ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আমার দেখা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন || অজয় রায়

অজয় রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমার দেখা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন || অজয় রায়

অধ্যাপক ড. অজয় রায়

আমি একজন সাধারণ ছাত্র ও ভাষা আন্দোলনের পেছনের সারির কর্মী হিসেবে ভাষা অান্দোলনকে কাছ থেকে দেখেছি এবং যথাসক্রিয় অংশ নিয়েছি।

স্মৃতি ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল যখন, তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বয়স ১১-১২ বছর মাত্র। দিনাজপুরের খ্যাতনামা মহারাজা গিরিজানাথ হাই ইংলিশ স্কুলের ছাত্র। পোশাকি নাম ছিল এম জি এন এইচ ই স্কুল। এরপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমার ও আমার মতো অনেকের ছাত্রজীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল ভাষা আন্দোলন।

বস্তুত আমরা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি, যেমনটি আমার বন্ধু যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের বাংলার অধ্যাপক গর্বভরে বলতেন, ‘আমরা ভাষা আন্দোলনের উৎপাদিত সামগ্রী’, কথাটি তিনি ইংরেজিতে বলতেন এভাবে -‘we are the products of the language movement’ । কথাটা অমূলক বা মিথ্যে নয়।

আমার মনে আছে সেই সময় দিনাজপুর শহরে, এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে বি এ ক্লাসে পড়ুয়া দুই ভাই মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও এম আর অখতার মুকুল। আরো মনে পড়ছে সেই সময়কার ছাত্র ফেডারেশনের সেক্রেটারি ছটিভাই, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী আহমেদ আর হাফিজুদ্দিন ভাইয়ের কথা। আর মনে পড়ছে আমার পিতৃবন্ধু তেভাগা আন্দোলনখ্যাত কৃষক নেতা হাজি মুহম্মদ দানেশ। পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে ঢাকায় এলে হাজি মুহম্মদ দানেশ আমার বাসাতেই উঠতেন। মনে পড়ে আরেক কৃষক নেতা গুরুদাস তাকুদারের কথা, তাঁকে আমরা ‘জেঠু’ ডাকতাম। তিনিও ঢাকায় এলে আমার বাসাতেই উঠতেন। ‘ভাষাসৈনিক’ শব্দটি তখনো চালু হয়নি।

যে প্রসঙ্গ নিয়ে এ কথাগুলো বলা হলো, সেটি আগে বলে নিই। ঘটনাটি আমার স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। সালটা মনে হয় ১৯৮২-৮৩। পূর্বপরিচিত সাভারস্থ গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রাণপুরুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনুরোধে সেখানে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল ফিজিক্স বিভাগে প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম এবং মনে হয় ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত ছিলাম। সেই সময় কোনো একদিন সাতসকালে নগর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি গণবিশ্ববিদ্যালয়ের রথের অপেক্ষায়, রথ ও রথচালক জসিম তখনো দৃশ্যমান নয়। সঙ্গে অপেক্ষমাণ  গণমুদ্রণালয়ের প্রধান পুরুষ শফিক খান সাহেব ও তার কন্যা, রসায়নের প্রভাষিকা। কী সূত্র ধরে জানি ১৯৮৫ সালে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ভাষা আন্দোলনে যারা বায়ান্নতে বড় অবদান রেখেছিলেন তাদেরসহ ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে সম্মেলনের কথা বলা হচ্ছিল। শফিক সাহেব গড় গড় করে বলে যাচ্ছিলেন তখনকার কোন কোন বীর নায়করা অংশ নিয়েছিলেন, এবং তাদের লেখা নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। কার বড় ভূমিকা ছিল তা নিয়ে বিতর্ক। বাঙালিদের যা হয় আর কি! 

