ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একাত্তরের গণহত্যার জরিপ : মিলছে নতুন হিসাব

আরিফ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একাত্তরের গণহত্যার জরিপ : মিলছে নতুন হিসাব

আরিফ রহমান : আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। অনেকেই মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহিদ হয়নি। অথচ সহজেই বিষয়টা যাচাই করে নেয়া যায়। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত World Population Prospects খুললেই দেখা যায় ৭০-৭৫ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের মৃত্যুহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বল স্টেট ইউনিভার্সিটির পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর রহমতুল্লাহ ইমন ১৯৫০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যার গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলেন: ‘১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল ১৯৭৫-এ এসে তা আকস্মিকভাবে কমে আসে। সেই প্রবণতা আরও কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে। কালীন সারি বিশ্লেষণের (Time Series Analysis)  পরিভাষায় এ ধরণের প্রবনতাকে ‘ইনোভেশন’ বলা হয়ে থাকে যার অর্থই হলো যে, ঐ সময়ে কালীন সারিতে কোন অস্বাভিবক ঘটনার উদ্ভব ঘটেছিল।

 



এবার পরের ছবি লক্ষ্য করুন। Line of Best Fit থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রত্যাশিত রেখার ঠিক ওপরে থাকলেও ১৯৭৫-এ তা রেখার বেশ নিচে এবং তা পরবর্তী ১০ বছর আমাদের জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত জনসংখ্যা ছিল ৭৮.১৯২৭ মিলিয়ন (যারা এই মানটির যথার্থতা নিয়ে সন্দিহান তাদের জানিয়ে রাখি এক্ষেত্রে R square এর মান ছিল অনেক উচু-৯৮.৫ শতাংশ। যারা আরও উচ্চমানের পরিসংখ্যান ব্যবহার করতে চান তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি সর্বাধুনিক মজবুত নির্ভরণ (Robust Regression) ব্যবহার করলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৮.১২৫ যেক্ষেত্রে R square এর মান দাঁড়ায় ৯৯.৫ শতাংশ।) অথচ ১৯৭৫-এ বাংলাদেশের প্রকৃত জনসংখ্যা কত ছিল জানেন? ৭০.৫৮২ মিলিয়ন। যার সরল অর্থ যা দাঁড়ালো তা হলো যদি কম সংখ্যাটিও বিবেচনা করি তবুও প্রকৃত জনসংখ্যা প্রত্যাশিত জনসংখ্যার চেয়ে ৭.৬১০৭ মিলিয়ন কম, যা প্রায় ৭৬ লাখ!’
এই ৭৬ লাখ মানুষকে একাত্তরের শহিদ দাবি করেননি ডক্টর ইমন। তিনি দেখিয়েছেন ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ নানা দুর্যোগ নেমে এসেছিল আমাদের এই বাংলাদেশে। ১৯৭০-এ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয় তাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩ থেকে ৫ লাখ। ১৯৭৪-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজার থেকে ১৫ লাখ। এভাবে বিভিন্ন কারণে নিহত মানুষদের সর্বোচ্চ সংখ্যা বাদ দিলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের আনুমানিক সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত ৫৫ লাখ! কিন্তু কীভাবে?

ড. মুনতাসীর মামুন খুলনায় গড়ে তুলেছেন দেশের একমাত্র ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’। তিনি পরিষ্কারভাবে মনে করেন, গণহত্যায় নিহত মানুষের সংখ্যা নিয়ে দেশে যে বিতর্ক তার অন্যতম প্রধান কারণ গণহত্যাকে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রে রাখা হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূল বৈশিষ্ট্য গণহত্যা-নির্যাতন। আমরা যারা গণহত্যা নিয়ে কিছু পড়ালেখা করেছি তাদের কাছে গণহত্যা-গণকবর-বধ্যভূমি সম্পর্কিত স্ট্যান্ডার্ড রেফারেন্স বই হচ্ছে সুকুমার বিশ্বাসের ‘একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর’। ড. মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধকোষ দ্বিতীয় খণ্ড’ এবং ডা. এম এ হাসানের ‘গণহত্যা যুদ্ধাপরাধ ও বিচারের অন্বেষণ’। মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ডে মোট ৯০৫টি গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের নাম রয়েছে। ডাঃ হাসানের ওয়ার্ল্ড ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশনের জরিপে মিলেছে ৯৪২ বধ্যভূমির হিসাব (যদিও সেই তালিকা প্রকাশিত হয়নি)। এছাড়া আলোচ্য তিনটি বই নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ইলেক্ট্রনিক বই ‘বধ্যভূমির গদ্য’। সেখানে সাড়ে পাঁচশর মত জেলাওয়ারি বড় বড় বধ্যভূমিগুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়।
গণহত্যা, নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ৬৪ জেলায় গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র সম্পর্কে নতুন করে জরিপ চালানো শুরু করা হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় কাজটি শুরু হয়। প্রকল্পটি এখনো চলমান, গত এক বছরে ৩১টি জেলার জরিপ সম্পন্ন হয়েছে এবং জরিপের প্রাথমিক ফলাফল বিস্ময়জনক!

