ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কাগজবিহীন বিদ্যালয় পরিদর্শন যুগান্তকারী পদক্ষেপ

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাগজবিহীন বিদ্যালয় পরিদর্শন যুগান্তকারী পদক্ষেপ

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার বাস্তবতা হচ্ছে অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না। অনেক কারণের মধ্যে এখানে আকর্ষণীয় কিছু করানো হয় না এবং এখানকার শিক্ষার মান তলানীতে গিয়ে পৌঁছেছে বলে মনে করা হয়। আর একটি সমস্যা হচ্ছে ৯৫ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। নেই সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাগণ মনিটরিং করেন এবং সুপারভাইজ করেন যা সার্পোটিভ সুপারভিশন নয়। তাদের কাজ সুচারু মনিটরিং, সমন্বয় সাধন, স্থানীয় উদ্যোগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ, উদ্বুদ্ধকরণ ও মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ। সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিটি ধাপ পর্যবেক্ষণ, রেকর্ড সংরক্ষণ, অভিভাবক সমাবেশ, এসএমসির সদস্যদের নিয়ে সভা, সমস্যানিরুপণ-সমাধান, শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে যথাযথ রিপোটিং করা শিক্ষা অফিসারের দায়িত্ব। কোমলমতি শিশুদের ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করা, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর। কিন্তু কীভাবে তা করা সম্ভব?

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার গত পাঁচ বছরের ফলে দেখা যায় ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত  সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট পাচ্ছে হাইস্কুল সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো যা ৪০-৪৪ শতাংশ, কিন্ডারগার্টেনে ২২-২৪ শতাংশ এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে  ২.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফল ভালো করার একটি কারণ হতে পারে উচ্চ বিদ্যালয়ে যে শিক্ষকগণ ক্লাস পরিচালনা করেন, তারাই আবার প্রাথমিকেও ক্লাস পরিচালনা করেন। ফলে, তাদের শেখানোর মান স্বভাবতই অন্যান্য শিক্ষকদের চেয়ে উন্নত। ফলাফল তাই বলে দিচ্ছে। নতুন করে জাতীয়করণ করা বিদ্যালয়সমূহে এই হার ১.৯৬ শতাংশ। নতুন প্রতিষ্ঠিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই সার্বিক পাসের হার ২০১৭ সালে হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনের তুলনায় যথাক্রমে ৫.৬৯ শতাংশ ও ৫.৬৫শতাংশ কম। এসব কারণে অভিভাবকগণ সন্তানদের অর্থ খরচ করেও কিন্ডারগার্টেনে পাঠিয়ে থাকেন।