প্রসঙ্গত, ভাষা মতিন, গাজী ভাই, আহমদ রফিক, ডা. সা্ঈদ হায়দার প্রমুখদের কথা তুললেন শফিক সাহেব।

শফিক সাহেবকে অতি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘আমি তো ১৯৮৫ সালের ওই সম্মেলনে ছিলাম অনেক বড় বড় বীরদের সঙ্গে পেছনের সারির ভাষাকর্মী হিসেবে।’ শফিক সাহেব বোধ হয় কথাটি বিশ্বাস করতে পারেননি, বললেন তাই নাকি? ওর বিশ্বাস জন্মানোর জন্য কী কী হয়েছিল তার কিছুটা বয়ান করলাম আর কে কে এসেছিল তাদের কজনের নাম বললাম। মনে হলো তিনি তুষ্ট হলেন, এবং সাথে সাথেই আমাকে ভাষা আন্দোলনে আমার ভূমিকা নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ জানালেন। এ যৎকিঞ্চিৎ লেখাটির শানে নুজুল হলো এটিই। ফিরে দেখে এখন সত্যিই অবাক হই সেদিনের গণস্বাস্থ্যের ভাষা আন্দোলনের নায়কদের মাঝে আমি কীভাবে আমন্ত্রিত হলাম, ডায়াসেও বসেছিলাম এবং কিছু বক্তব্যও রেখেছিলাম। আমার দিব্যি মনে আছে সে সময় ‘ভাষাসৈনিক’ বলে কোনো শব্দ চালু ছিল না। এ সম্মেলনেই সম্ভবত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মাথাতেই এসেছিল ভাষা আন্দোলনকারীদের ‘ভাষাসৈনিক’ অভিধায় চি‎হিৃত করা হোক। বলতে দ্বিধা নেই মতিন ভাই, গাজী ভাই, সুলতান ভাই, আহমদ রফিকের মতো বীরদের যদি ‘ভাষাসৈনিক’ নামে ডাকা হয় তাহলে আমার মতো পেছনের সারির মফস্বলের পোস্টার ও চিঁকামারা কর্মীদের তো হতে হবে ‘ভাষা পাইক, নিদেনপক্ষে ভাষা-বরকন্দাজ’।

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বড় বড় ভাষা বীরদের সঙ্গে সবাইকে ‘ভাষাসৈনিক’ অভিধায় চিহিৃত করে ব্যাজ ও বাটন পরিয়ে দেওয়া হলো। আমিও পেলাম। সেদিন থেকে ‘ভাষাসৈনিক’ শব্দটি চালু হয়ে গেল। এ জন্য গণস্বাস্থ্য ও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আইডিয়াকে প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু আমি নিজেকে কোনোদিন ভাষাসৈনিক হিসেবে দাবি করিনি, এখনো করি না, ভবিষ্যতেও করব না।

বস্তুত ‘ভাষাসৈনিক’ শব্দটি আমি কখনো পছন্দ করিনি, আজও করি না। পাকিস্তান আমলে এবং এখনো আমরা সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি, সেই আমরাই আমাদের ভাষা আন্দোলনের কীর্তিমান পুরুষদের সম্মান প্রদর্শন করতে চাই সামরিকতন্ত্রের পরিভাষা ব্যবহার করে। আমার বেশ মনে আছে, সেদিনের সম্মেলনেও আমি এ শব্দটি চয়নের বিরোধিতা করেছিলাম।

