ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ব্যক্তিগত বৈশাখ

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৪, ১৪ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ব্যক্তিগত বৈশাখ

এক
বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের কোনো স্পষ্ট চেহারা আমার ভাবনায় দীর্ঘকাল ছিল না। বৈশাখ মাসের প্রথম দিন, নতুন বছরের আরম্ভ, একটি বিশেষ দিন এবং এই দিন উদযাপনের তাৎপর্য- ইত্যাকার তত্ত্ব আমার চিন্তায় কখন আশ্রয় নিয়েছে ঠিক জানি না।

শীতের শেষে এমন সব দুপুর আসতো যখন ঘরের বাইরে আগুনের উত্তাপ, খররৌদ্রের জনহীন রাস্তায় ধূলির সঙ্গে ছোট ছোট শুকনো অশ্বত্থ পাতার রাশ ছুটে বেড়াত, গন্তব্যহীন, মনে আছে। আর কখনও সেইসব দুপুর শেষ হতো চারপাশ অন্ধকার করা সব উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, গুঁড়িয়ে দিয়ে যাওয়া ঝড়ে, মনে আছে। শুধু মনে পড়ে না ঠিক কখন ওইসব তপ্ত অপরাহ্ন আর অন্ধকার বৈকালের কোনো একটি দিনকে বিশিষ্টতায় চিহ্নিত করে নিয়েছিলাম। বাল্য ও কৈশোরে নয়, এ আমি নিশ্চিত। অথচ জানুয়ারির প্রথম দিন যে ইংরেজি নববর্ষ, সমারোহে পালনীয়, এ সত্য মনে হয় কত কাল ধরেই জানি। সায়েবদের কথা মনে পড়ত জানুয়ারির এক তারিখে সেই সেকালে, আর এখন পহেলা জানুয়ারির কথা ভাবলেই নিউ ইয়র্কের টাইমস্ স্কোয়ারে আলোর ঘড়িতে সময় পালটানো, আর দল বেঁধে অযুত মানুষের নাচের ছবি চোখের সামনে ভাসে। পহেলা বৈশাখের কথা মনে এলে শুধু প্রত্যুষ থেকে রমনা বটমূলের দিকে ধাবিত জনসমুদ্রের ছবি দেখি, দেখি জাদুঘরের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, আর সামনে যাওয়া যাবে না এই চিন্তা নিয়ে, কিন্তু এসব ছবিই হারিয়ে যায় আমার সেই অস্ফুট শৈশবদিনের পহেলা বৈশাখের কথা ভাবলে।

দুই
চৈত্র-বৈশাখই ছিল সেসব দিন নিশ্চয়। তপ্ত দুপুরের দিন। এবং ওইসব তপ্ত দুপুরের কোনো একটিতে মনে আছে এসেছিল লাল লাল গোলাপি গোলাপি পোস্ট কার্ড। কখনও ডাকপিয়ন, কখনও-বা গঞ্জের বড় গোমস্তারা ওইসব কার্ড দিয়ে যেত। ‘সম্মানপুরঃস্বর নিবেদন’ এবং ‘শুভ হালখাতা’ শব্দাবলি ওইসব কার্ডে লাল অক্ষরে ছাপা বা লেখা থাকত আর থাকত সিঁদুরের ছাপে সায়েব রাজার আদল।

তারপর ওইসব কোনো এক বিকেলে বা সন্ধ্যায় বাবার হাত ধরে গঞ্জে যেতাম। কত আলো! সামিয়ানা টাঙানো। রঙিন কাগজ আর আমপাতার মালা ঝুলছে চারপাশে। আর মাঝখানে ধবধবে চাদরে সাদা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছে ধরনী মহাজন- যেন সায়েব রাজার ভাই।

বাবা কখনও কখনও পকেট থেকে দুই-একটি টাকা বের করে ধরনী দত্তের সামনে রাখা প্রকাণ্ড কাঁসার থালাটিতে রেখে দিতেন। সাদা, বেশি করে নীল দিয়ে কাচা ফতুয়া পরা গোমস্তারা লিখত কিছু সঙ্গে সঙ্গে লাল কাপড়ে বাঁধানো খাতায়। একটু পরে ভেতরের দিকে এগোলে আরেক গোমস্তা হাতে একটি রসগোল্লা দিলে দাঁড়িয়ে খাওয়ার সময়ে দেখতাম অন্যপাশে চেয়ার-টেবিল সাজানো। আর কারা যেন সেইসব টেবিল-চেয়ারে বসে সামনে রাখা থালা থেকে খায়। ধরনীর গদি থেকে ঢোকা বা বেরিয়ে আসার সময়, কোনো গোমস্তা কোনোদিন আমাদের চেয়ারে বসতে বলে নি।

