ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

একুশের যা কিছু প্রথম

আফরিন শাহনাজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একুশের যা কিছু প্রথম

আফরিন শাহনাজ : ভাষা আন্দোলন আমাদের চেতনার ইতিহাস। ভাষার অধিকার আদায়ের সেই রাজপথ রঞ্জিত করা ইতিহাস এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের একুশ এখন বিশ্বের। কিন্তু কেমন ছিল একুশের প্রথম প্রহর। কিংবা একুশের সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গে প্রথম যে বারুদের সংযোজন কেমন ছিল সেই বিদ্রোহের অনুষঙ্গ। সেইসব প্রথম নিয়েই এই লেখা।

প্রথম লিফলেট : ভাষা আন্দোলনের প্রথম লিফলেট প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। লিফলেটটির আকার ছিল প্লেট অনুযায়ী ১/১৬। গুলি বর্ষণের অল্প কিছুক্ষণ পরই হাসান হাফিজুর রহমান, আমীর আলীসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উল্টোদিকে ক্যাপিটাল প্রেসে চলে যান। সেখানে গিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান লিফলেটের খসড়া তৈরি করেন। দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই ‘মন্ত্রী মফিজউদ্দীনের আদেশে গুলি’ শীর্ষক লিফলেটটি ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়। হাসান হাফিজুর রহমান লিফলেটটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসেন। প্রায় দুই/তিন হাজার লিফলেট ছাপানো হয়েছিল। উৎসাহী ছাত্ররাই এ লিফলেটগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। চকবাজার, নাজিরা বাজার এবং ঢাকার অন্য সব এলাকাতেও লিফলেটগুলো কর্মীদের মাধ্যমে ঐদিনই ছড়িয়ে দেয়া হয়।

প্রথম কবিতা : একুশের প্রথম কবিতার জনক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলি বর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনিই প্রথম কবিতা লেখেন। তিনি সে সময় চট্টগ্রামে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক দুদিন আগে হঠাৎ তিনি জলবসন্তে আক্রান্ত হন। ফলে একুশ এবং তৎপরবর্তী সময়ের উত্তাল আন্দোলনে তিনি অংশ নিতে পারেননি। সেই বিঃক্ষুব্ধ মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কবিতার মাধ্যমে।

মাহবুব-উল-আলম রচিত ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শীর্ষক কবিতাটি ভাষা-আন্দোলন তথা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বিশাল জনসভায় ৫০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে কবিতাটি পাঠ করেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতাটি প্রকাশের সাথে সাথে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। কবিতাটি মুদ্রণের দায়ে প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ, লেখক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ও জনসভায় এর প্রথম পাঠক চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং মুদ্রক দবির আহমেদ চৌধুরীর নামে হুলিয়া জারি হয় এবং পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।

প্রথম কবিতা সংকলন : ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে  কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় একুশের কবিতার সংকলন। সংকলনটির নাম ছিল ‘ওরা প্রাণ দিল’। এটি ২০ বি, বালিগঞ্জ স্টেশন রোড, কলকাতা-১৯৬ থেকে বেনু প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত। বিশ পৃষ্ঠার এ সংকলনটির প্রকাশক-শিবব্রত সেন। এছাড়া সংকলনটিতে লেখা ছিল সম্পাদনা-সহকর্মী, প্রচ্ছদ: গণ-আন্দোলনের অংশীদার জনৈক শিল্পী । এদের নাম গোপন করা হয়েছিল নিরাপত্তার কারণে। প্রচ্ছদে ছিল কাঠের খোদাই করা একটি উডকাট চিত্র। তাতে লেখা ছিল, ‘বাংলা ভাষার কণ্ঠ রোধ করা চলবে না।’ নিরাপত্তার কারণে প্রচ্ছদ শিরোনাম নাম উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু প্রচ্ছদ একেঁছিলেন ভারতের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সোমনাথ হুড়। যে ৭টি কবিতা স্থান পেয়েছিল সেগুলো হলো: শহীদ বাংলা- বিমল চন্দ্র ঘোষ, জন্মভূমি-সৈয়দ আবুল হুদা, ঢাকার ডাক-হেমাঙ্গ বিশ্বাস, পারবে না- মুর্তজা বশীর, জননী গো- নিত্য বসু, বন্ধুর খোঁজে- তানিয়া বেগম, প্রিয় বন্ধু আমার- সহকর্মী (প্রমথ নন্দী)