আমার স্মৃতিতে ‘৪৮’ এর ভাষা আন্দোলন
স্কুলজীবনের ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে শুরু করেছিলাম। সে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মাস ও দিনের কথা স্পষ্ট মনে নেই। আমি মফস্বল শহরের এক নামকরা স্কুলের নগণ্য ছাত্র। ভাষা আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা এসব ভারী  ভারী কথা তখন বুঝতাম না। মনে আছে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের কোনো একদিন বেশ কজন বড় ক্লাসের ছাত্র, সঙ্গে স্থানীয় রিপন কলেজের কয়েকজন ছাত্রনেতা এসে আমাদের নির্দেশ দিলেন যে, ‘আগামীকাল তোমরা ক্লাস বর্জন করবে এবং প্রসেশন করে অমুক জায়গায় আসবে, সেখানে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এর দাবিতে ছাত্রদের সভা হবে।’ আবছা মনে পড়ে কলেজের নেতাদের মধ্যে ছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল এবং বারী ভাই। সম্ভবত, ১৯৪৮ সালে বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিলেন মার্চ মাসে (১১ মার্চ) তারা ধর্মঘট আহ্বান করেছিলেন। পরদিন সত্যি সত্যি কলেজ ছাত্রনেতাদের ডাকে আমরা মাস্টার মশাইদের সামনেই দুঃসাহস নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে শোভাযাত্রাসহ দিনাজপুর জেলা স্কুলের সামনে মিউনিসিপ্যালিটি প্রাঙ্গণে (যতদূর মনে পড়ে) ছাত্রদের জমায়েতে শামিল হলাম। সে জমায়েতে বেশ কজন সিনিয়র ছাত্রনেতা বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আর আমরা মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছিলাম, ‘উর্দু নয়, উর্দু নয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ বক্তাদের মধ্যে এম আর আখতার মুকুল, তার বড় ভাই মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এবং ছাত্র ফেডারেশনের নেতা ছটি ভাইয়ের (নূরুল হুদা কাদের বক্স) কথা মনে আছে। অন্য কেউ বক্তৃতা দিয়ে থাকলেও আজ আর মনে নেই। সে সময়কার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আরো দু-একজন নেতার কথা মনে পড়ল ভাই, হাফিজ ভাই। হাফিজ ভাই পরে মোজাফফর ন্যাপের একজন বড় নেতা হয়েছিলেন।

বস্তুত সেই ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সালে পর্যন্ত দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব ছাত্র ও তরুণ নেতৃত্ব ও পরিচালনা করেন, নির্যাতিত ও কারারুদ্ধ হন তাদের মধ্যে কয়েকজনের কথা এখনো স্মৃতিতে সঞ্চিত। এস এ বারী, ছটি ভাই, আসলেহ ভাই, দবিরুল ইসলাম, হারিসুল ইসলাম, আব্দুল হাফিজ, গোলাম রহমান, তারা ভাই, তোজা ভাই, হেনা ভাই, হিরু ভাই, বাবু ও লাবু প্রমুখ।  তবে আমার বলতে দ্বিধা নেই যে দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন নূরুল হুদা কাদের বক্স ওরফে ছটি ভাই। আমরা পেছনের সারির চিকা মারা কর্মীরা তার নেতৃত্বেই কাজ করেছি। খুব যে কাছে আসতে পেরেছি সে দাবিও করি না।

সে সময় ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার ছাত্রফ্রন্ট ‘ছাত্র ফেডারেশন’ একটি বড় ও তাৎপর্যময় ভূমিকা পালন করেছিল। দিনাজপুরের ছাত্র ফেডারেশন নেতা ছটি ভাইয়ের নেতৃত্বেই আমরা ভাষা আন্দোলনে শামিল হয়েছিলাম। ছিমছাম দীর্ঘদেহী ছটি ভাই চমৎকার বক্তৃতা দিতে পারতেন। প্রবল প্রাণশক্তি ছিল তার। সেদিন থেকেই বুঝে না বুঝে ভাষা অান্দোলনের সঙ্গে কেমন করে জানি সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম একজন কর্মী হিসেবে। আমাদের কাজ ছিল ভাষার কথা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা, মিছিলে শামিল হওয়া এবং পোস্টার লেখা ও চিকা মারা। আর একটি সংগঠন সে সময় ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল তার নাম ‘যুবলীগ’ (এখনকার আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই)। যুবলীগের প্রাণপুরুষ ছিলন পরবর্তীকালে নানা রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি গাজী ভাই।