শৈশবের দিকে তাকালে ওইসব তপ্তদিনের আর কোনো বৈশাখী ছবি চোখে ভাসে না। কৈশোরের দিকে তাকালেও নয়।

তিন
আমি সরকারি স্কুলে পড়িনি। স্বদেশি আমলে শুরু করা মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে কোনোদিন কোনো গান-বাজনার আসর বসতে দেখি নি। এপাড়া-ওপাড়ায়, শহরের উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে, জলসা হতো শুনেছি; প্রায় অতিক্রান্ত কৈশোরে গেছিও সেইসব অনুষ্ঠানে। বিজয়া সম্মিলনী, ঈদ-প্রীতিসম্মিলনী, স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন, এমনকি রবীন্দ্র-নজরুলের জন্মোৎসব কি ইকবাল, জিন্নাহ সাহেবের জন্যও হয়তো সেইসব গান-বাজনা-আবৃত্তি-বক্তৃতা হয়েছে; কিন্তু বর্ষবরণ বা ঐ জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না।

মফস্বল শহরের কলেজে বছরে একবার নাটক, একবার কলেজ ইউনিয়নের অভিষেক বা বাৎসরিক বিচিত্রানুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখ যে কলেজ ছাত্রদের জন্যও পালনীয় একটি দিন- একথা অন্তত কলেজ জীবনের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল না। বাংলা নববর্ষ তাই বিগত বা প্রাক-যৌবনকাল পর্যন্ত তাকিয়ায় হেলান দেয়া ধরণি দত্ত-র দিব্যকান্তি আর তার সামনে বিনীত মুখে আমার বাবা আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন- এই ছবিতে পর্যবসিত হয়ে আছে।

যৌবনকালের কিছু ছবিও আছে। আবছা আলোর এক সকালের সামান্য গরমে, হালকা হাওয়ায় ভোরের রিকশা আমাকে বটপাকুড়ে ঢাকা পরিখাঘেরা, বাগানের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। লোহার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে এক ভিন্ন জগতে প্রবেশের বিস্ময় ক্রমে বেড়েছিল যখন দেখেছিলাম নানা পরিচিত মুখ। বটপাকুড়ের নিচে বসে গাওয়া গানের সুরের সঙ্গে বছরের প্রথম সূর্যের আলো শরীর স্পর্শ করেছিল, চারপাশের সবুজ স্পষ্ট হয়েছিল। হাতের মুঠি থেকে আজন্মের প্রাতরাশ মুড়ি মুখে দেয়ার সময় মনে আরেক বৈশাখের ছবি তুলে নিয়েছিলাম।

সেই ভোরের পর নানা মুখে শুনেছিলাম, নানা কাগজে পড়েছিলাম। অনেকের মতে, দল বেঁধে মাটিতে বসে, গান গেয়ে বছরের প্রথম সূর্যকে স্বাগত জানানো কতই-না অন্যায়, বিজাতীয় আচরণ। মনে আছে প্রভাতের সেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের ও অংশগ্রহণকারীদের পরের বছরও একত্র হওয়ার সংকল্পের কথা।

পণ্ডিতেরা বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক অনন্য উৎসব। এর ঐতিহ্য সুপ্রাচীন বা গৌরবমণ্ডিত।’ নিশ্চয় তাই। তারা অনেককাল আগের কথা বলেন। বাঙালির জীবন থেকে পহেলা বৈশাখ যে কোনো এক সময়ে বেরিয়ে গেছিল তা-ও তারা বলেন কিন্তু কেন গেছিল ভালো বোঝা যায় না।

