশে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। আমরা সমুদ্রসম্পদের সর্বোচ্চ ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই।’

বিশ্বের বহু দেশে পানির অভাব থাকলেও নদী মাতৃক বাংলাদেশে পানির কোনো অভাব না থাকায় এই প্রাকৃতিক সম্পদটিকে ভবিষ্যতে রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না সে বিষয়েও তিনি এখন থেকে দৃষ্টি দেয়ার আহবান জানান।

দেশের ৮০ ভাগ জনগণ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে পানির কোনো অভাব নেই। বৃষ্টির পানি আমাদের অনেক বেশি সেটা আমরা সংরক্ষণ করে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যেমন কাজে লাগাতে পারি তেমনি যেসব দেশে সুপেয় পানির অভাব রয়েছে ইনশাআল্লাহ সেসব দেশে আমরা ভবিষ্যতে পানি সরবরাহর করতে পারবো। এমনকি এই পানি বোতলজাত করে বিশ্বের অনেক জায়গায় বিক্রিও করতে পারি। আমাদের সেই সুযোগটাও রয়েছে।’

দেশবাসী ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সময়টাকে মুজিব বর্ষ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তখন বাংলাদেশে আর কোনো  হতদরিদ্র থাকবে না। তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলতে তার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের শতবর্ষ মেয়াদি ব-দ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণের কথাও উল্লেখ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ুর ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আমরা ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করেছি।’

পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম এবং একই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র সেন বক্তৃতা করেন। মন্ত্রণালয় সচিব কবির বিন আনোয়ার অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।

এতে বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান-২১০০ এর ওপর নির্মিত দুটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।

অনুষ্ঠানে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে শত বর্ষের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার একটি স্মারক উপহার দেন।

মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং মিশন প্রনিনিধি ও প্রধান, উন্নয়ন সহযোগী  সংস্থার প্রতিনিধি এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

তথ্যসূত্র: বাসস

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ এপ্রিল ২০১৯/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়