ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ইতিহাস সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়

কবীর চৌধুরী তন্ময় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইতিহাস সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়

কবীর চৌধুরী তন্ময় : একাত্তর সালে আমার বাবা-চাচা যখন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বেরিয়ে পড়েন, তখন তাদের পরিবারই শুধু নয়; তাদের জীবনের কথা কেউ চিন্তা করেননি। জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারবেন-এমনটাও কেউ ভাবেননি। আমার বাবা বড় চাচার সাথে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে তখন আগরতলা। বড় চাচার প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে শুনে তিনি এক পলক দেখার ইচ্ছে সামলাতে পারেননি। কিন্তু বড় চাচা সাফ না করে দিয়ে বলেন, মাত্র রাতের ব্যাপার। গোমতী নদী পার হয়ে যাবো, মেয়েটাকে একটু বুকে জড়িয়ে আবার রাতের মধ্যেই রওনা দেব। তোকে আসতে হবে না। দেশের অবস্থা খুব খারাপ। তুই এখানেই থাক। সেই গভীর রাতে একমাত্র কন্যা সন্তানের কাছ থেকে বড় চাচাকে বর্বর রাজাকার বাহিনী টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে নিমর্মভাবে হত্যা করে। তার মরদেহ পর্যন্ত আমাদের পরিবার পায়নি। আজও আমরা জানি না...!

পাঠক, সেদিনের সেই অবস্থার কথা চিন্তা করুন, একবার নিভৃতে ভেবে দেখুন; সেই সময়ের চেয়ে কঠিন বাস্তবতা আর কী হতে পারে? সমাজ-রাষ্ট্রের আলোকিত ব্যক্তি মানুষের উপর নির্ভর করে একটি জাতির ভবিষ্যত। আর সেই আলোকিত কবি, সাহিত্যিক, লেখক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, শিক্ষক যখন ব্যক্তি স্বার্থের কারণে পুরো জাতির সামনে মিথ্যাচার করে, অন্যায়কে সমর্থন করে, ভ্রান্ত পথ অনুসরণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তখন এটি তা আর ব্যক্তি পর্যায়ে থাকে না। সমাজ-রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে। ধীরে ধীরে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে।

আল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করে আরেকটি অধ্যায় রচনা করতে পারতেন। সময় ছিল, সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করেছেন কিন্তু দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। আল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কলকাতায় মনেপ্রাণে আল্লাহ’র কাছে মৌন সংযম প্রার্থনা করেছেন। (আল মাহমুদের আত্মজীবনী ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’, প্রকাশক একুশে বাংলা)। মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়ে যিনি নিজেকে সহজ করে চালিয়েছেন আর সেই আল মাহমুদ স্বাধীনতার পরবর্তী সহজ সময়ে এসে নাকি কঠিন বাস্তবতার শিকার হয়ে পথভ্রষ্ট হয়েছেন-এটা অনেকেই উল্লেখ করার চেষ্টা করেছেন। আমি সবার মতামতকে শ্রদ্ধার সাথে নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করছি। কারণ, ৭৫-এর পরে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা যে বাস্তবতার নির্মম শিকার হয়েছেন; তার দ্বিতীয়টি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। যেখানে নিজেদের নাম বলাও ছিল নিশ্চিত মৃত্যু! এরপর শক্তিশালী কয়েকটি দেশ ও সরকার-রাষ্ট্রপ্রধান একদিকে, অন্যদিকে শেখ হাসিনা সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একে একে বঙ্গবন্ধুর খুনীসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন এবং সেই বিচারকাজ এখনও চলমান রেখেছেন। অথচ জাসদের ‘গণকণ্ঠ’র সম্পাদক হয়ে আল মাহমুদ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কী ধরনের মিথ্যাচার করেছিলেন, এখনকার মানুষের চেয়ে তখনকার মানুষ বেশ ভালোভাবেই তা মনে রেখেছেন। তখন রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ভঙ্গ করার উস্কানিমূলক প্রতিবেদনের জন্য গ্রেফতার হয়ে এক বছর কারাভোগও করেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকার পরেও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্পকলা একাডেমীতে সহ-পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। অথচ এই আল মাহমুদ বঙ্গবন্ধুর উদারতার কথা ভুলে গিয়ে তাঁর হত্যাকাণ্ডে সমর্থন জানিয়েছিলেন! পাঠক, চিন্তা করতে পারেন?

সময়ের প্রয়োজন অথবা অপ্রয়োজনে অনেক রাজাকারও এমপি হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীরাও একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক পেয়েছে, পাচ্ছে, হয়তো ভবিষ্যতেও পাবে। কারণ এখানেও গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। চার দেয়ালের এসি রুমে বসে দেশের জনগণের ভাগ্য নির্ণয় করার চেষ্টা করা হয়। কমিশনভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণে রাজাকারও বলে, ‘স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধীনতা রাখবো’। অপরাজনীতিকরা তাদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছে। রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে গলা উঁচিয়ে আজ কথা বলে! সেখানে আজকে আল মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাবেন এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে? এই কবিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করা একশ্রেণির মানুষের চরিত্রের অংশ বিশেষ বলে আমি মনে করি। পরিকল্পিতভাবে আল মাহমুদ একটি জাতির কয়েক জেনারেশনকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করতে অনুপ্রাণীত করেছেন। বিশ্ব যেখানে ছাত্র শিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলছে, আজ যেখানে স্বাধীন এই দেশে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে, সেখানে আল মাহমুদ জামায়াত শিবিরকে পৃথিবীর নিষ্পাপ ফুটন্ত গোলাপের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই তুলনা অনেকের কাছে ভালো মনে হতে পারে। কিন্তু দুঃখিত, আমার পক্ষে প্রতিবাদ-ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছু করার সুযোগ নেই। ভুল আর অপরাধ- একটাকে আরেকটার মাঝে গুলিয়ে ফেলার অর্থ হয়তো অজ্ঞতা, নয়তো নিজেও অপরাধীর সামিল। যারা ভুল করে তারা উপলব্ধি করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়। আর যেটা অপরাধ; বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে সেটাকে অসত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর এতে ক্ষণিকের জন্য লাভবান হলেও ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে একদিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়!

বিএনপি ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত যেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে দেয়নি, সেখানে আজ ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুর জয়ধ্বনি শোনা যায়। যে জামায়াত ইসলামি এতোদিন বলে এসেছে- একাত্তরে তাদের কোনো ভুল হয়নি, সেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক একাত্তরে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছেন। এবং ক্ষমা না চাওয়ায় জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের আইনজীবী দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কথায় আছে দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। তাই আল মাহমুদ বিদায় বেলায় কতিপয় প্রথিতযশা মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যারা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়