ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু জেনেছিলেন কিন্তু বিশ্বাস করেননি

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫১, ২২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধু জেনেছিলেন কিন্তু বিশ্বাস করেননি

|| তাপস রায় ||

বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিল,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলার মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।

                                                      [হন্তারকদের প্রতি, শহীদ কাদরী]

 

হন্তারকদের প্রতি কবির মনোভাব যতো কঠোর হোক না কেন, রাজনীতির কবি স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের মনোভাব যে একেবারেই সরল বিশ্বাসে পূর্ণ ছিল, সে সময়ের নানা দলিলপত্র এবং প্রতিবেদন সে-কথার সাক্ষ্য দেয়। তিনি জানতেন, তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল বিভিন্ন সময়, তারপরও তিনি কেন ব্যবস্থা নিলেন না? প্রশ্নটি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে আজ অবধি শত, সহস্র বুকের ভেতর বড় বেদনার মতো বাজে। যে বুকে স্পন্দিত হতো মহান এক হৃদয়, তার বিশালতা হেরে গেল গুটিকয় মানুষের ষড়যন্ত্রে- ভাবতে অবাক লাগে বৈকি! যে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সেই কণ্ঠে শেষবারের মতো উচ্চারিত হলো একটি প্রশ্ন; সেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে- ‘তোমরা কী চাও?’ ঘাতকেরা সেদিন বুলেটের গুলিতে দিয়েছিল এই প্রশ্নের উত্তর, যা তাঁর প্রাপ্য ছিল না।

তিনি তো সেই মহানায়ক যিনি বিশ্বাস করতেন, যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারবেন? কেউ তা পারে না। সেই অসাধ্য সাধনে কোনো এক আক্রোশে চেষ্টার ত্রুটি করেনি ঘাতকের দল। যে কারণে সেই ভয়াল রাতে রেহাই পায়নি গর্ভবতী নারী কিংবা শিশু। হত্যা করা হয়েছে পরিবারের সবাইকে। উদ্দেশ্য সমগ্র জাতিকে দুঃস্বপ্নে তাড়িত করে তিমির সময়ে ফিরিয়ে নেয়া। স্বপ্নদ্রষ্টা চলে গেলে কাজটি সহজ হয়ে যায় ঘাতকেরা জানত এ কথা। এই হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং দেশের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত করাও ছিল তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য। এভাবেই সদ্য স্বাধীন একটি দেশের মাথা তুলে দাঁড়াবার সমস্ত পথ রুদ্ধ করতে তারা সেই রাতে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে গিয়েছিল।

যাঁর জন্য ঘাতকের এতো কূটকৌশল সে কথা তিনি জানতেন! গুরুত্ব দেননি। কেন দেননি? এ কথার উত্তর পাওয়া যাবে তাঁরই এক সাক্ষাৎকারে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কী?
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।
সেই সাংবাদিকের পরের প্রশ্ন ছিল- আর সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা?
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি আমার দেশের মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি।

কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে- এ ছিল তাঁর জন্য অচিন্তনীয়। দেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাসের শক্ত ভীত তাঁকে এতটাই আত্মবিশ্বাসী করেছিল যে, কোনো সতর্কবাণীতে তিনি কর্নপাত করেননি। ‘ক্রিটিক্যাল টাইমস, মেমোয়ার্স অব এ সাউথ এশিয়ান ডিপ্লোম্যাট’ বইটি থেকে এর আন্দাজ পাওয়া যায়। বইটির লেখক ফখরুদ্দীন আহমেদ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার বছর পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, সুইডেন থেকে প্রকাশিত পত্রিকার কিছু ক্লিপিংস নিয়ে তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের দুই সপ্তাহ আগে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসন্তোষ এবং কিছু সংখ্যক সেনা কর্মকর্তার সামরিক অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির বিষয়ে লেখা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রতিবেদনের গুরুত্ব না দিয়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ব্যাপারটি দেখতে বলবেন।’

এমন আরেকটি ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘সানডে’ থেকে। পত্রিকাটির ১৯৮৯ সালের এপ্রিল শেষ সংখ্যায় একটি প্রতিবাদপত্র ছাপা হয়। সেখানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান কে কে রাও জানাচ্ছেন, তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আগাম খবর পেয়েছিলেন। বিষয়টি ইন্দিরা গান্ধীকে জানালে তার অনুমতিক্রমে কে কে রাও ১৯৭৪ এর ডিসেম্বরে ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জীবন সংশয়ের কথা জানান। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ওরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। ওরা আমার সন্তানের মতো।

এরপর তিনি কথা না বাড়িয়ে শুধু বলেছিলেন, ঠিক আছে, আমরা পরে এ ব্যাপারে অগ্রগতি সম্পর্কে আপনাকে জানাব। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ এর এপ্রিলে ‘র’-এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা আসেন। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই ষড়যন্ত্রের আপডেট তথ্যসহ আরো বিস্তারিত জানান। দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধু এই সতর্কবাণীও অগ্রাহ্য করেছিলেন। সবচেয়ে বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে জীবন সংশয়ের কথা জেনেও তিনি এতটুকু বিচলিত হননি।

