ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বীথির হাসিমুখ, আমাদের প্রত্যাশা

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৬ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বীথির হাসিমুখ, আমাদের প্রত্যাশা

বীথির পাশে লেখক

এস এম জাহিদ হাসান : পৌষের রোদমাখা দিন। প্রকৃতির এ সময় অন্যরূপ- স্নিগ্ধ, কোমল, সতেজ, রঙিন। ঢাকা-টাঙ্গাইল হাইওয়ে রোডের পাশে সর্ষে ক্ষেতের হলুদ রং দিগন্ত ছুঁয়েছে। সেদিকে তাকালে মন জুড়িয়ে যায়। কুয়াশা দূরে-বহুদূরে আকাশ থেকে যেন ঝুলিয়ে দিয়েছে ধূসর রঙের চাদর। হাতছানি দিয়ে ডাকে অতীত। শৈশব, কৈশরের কথাগুলো মনে পড়ে। নান রঙের দিনগুলো মনের কুঠিতে উঁকি দেয়।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই- আমাদের গ্রামগুলো বদলে গেছে। নাগরিক অনেক সুবিধা এখন গ্রামে বসেই পাওয়া যায়। বদলে গেছে গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপন চিত্র। ষষ্ঠঋতুর নিজস্ব যে বৈশিষ্ট্য তাও অনেকটা আর বোঝা যায় না। ব্যতিক্রম শুধু বর্ষা এবং এই শীত মৌসুম।

নীল নবঘনে আষাঢ় গগণের সেই অঝোর ধারা এখন ভাদ্র-আশ্বিনেও দেখা যায়। শরৎ শেষে হেমন্তের শুরুতেও বর্ষা তার উপস্থিতি জানান দেয়। এরপর আসে শীত। রাজধানী ঢাকায় শীত আসে অতিথির মতো। মাত্র ক’দিনের হিমেল পরশ বুলিয়ে দিয়ে সে চলে যায়। শীতের প্রকৃত আমেজ সেখানে ধরা পড়ে না। অথচ গ্রামে শীতের প্রকৃতি একেবারেই অন্যরকম। আমাদের গ্রামগুলোতে শীত আসে জানান দিয়ে। হেমন্ত শেষে হতে না হতেই শীতের সকল বৈশিষ্ট্য প্রকৃতিতে প্রকাশ পেতে থাকে। ষড়ঋতুর এমন বৈচিত্র আর কোনো দেশের প্রকৃতিতে খুব একটা দেখা যায় না।   

গাড়িতে যেতে যেতে এমন অনেক কথা মনে পড়ছিল। নাগরপুর উপজেলার মাহমুদনগর বাজারে আসতেই ড্রাইভারের কথায় হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ল।

‘স্যার ওটা বীথি না?’ ড্রাইভারের কণ্ঠ শুনে সেদিকে তাকালাম। মনে হলো সত্যিই তাই। আমি দ্রুত ওকে গাড়ি ঘোরাতে বললাম। সত্যি বলতে বীথির সঙ্গে এখানে দেখা হবে ভাবিনি। তার আগে প্রিয় পাঠক, আপনার সঙ্গে বীথির পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডি ডটকম-এ ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল: ‘বীথির অস্ত্রোপচার চলতি মাসেই, প্রয়োজন দুই লাখ টাকা’। এই শিরোনামের সূত্র ধরেই বীথির সঙ্গে আমাদের পরিচয়। বীথি এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিল। সে দুরারোগ্য জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত। সংবাদমাধ্যম এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যা জানলাম তাতে মন ভারাক্রান্ত হলো। কতই আর বয়স! এই সময় বীথির সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা করে বেড়ে ওঠার কথা। হাসি-আনন্দে সব সময় মেতে থাকার কথা। অথচ মেয়েটি হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী।

বীথি হাসপাতালে ডায়াবেটিক ও হরমোন বিভাগে ভর্তি ছিল। মুখে দাড়ি-গোঁফসহ সারা শরীরে অসংখ্য লোম নিয়ে জন্মেছিল সে। বয়স যত বাড়ছিল সেই সঙ্গে হরমোনের প্রভাবে তার স্তনের আকার অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা! বীথির দাঁতগুলোও পরে যায়। যা পরবর্তী সময়ে আর গজায়নি। বীথি সাজতে পছন্দ করত। অথচ ছোট্ট বীথির জীবন ক্রমেই হয়ে উঠেছিল বিবর্ণ।
 