তবে তারা যখন দেখেন আবার বর্ষবরণ শুধু প্রভাতেই নয়, সন্ধ্যায়ও এবং কেবল একই বাগানের ভেতরে বা বাইরের মাঠে নয়- অন্য শহরের বাগানে, অন্য শহরের মাঠে; শুধু রাজধানীতে নয়, প্রবাসেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে; তখন তারা তার ফিরে আসার কথা বলেন। বলেন, এ হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, ঐতিহ্যের প্রত্যাবর্তন। তবুও কিছু কথা থাকে। থাকে কিছু ছবিও।

যেমন নিউ ব্রান্সউইক শহরের সেই বিশাল প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় পূর্ণ। ‘প্রবাসে বৈশাখ’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে সম্ভবত জুলাই কি আগস্টে। মঞ্চে সংগীত, আবৃত্তি, আলোচনা, নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্যের অবিরল স্রোত। দিনব্যাপী। গ্রীষ্মের হালকা পোশাক, চাই কি পাঞ্জাবিও আছে কিছু। আছে শার্ট-স্লিভস কি স্যুট-টাইও। কেউ ভ্রুক্ষেপও করে না সেদিকে। মঞ্চের দিকেই যে সকলের দৃষ্টি সর্বদা, তা-ও নয়। এ মিলনমেলা, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মেলা।

অমন দেখেছিলাম এই সেইদিনও। সেই প্রভাতের প্রায় ত্রিশ বছর পরে। ঢাকায় নববর্ষের অনুষ্ঠানে। বটমূলে। অত্যাধুনিক শব্দক্ষেপণ যন্ত্রের আওয়াজ কাঁপিয়ে দিচ্ছে মাটি। নতুন সূর্যকে স্বাগত জানাচ্ছে মঞ্চে যেন কয়েকশ শিল্পী। সামনে, পাশে, পেছনের বিস্তৃত বাগানে, লেকের পাড়ে অবিচ্ছিন্ন জনরাশি। সামনে এগোনো যায় না। তারই মধ্যে বসেছে বুঝি বৈশাখী মেলা। নকল পান্তাভাতের কারবারি। দক্ষিণ কি পশ্চিম ভারতীয় পোশাকে সুন্দরী তরুণীদ্বয় ঘুরে বেড়াচ্ছে দোকানে দোকানে। সঙ্গে পিতা-মাতাই নিশ্চয়- দিব্যকান্তি, টাই পরা নেই, এই যা। তারাও এক সময় পান্তাশিকারির জালে পড়ে। বাঙালির সহস্রবর্ষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রভাবেই কি?

স্পষ্ট কথা হচ্ছে এই যে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বকাল থেকেই অন্তত এই ভূখণ্ডের বাঙালি যেভাবে নববর্ষ উদযাপন করে, অতীতে তার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাকিস্তানি শাসনের অভিঘাত-সৃষ্ট চেতনায়, ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদে দ্রোহী চেতনায় স্ফুরিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখ দীর্ঘকাল। বাঙালির সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে, তবে আছে সেখানে তারও বেশি কিছু। তাই পহেলা বৈশাখ ঠিক কখন বাঙালির জীবন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল আগে যদি পণ্ডিতেরা তার সঠিক বিবরণ না-ও দিতে পারেন, এখন ফিরে আসার কথা বলেন ঠিকই। কেন ফিরল তা-ও বলেন। স্পষ্ট বোঝা যায়, কেবল সূর্যাবর্তের এক প্রান্তকেই ধারণ করে রাখেনি, বাঙালির সত্তাকেও কোনো এক সময়ে ঐ প্রান্তে বেঁধে দিয়েছে।

চার
সংগীতানুষ্ঠান, কবিতা, উৎসবে এক জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞায় প্রোজ্জ্বল পহেলা বৈশাখ আমার হৃদয়ে তুলে রাখা ছবি। কিন্তু তাকিয়ায় হেলান দেয়া ধরনী মহাজনের সেই ছবিকেও কিছুতেই আমি ফেলে দিতে পারি না। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ শুনলে এখনও মনে হয় গীতিকারকে তো আর ধরনী দত্তের সামনে ছেলের হাত ধরে সব টাকা শেষ করতে না পারার লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়াতে হয়নি।

‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’ কানে ভেসে এলে এখনও সন্দেহ হয় মুমূর্ষু কে? পুরনো বছর? এই সমাজ? ধরনী দত্ত? নাকি তার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পিতা যার সন্তান বারবার ভেবেছে ঐ পাশের টেবিলে সে কেন বসতে পারে না!

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়