শুধু কে কে রাও নন, লন্ডনে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি বেদ মারওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ওই দিন (১৫ আগস্ট) ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আমি দিল্লিতেই ছিলাম এবং এই খবরটি (বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু) ছিল বেদনাদায়ক। সে দিন আমরা ইন্দিরা গান্ধীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। অবশ্যই গোয়েন্দারা শেখ মুজিবকে আগেই জানিয়েছিলেন যে, তাঁর জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তবে মুজিব ছিলেন খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর ধারণা ছিল, বাংলাদেশের কেউ তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে না। ভারত এবং অন্যান্য দেশের গোয়েন্দারাও তাঁকে এই ঝুঁকির কথা বলেছিলেন।’

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের তথ্য অধিকার আইনের আওতায় ২৫ বছর উত্তীর্ণ সরকারি দলিল শর্ত সাপেক্ষে প্রকাশ করে। তেমনই একটি দলিল থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিল। বিশেষ করে মার্কিন সরকারের তৎকালীন দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফ্রেড আথারটন হেনরি কিসিঞ্জারকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই বলেন, তারা শেখ মুজিবকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি  (শেখ মুজিব) তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। বলেন, তার সঙ্গে এমন কিছু কেউ করতে পারবে না।

দেশের মানুষের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয়া এই আত্মবিশ্বাস বঙ্গবন্ধুকে সেদিন সাবধান হতে দেয়নি। রাজনৈতিক জীবনে অনেক বার তিনি মৃত্যু সম্মুখে দেখেছেন। জেলখানায় বন্দি অবস্থায় দেখেছেন সেলের পাশে তাঁর জন্য কবর খোড়া হচ্ছে। তখন শুধু বলেছেন, ‘আমার লাশটা যেন বাংলাদেশের মাটিতে শেষ আশ্রয় পায়।’

কখনও দৃঢ়তা দেখিয়ে, কখনও সাবধান হয়ে সম্ভাব্য মৃত্যু এড়িয়েছেন। সেই কাল ছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের কাল। স্বাধীন বাংলায় তিনি এমন মৃত্যুচিন্তা মনে ঠাঁই দেননি।
এ বছর প্রকাশিত হলো ‘কারাগারের রোজনামচা’। বঙ্গবন্ধু সেখানে লিখেছেন: ‘আমাকে সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে মেস এরিয়ার বাইরে একটা রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। একজন অফিসার আমার সঙ্গে হাঁটত। আর দু’জন মিলিটারী রাস্তার দুইদিকে পাহারা দিত। কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারত না। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতো। কয়েকদিন বেড়াবার পর আমার একটু সন্দেহ হলো। মেস এরিয়ার মধ্যে এতো জায়গা থাকতে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেওয়া হচ্ছে কেন?

দু’একজনের ভাবসাবও ভালো মনে হচ্ছিল না। একটা খবর আমিও পেলাম। কেহ কেহ ষড়যন্ত্র করছে আমাকে হত্যা করতে। আমাকে পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তারপর বলা হবে পালাতে চেষ্টা করেছিলাম, তাই পাহারাদার গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। ... আমি যে ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পেরেছি এটা কাহাকেও বুঝতে না দিয়ে বললাম, এরিয়ার বাইরে বেড়াতে যাব না। আমি ভেতরেই বেড়াব।’

এভাবে সতর্ক হয়ে বঙ্গবন্ধু সেবার মৃত্যু এড়িয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্তরীন এটি সে সময়ের ঘটনা। ভাবা যায়! পাকিস্তানিরা যাঁকে এভাবে চেষ্টা করেও মারতে পারেনি; একাত্তরে মারার সাহস করেনি, সেই তাঁকেই কিনা জীবন দিতে হলো স্বাধীন দেশে যাদের তিনি সন্তানতুল্য মনে করতেন তাদের হাতে। অকৃতজ্ঞের হাতে এমন মৃত্যু কে কবে ভুলে গিয়েছে? স্বদেশ তাঁকে ভোলেনি। কাল তাঁকে দিয়েছে মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার স্বীকৃতি। ঘাতকের সাধ্য কি সেখান থেকে জীবন কেড়ে নেয়। তারা শুধু পেরেছে সিঁড়ির ঠিক তিনটি ধাপ নিচে তাঁর নিথর দেহটিকে লুটিয়ে দিতে। মাথা তাঁর ওপরেই ছিল স্থির, উন্নত। ঘাতকের বুলেটে উড়ে গিয়েছিল সেই তর্জনী! যে তর্জনী উঁচিয়ে একদিন তিনি দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, আর যদি একটা গুলি চলে ...।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়