গাজী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিক থেকে। আমার মনে আছে ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে তিনি দিনাজপুরে এসেছিলেন। তাকে আমরা রেলস্টেশনে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। আমি তখন দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়ন দিনাজপুর শাখা গঠিত হলে আমাকে কলেজ শাখার সহকারী সম্পাদক করা হয়েছিল। এর কিছুদিন পরে দিনাজপুরে সংস্কৃতি সংসদ গঠিত হলে আমি সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন তখন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে সারা দেশব্যাপী। সেই সুবাদে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লাম সাংগাঠনিকভাবেও।                                              

আমার দেখা বায়ান্নর ২১ শে ফেব্রুয়ারি

আগেই বলেছি আমি তখন দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্র। প্রখ্যাত দার্শনিক শহীদ ড. গাবিন্দ চন্দ্র দেব আমাদের অধ্যক্ষ। তিনি ও কলজের অন্যান্য শিক্ষক ছিলেন আমাদের আন্দোলনের নেপথ্যের চালিকাশক্তি ও সহানুভূতিসম্পন্ন। বিপদে মাস্টার মশাইরা আমাদের পাশে দাঁড়াতেন। এমনকি প্রয়োজনে গোপনে নিজেদের বাসায় আশ্রয় দিতেন। আমার দিব্যি মনে আছে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক তারেন্দ্র ভট্টাচার্য প্রকাশ্যেই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। এ জন্য কলেজের গভর্নিংবডির তিরস্কার ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের কুদৃষ্টিতে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি তোয়াক্কা করেননি। আমাদের আন্দোলনের আর একজন সক্রিয় সমর্থক ছিলেন কলেজের ইতিহাসের খণ্ডকালীন শিক্ষক, তেভাগা আন্দোলনের নেতা ও দিনাজপুর বারের সদস্য বাবার অকৃত্রিম বন্ধু স্বনামধন্য হাজি মোহাম্মদ দানেশ। আমাদের পাশে ছিলেন সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে কলেজের প্রিন্সিপাল জ্ঞানতাপস ড. গোবিন্দ দেবসহ কলেজের অনেক শিক্ষক। পদার্থবিদ্যার আমার প্রিয় শিক্ষক ড. রাধেশ শ্যাম ঘোষ, দর্শনের অধ্যাপক প্রিয় সামন্ত স্যার, বাংলার অধ্যাপক রাম নাথ ও মোকাররম স্যার। পেছন থেকে অনেক রাজনীতিবিদ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় সহায়তা করেছিলেন। যেমন ডা. নাইমুদ্দিন আহমেদ, তরুণ অ্যাডভোকেট গোলাম রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, খতিবুদ্দিন চৌধুরী, দুর্গাচরণ রায়, অ্যাডভোকেট বরদা ভূষণ চক্রবর্তী প্রমুখ। তবে এর মধ্যে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী রহিমুদ্দিন উকিল, আমার পিতৃদেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

তবে অমাদের বিরোধীপক্ষ প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতা ও প্রাদেশিক সংসদের সদস্য আবদুল্লাহেল বাকীসহ প্রাদেশিক মন্ত্রী হাসান আলী, ডা. হাফিজউদ্দিন, অ্যাডভোকেট তোজাম্মল আলী, ডা. ওয়াসিমুদ্দিন, অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমদ প্রমুখ কম শক্তিশালী ছিলেন না। সরকারি মদদে এরা সব সময় ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে গেছেন।

আমরা আগেই খবর পেয়েছিলাম যে, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখটি দেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে। জাতীয় রাষ্ট্রভাষা পরিচালনা কমিটি এ সিদ্ধান্ত নেয়।   আমাদের স্থানীয় নেতৃত্বও দিবসটি মিছিল, জনসভা ইত্যাদির মাধ্যমে পালনের বড় কর্মসূচি গ্রহণ করে।

আমাদের শহরে বিশেষ করে ছাত্র মহলে এ দিনটি পালনের তোড়জোড় চলছিল। রাতভর পোস্টার লিখছি, ২১ শে ফেব্রুয়ারির পোস্টারে সয়লাব হয়ে গেছে আমাদের ছোট্ট শহর। আমরা নীরব কর্মীরা হাটবাজার ও দোকানদারদের বোঝাচ্ছি রাষ্ট্রভাষা বাংলার তাৎপর্য ও আবেদন জানাচ্ছি ধর্মঘট পালনের।

