ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গানের বুলবুল এবং তার প্রতি অন্যায়

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গানের বুলবুল এবং তার প্রতি অন্যায়

রাহাত সাইফুল : মৃত্যুর পর কফিনে মোড়ানো লাশ যখন পড়ে থাকে তখন সারিবদ্ধভাবে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। নির্বাক আপনজন ছলছল চোখে স্মৃতিচারণ করেন। কত কথা মনে পড়ে। সবই তখন দূর অতীত বলে মনে হয়। অন্যদিকে এমন শোকের ক্ষণে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে (লোক দেখানো) স্মৃতিচারণ করেন কেউ কেউ। এদের অনেককেই জীবিত থাকা অবস্থায় মৃত ব্যক্তির গুণকীর্তন করতে দেখা যায় না। এত সম্মান আর গুণকীর্তন জীবদ্দশায় কোনো ব্যক্তি দেখে যেতে পারলে তিনি হয়তো মৃত্যুর আগে এতটা কষ্ট বা হতাশায় ভুগতেন না। জীবিত থাকাবস্থায় জীবনের শেষ দিনগুলোতে সহকর্মীর খোঁজ অনেকেই রাখেন না, বা প্রয়োজন বোধ করেন না। অনেকে সহকর্মীর মৃত্যুর পর শেষ দেখাটাও দেখার সময় করে উঠতে পারেন না। এরাই আবার ক্যামেরার সামনে সেই সহকর্মীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন। তার গুণগানে মেতে ওঠেন।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অধিকাংশ মানুষ জীবনের মধ্যগগণে রমরমা সময় পার করলেও জীবন সায়াহ্নে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। গত ২৩ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা, বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল না ফেরার দেশে চলে যান। জীবদ্দশায় নিজের গানের মালিকানা পাননি দেশবরেণ্য এই সুরকার, গীতিকার। তার গানের শিল্পীদের অসহযোগিতার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। তিনি নিজে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সেইসব শিল্পীর নাম বলে গেছেন। তাদের অনেকেই বুলবুলের গান গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তারা টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সেইসব গানের স্মৃতিচারণ করেছেন। বলেছেন এর পেছনে বুলবুল ভাইয়ের কৃতিত্বের কথা। অথচ এই শিল্পীদের অনেকেই বুলবুল ভাই জীবিত থাকা অবস্থায় তাকে একবারের জন্যও দেখতে যাননি। এমনকি অসংখ্যবার ফোন করেও তাদের সাক্ষাৎ পাননি গানের এই কিংবদন্তি।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তার লেখা ও সুর করা কালজয়ী গানগুলোর কপিরাইট করে যেতে পারেননি। মৃত্যুর আগে আমার নেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব শিল্পীদের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন: ‘১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কয়টা গানের কপিরাইট আছে? আমার এতগুলো গানের মধ্যে একটারও কপিরাইট নেই। আমার গান নিয়ে যুদ্ধ করার মতো অস্ত্র আমার কাছে নেই। কপিরাইটের পেপার যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাছে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত যে কোনো মানুষই আমার গান নিয়ে যেতে পারবেন। কেন কপিরাইট করতে পারিনি এই দোষ শুধু আমার একার নয়। আমার গানের গীতিকার ও সুরকার তো আমিই। আমি এগিয়ে এলেও শিল্পীরা এগিয়ে আসেনি। আমাদের সমন্বয়ের এতো অভাব যে, কপিরাইট করতে পারছি না। আমরা যারা সুর করি, গান লিখি তাদের অধিকারটা খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। শিল্পীরা গান গেয়ে অনেক পয়সা পায়। আমরা যারা সুর করি ও লিখি তারা কিন্তু লাভবান হই না।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লেখা ও সুর করা গান গেয়ে দেশে-বিদেশে জনপ্রিয় শিল্পী হয়েছেন অনেকে। তাদের একটা স্বাক্ষরে এসব জনপ্রিয় গানের মালিকানা পেতেন এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। অথচ কেউ এগিয়ে আসেনি। এখন কেন তাদের এই দুঃখভরা স্মৃতিচারণ? লাশের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কেন এত সমবেদনা? কারণ তারা জানেন এই লাশ স্বাক্ষর চাইবে না। তাই আজ তারা নির্ভার। কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে ভক্তদের মিথ্যে চোখের জল দেখাচ্ছেন! একটি গানের কপিরাইট করতে তিনজনের স্বাক্ষর প্রয়োজন। গীতিকার-সুরকার-শিল্পী। এই তিনজনের মধ্যে দুটিই ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তিনের মধ্যে দুই হওয়া সত্ত্বেও জীবদ্দশায় তার কালজয়ী গানগুলোর মালিকানা তিনি পাননি। তিনি এজন্য মামলা করেছিলেন কিন্তু লাভ হয়নি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে এসব গানের মালিক এখন কে হবেন? শুধুই কি শিল্পী? হয়তো কোনো একসময় শিল্পী নিজের নামে গানটির কপিরাইট করে নেবেন। এমন যারা ভাবছেন তাদের বলি- কাজটি সহজ হবে না। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক। ফলে তার সঙ্গে এই প্রতারণা করে পার পাওয়া যাবে না। তার জীবদ্দশায় কপিরাইট করার জন্য তিনি ডাকলেও যারা সাড়া দেননি তারা খুব অন্যায় করেছেন। সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা সেদিন যদি সহযোগিতার হাত বাড়াতেন তবে এই কালজয়ী গানগুলোর মালিকানা দেখে যেতে পারতেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

শুধু সদ্যপ্রয়াত এই কিংবদন্তি নন, জীবিত অবস্থায় অনেক শিল্পী, সুরকার, গীতিকার তার প্রাপ্য পান না। অনেক শিল্পী তার জনপ্রিয় গানের রেমুনেশন না পেয়ে শেষ বয়সে অর্থাভাবে মানবেতর জীবন যাপন করে মৃত্যুবরণ করেছেন। এমন নজির এ দেশে কম নেই। মৃত্যুর পর শুভাকাঙ্ক্ষির বেশে শ্রদ্ধা না জানিয়ে জীবিত থাকা অবস্থায় গুণীদের সম্মান ও কদর করা উচিৎ। তাদের প্রাপ্যটুকু জীবদ্দশাতেই বুঝিয়ে দেয়া নৈতিক দায়িত্ব।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৯/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়