ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ধর্ষণ প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের কিছু সুপারিশ

মোস্তফা কামাল শাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১০ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ধর্ষণ প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের কিছু সুপারিশ

দিন দিন দেশে বেড়েই চলেছে করোনার প্রকোপ। এ কারণে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন যেন করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। এখন এমন একটা দিন খুঁজে বের করা কষ্টকর, যে দিনে দেশে একটাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। ধর্ষণ যেন অন্যরকম মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সমাজে।

কেন এই নৈতিকতার অবক্ষয়! এমতাবস্থায় ধর্ষণ প্রতিরোধ নিয়ে কী ভাবছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, তা লিখে পাঠিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোস্তফা কামাল শাওন।

শেখ জাকিয়া নূর ঐশী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

যেকোনো সমস্যা প্রতিরোধের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যার মূল বা ভিত্তি খুঁজে বের করা। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ কেন হচ্ছে? কেনই বা এর হার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে? আপনি, আমি, আমাদের পরিবার সমাজ এর জন্য কতটুকু দায়ী? খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়া বা টিভির পর্দায় প্রতিদিন ধর্ষণের খবর দেখি, ধর্ষকের বিচারের খবর কেন দেখি না?

ধর্ষকের কঠোর শাস্তির খবর শুনে আতঙ্কে ধর্ষকদের হাড় কেন কেঁপে উঠে না? জন্মের পর থেকে পরিবার ও সমাজ থেকে মেয়েকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ‘তুমি দুর্বল, তোমাকে সাবধানে চলতে হবে, নাহলে ধর্ষণের শিকার হতে হবে।’ অথচ ছেলেকে এই ব্যাপারে কোনো ধরনের শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেন না কেউ। তাই তারা নিজ থেকেই বুঝে নেয় ‘আমি সবল, সব ক্ষমতা আমার হাতে, আমি চাইলেই একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারি, মেয়েরা ভোগ্যপণ্য মাত্র।’ বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে ফেরেশতা মনে করলেও সবাই তো ফেরেশতা হয় না। সবাই নিজেকে সামলাতেও পারে না।

ছোট থেকে শুধু সন্তানের পরীক্ষার নম্বর নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে, আপনার সন্তান কীভাবে বড় হচ্ছে, কেমন মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে, তা নিয়েও সচেতন থাকতে হবে। অনেক সময় ছোটবেলার কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা বা নির্যাতনের কারণেও তাদের মানসিক বিকৃতি ঘটতে পারে। যার কারণে তারা আস্তে আস্তে মানুষের প্রতি সম্মান হারিয়ে ফেলে এমনকি এদের আত্মসম্মানবোধ বলেও কিছু থাকে না। এরাই একসময় ধর্ষকে পরিণত হয়।

সর্বোপরি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা, পারিবারিকভাবে নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, মেয়েদের দুর্বল না ভেবে তাদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। আপনি আমি সচেতন হলে হয়তো আগামী প্রজন্ম একটি সুস্থ সমাজে বেড়ে উঠার সুযোগ পাবে।

আমিনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ধর্ষণের প্রধান কারণ সামাজিক নিরাপত্তা না থাকা, বিচারহীনতা, মাদকদ্রব্যের বিস্তার, সুশিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি। ধর্ষণের হার কমানোর জন্য প্রথমে আইনের শাসন থেকে ঘটনা আড়াল করার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। অনেক মামলা আড়ালেই থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক মাধ্যমও এক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারে। অবশ্যই ভিকটিমের পরিচয় গোপন রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ভিকটিম ব্লেমিং যেন না ঘটে, তা খেয়াল রাখতে হবে।

কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগ এ সম্মানহানি ঘটতে পারে। এজন্য মেডিকেল রিপোর্ট, প্রশাসন সবকিছু সম্মিলিতভাবে মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ওয়ান স্টপ মেডিকেল চেকআপ নিশ্চিত করতে হবে, যা স্বচ্ছ ও সব ধরনের প্রভাবমুক্ত। খুব কম কেসই বিচার হয়। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আলাদা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। এলাকায় সালিশ বসিয়ে কিছু টাকা হাতে দিয়ে মিটমাট বন্ধ করতে হবে। সব ঘটনা আইনী প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে হবে।

এসিড নিক্ষেপের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এমন করে ধর্ষণের বিষয়টিও প্রচার করতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহন ও যাতায়াতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মাদকাসক্তরা এ ধরনের ক্রাইমে যুক্ত থাকে বেশি। তাই এক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সাথে ভিকটিমের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এখনো সামাজিকভাবে অনেকে ভিকটিম হয়ে সামনে আসতে চান না। পরবর্তীতে তাদের সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। তারা যেকোনো অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিষয়ে বঞ্চিত হন। সমাজ তাকে গ্রহণ করে না। এই মনোভাব পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।

সর্বোপরি সামাজিক মূল্যবোধ, দায়বদ্ধতা এবং কঠোর আইন প্রয়োগ ধর্ষণের হার কমাতে ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

অনন্যা সাহা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

দিন দিন মানুষ শিক্ষিত হলেও বা সমাজ এগিয়ে গেলেও ধর্ষণ নামক শব্দটি এখনো বিদায় নিচ্ছে না। গণমাধ্যমগুলো ভালো করে দেখলে প্রতিদিন ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গত জুন মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ১০১ জন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। ধর্ষণ নিসন্দেহে একটি অমানবিক এবং ঘৃণ্য অপরাধ। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে ধর্ষণের পেছনে অনেকেই দায়ী করে নারীর পোশাক এবং চলাফেরাকে। কিন্তু আমি যদি কথাটিকে পুরোপুরি সত্য বলে মেনেও নেই, তাহলে বলবো আমাদের সমাজে নারীর সাথে সাথে শিশুকেও কেন ধর্ষণের শিকার হতে হয়? পুরুষতন্ত্রের চাপে পুরুষ হারাচ্ছে তার মনুষ্যত্ব।

একজন পুরুষ যখন তার অর্ধাঙ্গিনীর উপর নির্যাতন করছে বা কোনো নারীকে ধর্ষণ করছে, তার ভেতর একটি মিথ্যা অধিকারবোধ কাজ করে। এর জন্য দায়ী পুরুষতন্ত্র। ধর্ষণ প্রতিরোধে পরিবার, সমাজ ও প্রশাসনের যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়; ছোট থেকেই সন্তানদের  নৈতিক শিক্ষা দেওয়া। এক্ষেত্রে পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। স্কুলে নৈতিক শিক্ষার বিষয় থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। শিক্ষকরা এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এদিকে নজর দেওয়া এবং সঠিক যৌনশিক্ষা দেওয়া। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা বন্ধ করা।

রুদ্র সাহা, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কুসংস্কারের অন্ত নেই এবং এগুলো কোনো দিক বিবেচনা না করেই কয়েক যুগ ধরে চলে আসছে। এখনো এগুলো সমাজের লোকেরা নীতি হিসেবে পালন করে। এর মধ্যে অন্যতম একটি নারী সহিংসতা। নিচু জাতি, অবলা, ভোগ্যসামগ্রী, আরও কতো কী বলে মনে করা হয়। আর এমন বিষয়গুলো ধর্ষণ নামক পাশবিক কাজকে উসকে দিচ্ছে।

দেশের কঠোর আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন করতে পারলে তবেই ধর্ষণ রোধ সম্ভব। তাছাড়া এই প্রায় বিচারহীনতার পরিবেশের অবসান না ঘটলে কোনোভাবেই ধর্ষণের প্রবণতাকে রোধ করা সম্ভব নয়।

 

জবি/মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়