আমাদের নেতারা জানালেন যে ওই দিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা বলবৎ করা হয়েছে, যাতে শহরে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ধর্মঘট ও মিটিং মিছিল সমাবেশ না করা যায়। আরো শোনা গেল যে দিনাজপুর শহরেরও নাকি একই উদ্দেশ্যে তা প্রয়োগ করা হবে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের এলাকায় এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজ এলাকায়। বলা বাহুল্য এসব কথা আমাদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল আর ভয়ও যে পাচ্ছিলাম না, তা অস্বীকার করি কীভাবে। ২০ ফেব্রুয়ারির রাত টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কাটল। নেতারা নির্দেশ দিয়েছিলেন যে আমরা যেন পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা থেকে কলেজ প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকি। সকালের দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার কালে মা বললেন, ‘তোদের তো স্ট্রাইক, কলেজে যাওয়া কেন, বাসাতেই থাক।’

বাবা কিছু বললেন না, তবে সাবধান করে দিলেন, ‘পরিস্থিতি ভালো না, অবস্থা বুঝে চলবে।’ আমি দুজনার নির্দেশ মাথায় নিয়ে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে কলেজে উপস্থিত হলাম। নানা স্কুল থেকে ছাত্ররা জমা হয়েছে, বেশ কিছু ছাত্রীও। আসলেহ ভাই জানালেন যে গতকাল নাকি জাতীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে (নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার স্বার্থে) সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলে এসেছে যে, এ ব্যাপারে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে ছাত্র জমায়েতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জাতীয় কমিটি অবশ্য হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল যে ছাত্ররা যদি এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হয়, তাহলে জাতীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কলেজ প্রাঙ্গণে মাইকে চলছে ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে স্লোগান; কর্মীরা দিয়ে চলেছেন অনলবর্ষী বক্তৃতা। আমরা সবাই শঙ্কিত-সচকিত, ঢাকার খবরের জন্য উদগ্রীব।

বেলা প্রায় ৩টার দিকে ঢাকা থেকে খবর এল যে সেখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। ছাত্ররা পুলিশের নিষোধাজ্ঞা অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। প্রাদেশিক সংসদ অভিমুখে মিছিল করেছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল যখন অগ্রসর হচ্ছিল সংসদ ভবনের দিকে, সে সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের ব্যারাকের সামনে পুলিশ ও মিলিটারি ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ছাত্রসহ কয়েকজন নিহত ও বেশ কয়েকজন মিছিলে অংশগ্রহণকারী আহত হন।

আমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লাম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্ররা পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে রাজপথে নেমে এল। সারা শহরে আমরা খণ্ড খণ্ড মিছিল করে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ জানালাম। মুসলিম লীগ ও নূরুল আমীন সরকারের পদত্যাগ দাবি করে স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল ছাত্র ও জনতা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘোষিত হলো যে আগামীকাল (২২ ফেব্রুয়ারি) সারা শহরে ধর্মঘট পালিত হবে। স্কুল-কলেজ, বাজার-দোকান বন্ধ থাকবে। নেতাদের নির্দেশে আমরা মাঠে নেমে গেলাম। নেতারা গোপনে নির্দেশ দিলেন যে, পরিচিত ও প্রথম সারির কর্মীরা যেন কেউ তাদের নিজ নিজ বাসায় রাত না কাটায়। আমি নিকটেই আমার এক মাসির বাসায় দুই রাত কাটালাম।