দরিদ্র বাবা-মায়ের সন্তান হওয়ায় বীথির যথাযোগ্য চিকিৎসা হয়নি। কিন্তু এক পর্যায়ে বাবা আবদুর রাজ্জাক স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে ওকে ঢাকা নিয়ে আসে। ভর্তি করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিরল রোগ হওয়ায় বীথি দ্রুত সংবাদের শিরোনাম হয়। রাইজিংবিডি প্রথম বীথির সংবাদটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, এই নিউজ পোর্টালটি পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানবিক বিবেচনায় বীথির সংবাদ ফলো-আপ করতে থাকে। ফলে দেশবাসীর কাছে বীথি খুব দ্রুত পরিচিত হয়ে ওঠে। 

এমতাবস্থায় আমরা জানতে পারি, বীথির চিকিৎসার জন্য ১২ লাখ টাকা প্রয়োজন। চিকিৎসকরা আশ্বাস দিয়েছিলেন অপারেশনের টাকা তারা নেবেন না। কিন্তু অপারেশন পরবর্তী চিকিৎসা খরচও তো কম নয়। বীথির বাবার পক্ষে সেই টাকা সংগ্রহ করা ছিল অসম্ভব। আমরা তখন রাইজিংবিডির মাধ্যমে বীথির পরিবার এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম। বীথির যন্ত্রণাকাতর অথচ মায়াময় মুখ, দরিদ্র বাবা-মায়ের অসহায়ত্ব, আহাজারীতে হাসপাতালের পরিবেশ ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছিল। দেশের মানুষও বীথির জন্য বসেছিলেন প্রার্থনায়।

বীথির জীবনের এমন এক ক্রান্তি লগ্নে আশার আলো হয়ে দেখা দেয় ওয়ালটন। দেশের শীর্ষস্থানীয় ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী এই প্রতিষ্ঠানটি বীথির জীবনের আলো ফিরিয়ে দিতে তার পাশে দাঁড়ায়। আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এরপর বীথির চিকিৎসার পথে আর কোনো বাধা থাকে না। প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে আমি নিজে উপস্থিত থেকে চেকটি বীথির বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এমন একটি মহৎ কাজে জড়িত হতে পেরে সেদিন সত্যি খুব ভালো লেগেছিল। প্রাণ ভরে দোয়া করেছিলাম ছোট্ট বীথির জন্য।

চিকিৎসা শেষ করে বীথি ফিরে গিয়েছিল তার গ্রামের বাড়ি। সেই বীথির সঙ্গে আজ প্রায় দু’বছর পর দেখা। গাড়ি থেকে নেমে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বীথির সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো। কথাপ্রসঙ্গে জানলাম আগের চেয়ে ও অনেকটাই সুস্থ। শরীরের লোম অনেকটাই কমে এসেছে। অন্যান্য যে অসুবিধাগুলো ছিল সেগুলো নেই। শুনে মনটা ভালো হয়ে গেল।

বীথি চাচাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিল। সঙ্গে তার চাচীও ছিল। এটা সত্যি আনন্দের যে, বীথি যখন অসুস্থ ছিল তখন সে লোকলজ্জার ভয়ে ঘর থেকে বের হতো না। সামাজিকভাবেও সে ছিল অসহায়। আজ সেই অসহায়ত্ব ঘুঁচে গেছে। বীথি অন্য দশজনের মতো সমাজের সবার সঙ্গে খোলা মনে মিশতে পারছে। কিন্তু আরো বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বীথি এখন আগের মতোই স্কুলে যাচ্ছে। মাঝখানে ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে আবার পড়াশোনা শুরু করেছে। গত ১ জানুয়ারি দেশজুড়ে বই উৎসব হয়েছে। এই উৎসবে বীথি সামিল হয়েছিল। সে নতুন বই পেয়েছে। বীথির মুখে পুনরায় হাসি ফুটে উঠেছে।

এই হাসির জন্যই তো এদেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল। শত্রুকে পরাজিত করে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। বীথিরা হাসিমুখে স্কুলে যাবে, স্বাধীন দেশে ওরা ওদের স্বপ্ন নিজেদের মতো করে পূরণ করবে- এতটুকুই শুধু চাওয়া।

ছায়া হয়ে, মায়া দিয়ে, বীথিদের পাশে বারবারই দাঁড়াতে চাই আমরা। নাগরপুরের জয়ভোগ গ্রামের বীথির মুখে আজ যে হাসি ফুটে উঠেছে, সেই হাসি অটুট থাকুক তার ভবিষ্যত জীবনেও।

লেখক: প্রকাশক, রাইজিংবিডি ডটকম




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জানুয়ারি ২০১৯/তারা/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়