ঢাকা     সোমবার   ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ১৫ ১৪৩১

এক বছরে ধর্ষণের শিকার ৫৭৪ জন

রায়হান হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  
এক বছরে ধর্ষণের শিকার ৫৭৪ জন

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা ও টেলিভিশন খুললেই নারী- শিশুকে ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর হত্যার খবর দেখা যায়। বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে আইন সংশোধন করা হলেও কোনোভাবেই কমছে না ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম অপরাধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সাজা বাড়িয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়। সামাজিক সচেতনতাই পারে ধর্ষণ কমাতে।

বাংলাদেশে গত বছরে ৫৭৪টি ধর্ষণের খবর পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ১৩৮টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন ৩৩ জন। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন ৯ জন।

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসের সংবাদ বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরে ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ৫ জন, ধর্ষণচেষ্টার পর খুন করা হয়েছে ৩ জনকে এবং ধর্ষণচেষ্টা পর আত্মহত্যা করেছে ৩ জন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১২৯ জন।

ধর্ষণ-সংশ্লিষ্ট মামলা হয়েছে ৪৩৩টি। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ৩২৭টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলা ১০৬টি, ধর্ষণচেষ্টার মামলা ৭৪টি। আসকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ধর্ষণের শিকার বেশি হয়েছেন ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সের মেয়েরা।

বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানি
ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ছাড়াও বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানি দিন দিন বাড়ছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেছে ১২ জন, আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ২ জন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদের জেরে খুন হয়েছে ৫ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৪ জন এবং নারী ১ জন।

যৌন হয়রানির পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে। বখাটেদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন ১১৭ জন। তাদের মধ্যে নারী ১০৯ জন এবং পুরুষ ৮ জন। বখাটেদের আক্রমণে আহত হয়েছে ১৩১ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ১২২ জন এবং নারী ৯ জন। 

যৌতুকের দাবিতে নারীর প্রতি সহিংসতা
বাংলাদেশে যৌতুকের দাবিতে নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৭ জন। এর মধ্যে মামলা দায়ের করেছেন ৫২ জন। স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়েছে ৫ জন। এসব ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে ৪টি। শারীরিক নির্যাতনের পর আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন, মামলা দায়ের হয়েছে দুটি। শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৪ জন নারীকে। এর মধ্যে ৩৫টি ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব  ঘটনার শিকার হয়েছেন বেশি ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সের নারীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজানা জেবিন রাইজিংবিডিকে বলেন, আমরা নারী শিক্ষার্থীরা যদি পিতার সমতুল্য শিক্ষকদের কাছেও নিরাপদ বোধ না করি, তাহলে আমাদের নিরাপত্তাটা কোথায়? আসলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এখন অনেক খারাপ হয়ে গেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ধর্ষণের শিকার নারীর জীবনে ধর্ষণ কখনো শেষ হয় না। নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে সে পরোক্ষ ধর্ষণের শিকার হতে থাকেন। মামলা, তদন্ত, সাক্ষ্য গ্রহণ, বিচার প্রত্যেকটি পর্যায়েই যেন পরোক্ষ ধর্ষণের শিকার হন নারীরা।

চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী ডা. এস এম আয়শা আক্তার বিউটি রাইজিংবিডিকে বলেন, আমাদের দেশে নারী-শিশুকে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলার বিচার অতি দ্রুত হওয়া উচিত। অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে মামলা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে আমাদের আইনপ্রণেতারা ভূমিকা রাখতে পারেন।

মানবাধিকারকর্মী জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী বলেন, এ বিষয়ে পারিবারিক নৈতিক শিক্ষার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মানসম্মত শিক্ষার অভাব সামাজিক অবক্ষয় বেড়ে যাওয়ার জন্য বড় কারণ। 

অন্যদিকে, মেয়েদেরকে দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ না দিয়ে তাকে যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে দেওয়ার মানসিকতার কারণে তাদেরকে শুধু সম্পত্তি ভোগের বা দখলের উপায় মনে করা হয়। এর ফলে যেকোনো কলহের প্রতিশোধ নেওয়ার উপায় হিসেবে নারীর ক্ষতি করার প্রবণতা দেখা যায়। কন্যা সন্তান এবং ছেলে সন্তান সবার জন্য সুশিক্ষার পরিবেশ প্রতিটি পরিবার থেকেই গড়ে তোলা প্রয়োজন। 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম রাইজিংবিডিকে বলেছেন, সম্প্রতি আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম অপরাধ প্রতিরোধে আমাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যারা ভুক্তভোগী, তারা যেন সঠিক বিচার পান। বিচারকার্য যেন দীর্ঘ না হয়। অপরাধীরা যেন কোনোভাবে শক্তিশালী পক্ষ বা ক্ষমতাশালীদের প্রশ্রয় না পায়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ষনের মতো ঘৃণ্যতম অপরাধকে প্রতিরোধ করতে হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল রাইজিংবিডিকে বলেন, ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো বিচারহীনতা। ধর্ষণের যে মামলাগুলো হচ্ছে, তার অধিকাংশ সাথে জড়িত ক্ষমতাশালীরা। তারা মনে করে, তারা বিচারের ঊর্ধ্বে। যদি এখানে বিচার ব্যবস্থা কঠিন হতো, তাহলে এরকম ঘটনা ঘটত না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনার দিকে যদি তাকান, তাহলে কাদের নাম আসবে? এখানে সরকারের দায়িত্ব হলো—অপরাধী যে দলের হোক না কেন, আইনের চোখে সবাই সমান, এটা প্রমাণ করতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষকে নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিবাদ করতে হবে, যাতে এ ধরনের কাজ করতে কেউ সাহস না পায়। 

রায়হান/রফিক


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়