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেগুলোর সাথে আমরা কমবেশি পরিচিত। কিন্তু শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটছে না। নতুনভাবে শিক্ষক নিয়োগ ছাড়াও প্রচলিত শিক্ষকদের ক্লাস কি রকম হচ্ছে, বিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে যাতে তাড়াতাড়ি জানা যায় সেজন্য প্রয়োজন কার্যকরী মনিটরিং। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন ব্যবস্থা ডিজিটাল ই-মনিটরিং সিস্টেম নামে একটি নতুন ব্যবস্থার প্রণয়ন করেছে । সনাতন পদ্ধতিতে বিদ্যালয় পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় অনেক তথ্য বিভ্রাট ঘটে। তাছাড়া কাগজে কলমে এগুলো ইচ্ছেমতো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যায়। ফলে সঠিক চিত্রটি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছায় না। এ সমস্যা কাটাতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিদ্যালয় পরিদর্শন ও তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তাতে সহায়তা করছে সেভ দ্য চিলড্রেন, বাংলাদেশ। আমরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। জানা যায়, চলতি মাস থেকে দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এ পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবে। ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম সংগ্রহেরও সুযোগ পাবে। দেশব্যাপী কাগজবিহীন স্কুল পরিদর্শন ব্যবস্থা ই-মনিটরিং বাস্তবায়নে অধিদপ্তর ৩৭২০টি ট্যাব ক্রয় করেছে। ই-মনিটরিং কাজে ব্যবহারের জন্য সেগুলো দেশব্যাপী মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে বিতরণও করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার হাজারো সমস্যার মধ্যে এটি একটি আনন্দের সংবাদ বলা যায়। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণ যে টুল ব্যবহার করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করেন, তার উপর ভিত্তি করেই এ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক ই-মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে। ই-মনিটরিং সিস্টেমে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাগণ স্মার্টফোন বা ট্যাব ব্যবহার করে বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণের তাৎক্ষণিক তথ্য (রিয়েল টাইম ডেটা) সংগ্রহ করেন। স্কুল পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ এবং পর্যবেক্ষণের গুণগত ও পরিমানগত উভয় বিশ্লেষণ প্রধান শিক্ষক ও বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরের কর্মকর্তাদের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ওয়েবভিত্তিক ড্যাশবোর্ডে  www.dpe.gov.bd সহজলভ্য হয়। সার্ভারে তথ্য আপলোড করার সাথে সাথে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ তা পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায়। ২০১৫ সালে গাজীপুর ও মানিকগঞ্জের ৫টি উপজেলায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে ই-মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আরো ৮০টি উপজেলায় ই-মনিটরিং ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য ৬৪ জেলা থেকে তৈরি করা হয়েছে মাষ্টার ট্রেইনার। এ ছাড়া ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটির ১২টি থানার শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ঘোষণার মাধ্যমে ২০১৮ সালের মে মাসে এসব থানা পেপারলেস মনিটরিং এলাকায় পরিণত হয়। এই ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম এমন একটি পদ্ধতি যা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা কর্মকর্তাগণকে দক্ষ, কার্যকরী ও স্বচ্ছতার সাথে স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহের সুযোগ করে দিবে। এই কার্যক্রমটি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সময় ও পেপার ওয়ার্ক কমাবে। এই সিস্টেম শিক্ষার নীতি নির্ধারকদের আরো সহজে অগ্রাধিকার শনাক্তকরণ, শিক্ষা বিভাগের কর্মক্ষমতা নিরীক্ষণ এবং কার্যকরভাবে কোন নির্দিষ্ট কাজের ফলাফল মূল্যায়নে সাহায্য করবে।

১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ রাজধানীর গুলশানের একটি কনভেনশন সেন্টারে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ডিজিটাল পরিদর্শন ব্যবস্থার উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও উপস্থিত ছিলেন। তারা বিষয়টিকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, শিক্ষা কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে কাগজবিহীন বিদ্যালয় পরিদর্শন ব্যবস্থায়  ই-মনিটরিং যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। এতে করে বিদ্যালয় পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সহজ হবে। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরিতে কাজ করছে সরকার। এখন কর্মকর্তারা সহজেই পরিদর্শন তথ্য আপলোড করতে পারবেন। এ পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। তিনি বলেন এতে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সহজ হবে। ই-মনিটরিং ব্যবস্থা প্রণয়নে সহযোগিতা করায় সেভ দ্য চিলড্রেন ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সকলকে ধন্যবাদ জানান। আমরা যারা শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট  তারা সবাই সেভ দ্য চিলড্রেন-কে এই মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জানাই। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করতে হলে আরও বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে, মনিটরিং ব্যবস্থা উন্নত হলে পড়াশোনার মান আরও ভালো হবে। শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা সহজ হবে।

অনুষ্ঠানে কাগজবিহীন বিদ্যালয় পরিদর্শন ব্যবস্থা ই-মনিটরিং সিস্টেম সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। এ পদ্ধতিতে কীভাবে বিদ্যালয় পরিদর্শনের বিস্তারিত তথ্য আপলোড করা হয় তা প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়। এসময় অতিথিরা বরিশালের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে ই-মনিটরিং সিস্টেমে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বরিশাল সদর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। অনুষ্ঠানে ৫ জন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ই-মনিটরিং সিস্টেমে বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য পিসি বিতরণ করা হয়। এই মহতী উদ্যোগ প্রাথমিক বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র অনেকটাই পরিবর্তন করতে সহায়তা করবে বলে সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস। আমরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে প্রকৃত শিশুশিক্ষার আলয় হিসেবে দেখতে চাই। সে জন্য প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা, নবতর পদ্ধতি এবং একাগ্রতা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়