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় খুলনা জেলার কথা। মুক্তিযুদ্ধ কোষ দ্বিতীয় খণ্ড বলছে খুলনা জেলায় আছে ৪৬টি বধ্যভূমি আর নতুন জরিপে গণহত্যা-বধ্যভূমি আর নির্যাতন কেন্দ্রের মোট সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫৬৪টি। খুলনা জেলার জরিপের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন সরকারি বিএল কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অমল কুমার গাইন। তিনি বিস্তর নথিপত্রের সাথে সাথে অসংখ্য সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, গণহত্যার স্থানের ছবি সংযুক্ত করেছেন, যুক্ত করেছেন শহীদের তালিকা, তার জরিপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে estimated death অর্থাৎ প্রতিটি গণহত্যায় সম্ভাব্য নিহতের সংখ্যা নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন। গণহত্যা, নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তার জরিপটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে GPS ম্যাপিং-এর মাধ্যমে প্রতিটি বধ্যভূমি, গণকবর, গণহত্যার স্থান এবং নির্যাতন কেন্দ্রগুলোকে মানচিত্রের বুকে ডিজিটালভাবে স্থাপন করার কাজ চলছে। এই কাজ শেষ হয়ে গেলে ইন্টারনেটে প্রতিটি জেলার ম্যাপ খুললেই সেই জেলার গণহত্যা, নির্যাতনের স্থানগুলো এক পলকে দেখে নেয়া যাবে।

জেলাপর্যায়ের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপের এখন পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০টি। আরও ২১টি জেলা জরিপ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। প্রকাশিত ১০টি জেলা হচ্ছে নীলফামারী, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, নাটোর, ভোলা, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, পাবনা, কুড়িগ্রাম ও খুলনা। এই ১০টি জেলায় গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে হাজারের ঘর। তাহলে ৬৪ জেলার জরিপ শেষ হলে সে সংখ্যা যে কয়েক হাজারের ঘরে গিয়ে ঠেকবে সেটা আর বলে দিতে হয় না। এছাড়াও গণহত্যা, নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি গণহত্যা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে একটি করে নির্ঘণ্ট গ্রন্থ। প্রতিটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে স্থাপন করা হচ্ছে স্থায়ীভাবে।
এই মহান কর্মযজ্ঞটি যখন সম্পন্ন হবে তখন আর কেউ আমাদের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না। বরং এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারছি একাত্তরে শহীদের সংখ্যাকে ৩০ লক্ষ বলে আমরা জাতীয়ভাবে যে সংখ্যাটা মেনে নিয়েছি প্রকৃত হিসেবে সেই সংখ্যাটা আরও অনেক বড়। ডা: ইমনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের বিশ্লেষণ যেমন ইঙ্গিত দিচ্ছে গণহত্যা, নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের জেলা জরিপও ঠিক একই সত্যের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে।

২.
গণহত্যা, নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধ এবং গণহত্যা নিয়ে আরও অনেকগুলো গবেষণার কাজ চলছে। আজ কেবল বর্তমানে কেন্দ্রে মূল গবেষণার যে কাজটি চলছে তা নিয়েই বললাম। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব এই মহৎ কাজের সাথে যুক্ত হওয়া। আমাদের দেশের অনেক বড় কাজ কেবল প্রচারের অভাবে মানুষের অজ্ঞাতে থেকে যায়। পাঠক গণহত্যা, নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের অফিসিয়াল পেইজটিতে লাইক দিয়ে এই কর্মযজ্ঞের সর্বশেষ আপডেট পেয়ে যেতে পারেন। যুক্ত হতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কর্মের সাথে। আপনি নিজে যুক্ত হোন এবং আপনার বন্ধুদের যুক্ত হতে বলুন। আমাদের ঐক্যবদ্ধ যুক্ততাই পারে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিতে।

পেইজের লিংক: https://www.facebook.com/genocidemuseumbd/
 

 

লেখক: গবেষণা কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়