নেতারা স্থির করলেন যে, আগামীকাল দুপুরে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে একটি মৌন মিছিল শহরের মূল রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে দিনাজপুর মহিলা সমিতির সামনে ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে জনসভায় শেষ হবে। আমরা পরদিন কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিল করে সারা শহর ঘুরে এলাম। মাইকে অনেকটা ধারাবর্ণনার মতো একজন ছাত্রনেতা ভাবগম্ভীর কণ্ঠে চমৎকারভাবে ২১শের বর্ণনা দিয়ে চলছিলেন। তার নামটি ভুলে গেছি। শুধু এটুকু মনে আছে তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র। শহরের নামকরা মোক্তার আফতাব আহমেদ সাহেবের পুত্র।

জনসভা হয়ে উঠল উত্তাল জনতার সমুদ্র। শহরের নামকরা আইনজীবীরা, রাজনীতিবিদরা অনলবর্ষী ভাষায় বক্তৃতা করলেন, জানালেন তীব্র ঘৃণা নূরুল আমীন সরকারের বিরুদ্ধে। ছাত্রনেতারাও বাদ রইলেন না। আমাদের কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক তারেন্দ্র ভট্টাচার্য শুধু বক্তৃতা দিলেন না, শহীদদের উদ্দেশ্যে রচিত একটি কবিতা পাঠ করেও শোনালেন।    

পরদিন ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার আরো বিস্তারিত খবর পেলাম, বেশ কজন শহীদের নামও পাওয়া গেল। কবি হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতার ভাষায় বলি :

আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার
কি আশ্চর্য, কি বিষণ্ন নাম! একসার জ্বলন্ত নাম।।

ছোট্ট শহরটিতে আমাদের প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ দমনে পুলিশ ও প্রশাসন মাঠে নেমে পড়ল। আমরা আর মিটিং মিছিল করতে পারলাম না। নেতাদের নামে হুলিয়া বের হলো। কেউ ধরা পড়লেন, কেউ আত্মগোপন করলেন। বাবা ছিলেন নামকরা আইনজীবী। প্রশাসন তাকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছিল ‘পুত্রকে’ সরে থাকতে। পেছনের সারির অনেক কর্মীকে জেলে ঢোকান হলো। অমার নামেও হুলিয়া বেরিয়েছিল কি না জানা নেই, তবে গোয়েন্দা পুলিশ বেশ কবার বাসায় গিয়ে আমার খোঁজখবর নিয়েছিল। সেদিকটা অবশ্য বাবা ভালোভাবেই সামলেছিলেন। আমি মায়ের নির্দেশে দূরে গ্রামের এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিলাম। এভাবেই দিনাজপুরের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে পর্যুদস্ত করা হলো।

আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে দিনাজপুরের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উপসংহার টানব। আমরা খবর পেলাম যে প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসান আলী খ্যাতনামা মুসলিম লীগ নেতা  (প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি) মওলানা আবদুল্লাহেল বাকীকে নিয়ে পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি জনসভা করার উদ্দেশ্যে দিনাজপুরে আসছেন। আমরা তাদের আগমনকে উপলক্ষ করে তাদের আসার পথে শহরের উত্তর প্রান্তে (চেহেল গাজীর কাছাকাছি) সুবিধাজনক স্থানে কালো পতাকাসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তাদের শহরে ঢুকতে বাধা প্রদান করব। নিঃসন্দেহে একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। আমরা প্রায় ১৫-২০ জন বা তারও বেশি ছাত্র কাল পতাকা নিয়ে বিকেল আড়াইটার দিকে ওই স্থানে দার্জিলিং রোডের দুপাশে অবস্থান নিলাম। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আসলেহ ভাই, সঙ্গে ছিলেন (যতদূর মনে পড়ে) তোজা ভাই, তারা ভাই, মন্টু ভাই, ছটি ভাই ছিলেন কি না মনে পড়ছে না। তখনো তারা ধরা পড়েননি, তবে আত্মগোপন করে আছেন। খবর পেয়ে একদল তৎকালীন ইপিআর জোয়ান প্রায় ৪-৫ ফার্লং দূরে আমাদের বিপরীতে রাইফেল তাক করে অবস্থান নিল। আমাদের হুঁশিয়ার করে শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিল। আমরা শঙ্কিত হলাম, আর একটানা ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ঘটে যায় দিনাজপুর শহরের উত্তর প্রান্তে। ভয় পেলেও আমরা সরলাম না। আসলেহ ভাই আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে মন্ত্রী মহোদয়ের গাড়ি দেখা গেলেই আমরা যেন রাস্তার মাঝে এসে দাঁড়াই। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে আরো কিছু ছাত্র জমায়েত হয়েছেন। প্রায় ৫০ জনের মতো। সংখ্যা বাড়ায় আমরা সাহসী হয়ে উঠলাম। অপেক্ষা করে আছি অতিথিদের সংবর্ধনা দেবার জন্য। পৌনে ৪টার দিকে দূরে দেখা দিল একটি গাড়ি। আমরা মাঝপথে এসে দাঁড়ালাম সবাই, সামনে নেতারা। সেপাইরা রাইফেল তুলে হাটু গেড়ে পজিশন নিল ফায়ার করার। দ্রুত গাড়ি এসে পড়ল, একদল সেপাই আমাদের সামনে ব্যারিকেড রচনা করল। মনে হলো অনতি দূরে গাড়ির গতি শ্লথ হলো, সেপাইদের নেতা গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে আরোহীদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে কী যেন সিদ্ধান্ত নিলেন। দেখলাম জিপের সামনের ৪-৫ জন সেনাবাহিনী সদস্য বন্দুক উঁচিয়ে রয়েছে। আমি ভাবলাম মন্ত্রী মহোদয় বোধ হয় গাড়ি থামিয়ে আমাদের কথা শুনবেন। কিন্তু তা নয়, দেখি হঠাৎ সেপাইদের ব্যারিকেড উঠে গেল আর আমাদের দ্রুত রাস্তা ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিল। মুহূর্তেই অতি দ্রুত গাড়িটি আমাদের দিকে ধাবমান হলো, আমরাও দ্রুত রাস্তার দুপাশে সরে এসে কালো পতাকা নাড়াতে থাকলাম, সঙ্গে স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নূরুল আমিন নিপাত যাক’ ...। মন্ত্রীর গাড়ি মনে হয় ১০০ মাইল বেগে আমাদের অতিক্রম করে গেল। আমাদেরই মন্ত্রী আমাদের মতো ছাত্রদের মুখোমুখি হতে সাহস পেলেন না। পায়ের নিচে যে মাটি সরে আসছে মুসলিম লীগের, সে দিনের ঘটনায় বেশ টের পেলাম। আমরা বিজয়োল্লাসে ফিরে গেলাম যার যার ডেরায়।                       

বেশ কিছুদিন পরে অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে বাসায় ফিরে যথারীতি কলেজে ক্লাস শুরু করলাম। এরপর কলেজের পাঠ চুকিয়ে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম বর্ষ অনার্সের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলাম। পেছনে পড়ে রইল স্মৃতি হয়ে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলন। এরপর থেকে ঢাকায় পরবর্তী ভাষা আন্দোলনের সকল স্তরে অংশগ্রহণ করেছি একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের সদস্যরূপে।

দিনাজপুর শহরে ১৯৫৩ সালে আমরা আর একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতে পারিনি। নেতারা পলাতক অথবা ধৃত। কর্মীরাও তথৈবচ। সঙ্গে ছিল সরকারি দৃঢ়তা। বস্তুত সারা দেশেই তখন থমথম অবস্থা। ঢাকাতেও কোনো কিছু করা সম্ভব হয়নি। তবে এর প্রতিশোধ আমরা নিয়েছিলাম ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। আমরা নিয়েছিলাম এক সংক্ষুব্ধ প্রতিবাদী কর্মসূচি। সে দিনের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা আজও আমার বেশ মনে আছে। তবে সে কথা আজ নয়, বলতে গেলে প্রবন্ধের আকার সীমা ছাড়িয়ে যাবে।

 

 

লেখক: শিক্ষাবিদ

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/ইভা/সাইফ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়