ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ ও বৈশাখ || আহমাদ মাযহার

আহমাদ মাযহার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৩ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রবীন্দ্রনাথ ও বৈশাখ || আহমাদ মাযহার

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপরিক্রমার প্রথম মাস বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথও জন্মেছিলেন বাংলা ১২৬৮ সালের সেই বৈশাখ মাসেই, ২৫ তারিখের রৌদ্রদগ্ধ দিনে। কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁর জন্মবর্ষের বৈশাখ মাস থেকেই বর্ষ গণনা করে এর নাম দিয়েছেন রবীন্দ্রাব্দ। সে হিসেবে ১৫৫টি রবীন্দ্রাব্দ পার হয়ে গেল। এই যে রবীন্দ্রনাথের জন্মের মাসকে বর্ষশুরুর প্রথম মাস ধরে নিয়ে রবীন্দ্রাব্দের কথা ভাবা, এরকম নতুন ভাবে কোনো কিছুকে ধারণা করতে চাওয়া, এও তো তাঁর কাছেই শেখা বাঙালির। এক সময়ের কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে এখন ব্যাপক নগরায়ণ ঘটছে। ফলে রূপান্তর ঘটছে জনজীবনে। কৃষি নির্ভর গ্রামের জীবনও ক্রমশ নাগরিকতায় রূপ নিতে চলেছে। নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালির এই রূপান্তরমুখী সাংস্কৃতিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। সেই সূত্রেই বর্ষবরণের প্রায় প্রতিটি আয়োজনে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়। নববর্ষকে তাই আমাদের স্বাগতঅভিব্যক্তি জানাতে হয় তাঁর ভাষায় ‘তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’ বলে, কামনা করতে হয় ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’, প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হয় ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ বলে। এইভাবে রবীন্দ্রনাথের ভাব আর ভাষায় প্রত্যাশা আর প্রত্যয় ব্যক্ত করে আমরা এগিয়ে চলি সামনের দিকে।

বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি ঋতুর রূপবৈচিত্র্য রবীন্দ্রনাথের মতো করে কে আর এমন গভীর ভাবে অনুভব করেছেন! তিনি তার একটি ঋতুর মধ্যে দেখেছেন ‘বেড়া-ভাঙার মাতম নামে উদ্দাম উল্লাসে’; সেই উল্লাস নিয়েই তিনি দেখতে পান যে ‘বৈশাখি ঝড় আসে’। কেবল ‘উদ্দাম’, ‘উল্লাস’, ‘মাতম’ নিয়েই নয়, বৈশাখ তিনি দেখতে পান যুগপৎ ‘মোহন’ ও ‘ভীষণ বেশে’ও। সুতরাং বৈশাখি ঝড় তাঁর কাছে আশ্বাস হয়েও আসতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর দিব্য চোখে দেখতে পান যে, যুগ যুগান্তর ধরে বাংলাদেশে মধ্যদিনের তপ্ত নিদাঘে পাখির কণ্ঠেও গান স্তব্ধ হয়ে যায়। আবার রৌদ্রদগ্ধ সেই নিস্তব্ধতায়ই দেখতে পান রাখাল বাঁশি বাজায় একাকী। অনুভব করেন মধুরের স্বপ্নাবেশে ধ্যানমগ্ন চোখে প্রান্তর প্রান্তের কোণে বসে ‘রুদ্র’ শোনে রাখালের বাঁশির সুর। এক সময় ধ্যান ভাঙে তার। তৃষাতপ্ত বিরহের নিরুদ্ধ নিশ্বাসে সহসা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে আকাশ। রুদ্ধ সেই বিরহ দীর্ঘশ্বাসই যেন দূরের আকাশ-প্রান্তে গম্ভীর ডমরু ধ্বনিতে বিদ্যুৎছন্দে আসন্ন বৈশাখি ঝড়ে রূপান্তরিত হয়। বৈশাখি ঝড়ের আগমনে জীবনের গতিশীলতা মূর্ত হয়ে ওঠে। বৈশাখকে তিনি তাই দেখেন অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া ‘মৌনী তাপস’ রূপে। তাঁর বুকে দেখতে পান রুদ্রতপের সিদ্ধি। সেই বৈশাখ তাঁর কাছে ধরা দেয় বড় নিষ্ঠুর হয়ে, মৃত্যুক্ষুধার মতো রক্তনয়ন মেলে তাকে তাকাতে দেখেন। কিন্তু এটুকুইতো সব নয়, দেখতে পান  হঠাৎ সেই তারই কণ্ঠে বেজে ওঠে আশার ভাষা। বৈশাখের ধ্বংসলীলা তাই কেবল অনুভব করেন না তিনি। অনুভব করতে পারেন, শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বৈশাখ আসে রাজপুত্রের মতো।

পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেন জন্মদিনের ধারা তাঁকে মৃত্যুদিনের দিকে বহন করে নিয়ে চলেছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি পেছন ফিরে দেখতে পান যে কখনো কখনো তাঁর  দিন এসেছে ম্লান হয়ে, সাধনায় এনেছে নৈরাশ্য, গ্লানিভারে নত হয়েছে মন। ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকিয়ে আরও দেখতে পান ‘জীবনের রণক্ষেত্রে দিকে দিকে জেগে উঠেছিল সংগ্রামের সংঘাত’। একতারা ফেলে দিয়ে তাঁকে তখন হাতে তুলে নিতে হয়েছিল ভেরি। খর মধ্যাহ্নের তাপে ছুটতে গিয়ে পায়ে কাঁটা বিঁধেছে। ক্ষতবক্ষে পড়েছে রক্তধারা। অর্থাৎ দুর্গম বিরোধ-সংক্ষোভে পূর্ণ জীবনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে। সে-সময় তিনি অনুভব করেছেন তাঁর প্রকাশের অনেক কিছু রয়েছে অসমাপ্ত, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও উপেক্ষিত। উত্তর প্রজন্মের কাছে তিনি রেখে গেছেন অন্তরে-বাহিরে সেই ভালো-মন্দ-স্পষ্ট-অস্পষ্ট খ্যাত-অখ্যাত ব্যর্থ-চরিতার্থের জটিল মিশ্রণের মধ্য থেকে যে মূর্তিটুকু বের হয়ে আসে সেটুকু। তার সঙ্গেই রেখে যেতে চান তাঁর আশীর্বাদটুকু।

বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে উন্নয়নের দিকে। কিন্তু তার যাত্রাপথে আজ অনেক প্রতিবন্ধক। বাঙালির অন্তরে আজ যেন নির্মল শুভ্রতার প্রত্যাশা জেগে থাকতে পারছে না তার শক্তিমান সামর্থ্য নিয়ে। মনে হয় বাংলাদেশ যেন কেবল চলছে সেই রকমের উন্নতির পথ ধরে যেখানে উন্নতির আকাঙ্ক্ষা মনুষ্যত্বকে কেবল দহন করেই এগিয়ে চলে; অনুভব করতে পারে না যে, উন্নতি যদি কেবল মানুষের অনুকূল প্রকৃতিকে ধ্বংসের উৎস হয় তাহলে তা তো মানুষকে নিয়ে যাবে ধ্বংসেরই দ্বারপ্রান্তে!

মানুষের হতাশাকে বৈশাখি ঝড়-ঝঞ্ঝা যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে এই স্বপ্ন জাগরূক ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে। বাংলাদেশের বর্তমান এই পরিপ্রেক্ষিতেই রবীন্দ্রনাথের বৈশাখকেন্দ্রী কবিতাগুলোর মর্মবাণী অনুভব করার মধ্য দিয়ে আমাদের অন্তরে জেগে উঠতে পারে সুতীব্র আশাবাদ। আমরা যেন এগিয়ে যেতে পারি রবীন্দ্রনাথের সেই বৈশাখি স্বপ্নের অনুপথে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়