প্রথম ক্রোড়পত্র অঙ্কিত চিত্র বা স্কেচ : ২১ ফেব্রুয়ারির পরের দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম ক্রোড়পত্র এবং প্রথম অঙ্কিত চিত্র। ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন তৎকালীন ‘দিলরুবা’ পত্রিকার প্রকাশক এবং এতে স্কেচ আঁকেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম আর লেখেন ফয়েজ আহমদ এবং আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন। বিকেল পাঁচটার মধ্যে কাগজ ছাপা হয়ে যায় এবং পত্রিকার কর্মীরাই রাজপথে কাগজগুলো বিলি করেন। সেদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ ছিল বলে ৬টার  আগেই হাতে হাতে কাগজ বিলি করা হয়ে যায়।

একুশের প্রথম ছাপচিত্র : প্রথম ছাপচিত্র অঙ্কন করেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী, বায়ান্নর ভাষাকর্মী মুর্তজা বশীর। ছাপচিত্রটির শিরোনাম হলো ‘রক্তাক্ত একুশে’। মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্রহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। শহীদ বরকতের রক্তে তার সাদা রুমাল রঞ্জিত হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আঁকা তাঁর এই ছাপচিত্রটিতে তিনি একুশের ঘটনা অঙ্কিত করেছেন। একজন গুলিবিদ্ধ ছাত্রনেতাকে একেঁছেন যিনি মিছিলে গুলি বর্ষণের ফলে পড়ে যান, তার স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ডটি পড়ে যায় এবং তার হাতে থাকা বইটিও মাটিতে পড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়।

একুশের প্রথম গান : একুশের প্রথম গান রচনা করেন ভাষাসৈনিক আ.ন.ম. গাজীউল হক। গানটির প্রথম লাইন: ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না...’ ভাষা-আন্দোলনের সুচনার গান হিসেবে এটি সে সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং আন্দোলনের মহা অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। গানটির সুর দেয়া হয়েছিল হিন্দি গান ‘দূর হাটো, দূর হাটো, ঐ দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হায়’ এর অনুকরণে।

একুশের হত্যাকাণ্ডের পর গাজীউল হকের এই গানটি ছিল ভাষাকর্মীদের প্রেরণার মন্ত্র। শুধু রাজপথের আন্দোলনে নয়, জেলখানায় রাজবন্দিদের দুঃখ কষ্ট নিবারণে এবং তাদের মনোবল চাঙ্গা করতে এই গান ছিল প্রধান হাতিয়ার। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকীতে আরমানিটোলার ময়দানে আয়োজিত জনসভায় গানটি প্রথম গাওয়া হয়।

প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। জাতিসংঘের ১৮৮টি দেশ একসঙ্গে প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। এর আগে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে  দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের  ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্রস্তাবটির খসড়া পেশ করে। বাংলাদেশকে সমর্থন জানায় ২৭টি দেশ। দেশগুলো হলো সৌদি আরব, ওমান, বেনিন, শ্রীলঙ্কা, মিশর, রাশিয়া, বাহামা, ডেমিনিকান প্রজাতন্ত্র, বেলারুশ, ফিলিপাইন, কোতে দি আইভরি, ভারত, হুন্ডুরাস, গাম্বিয়া, মাইক্রোনেশিয় ফেডারেশন, ভানুয়াতু, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, কমোরো দ্বিপপুঞ্জ, পাকিস্তান, ইরান, লিথুনিয়া, ইতালি, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, স্লোভাকিয়া ও প্যারাগুয়ে। ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাভাষাসহ বিশ্বের চার হাজার ভাষা সম্মানিত হয়।

তথ্যসূত্র :
১. রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম, এম আর মাহবুব, সূচীপত্র, ২০০৯
২. দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর, ১৯৯৯ ও ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০০




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়