ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বিভেদ ভুলে পেশাগত ঐক্য গড়ে তুলুন

নজরুল মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২৫ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিভেদ ভুলে পেশাগত ঐক্য গড়ে তুলুন

নজরুল মৃধা: যারা মফস্বল শহর ও গ্রাম-গঞ্জে সাংবাদিকতা করেন তাদের অনেকেই ‘মফস্বল সাংবাদিক’ বলেন। মফস্বল সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। এই ঝুঁকি এড়াতে অর্থাৎ নির্যাতন প্রতিরোধে সাংবাদিকদের এগিয়ে আসতে হবে। মতভেদ ও বিভেদ ভুলে গিয়ে নিজেদের পেশাগত ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। জাতির বিবেক বলে পরিচিত সমাজের দর্পণ হিসেবে দেশবাসীর কাছে মফস্বল সাংবাদিকদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

সমাজের অন্যায় অবিচারসহ সমস্ত ব্যাধি সাংবাদিকরাই চিহ্নিত করেন। সেগুলো তারা তুলে ধরেন লেখনির মাধ্যমে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে মফস্বল সাংবাদিকরা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন তাতে ভবিষ্যতে এই পেশাজীবীরা কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এর উপর রয়েছে জীবনের ঝুঁকি। এগুলো মেনে নিয়ে কতদিন তারা সত্যের পথে চলতে পারবেন এটাও এখন বড় প্রশ্ন। সাংবাদিকতাকে যারা পেশা হিসেবে নিয়েছেন তাদের হাজারো সমস্যার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। সর্বশেষ সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে  গত ১৭ এপ্রিল, দিনাজপুরে। বীরগঞ্জে স্বপ্নতরী এগ্রো সার্ভিসেস লিমিটেড-এর গ্রাহক হয়রানি ও প্রতারণার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে ‘ডিবিসি নিউজ’র রংপুর ব্যুরো চীফসহ ‘বার্তা২৪.কম’র রংপুর স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ও ক্যামেরাম্যানকে মারধর করে ক্যামেরা ছিনতাই করে নেয়া হয়েছে।  ঘটনার নেপথ্যে কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিকের নামও উঠে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে হামলাকারীদের সহযোগী সাংবাদিকরা কোন শ্রেণির সাংবাদিক? দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সম্প্রতি বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০১৯-এ বাংলাদেশের চার ধাপ অবনমন হয়েছে। ২০১৮ সালের গণমাধ্যম পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তৈরি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৫০তম। ২০১৮ সালে ছিল ১৪৬তম। ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) ওয়েবসাইটে এ সূচক প্রকাশ করা হয়। সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ অবস্থায় নেমে এসেছে। রাশিয়ার অবস্থান বাংলাদেশের ঠিক আগে হলেও চীন এক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে, ১৭৭তম। সূচকে গণমাধ্যমের অবনমনের বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি অন্যতম।

মফস্বল সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে একটি বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। কয়েক মাস আগের কথা। এক জেলা শহরে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে।  ঘটনার ৪দিন পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত স্বনামধন্য পত্রিকার এক সাংবাদিক জেলা শহরের ওই সাংবাদিককে ফোন করে বললেন- আজ এখন পর্যন্ত ওই ঘটনার  ফলোআপ রিপোর্ট পাঠাননি কেন? এর আগে যে রিপোর্ট আপনি পাঠিয়েছেন সেগুলোতে তথ্য অনেক কম ছিল। ভালোভাবে নিউজ পাঠান বলে তিনি সতর্ক করলেন। অথচ সেদিন পাঠানোর মতো তেমন নিউজ ছিল না।  তারপর ধমক খেয়ে ওই সাংবাদিক অনুনয় করে বললেন- আমার মেয়ের সন্তান প্রসবের পর বাচ্চাটি মারা গেছে। আমার বাড়িতে এখন নাতনির লাশ। মেয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। এ অবস্থায় নিউজ পাঠাই কী করে? একথা শোনার পর উক্ত সাংবাদিকের কণ্ঠস্বর আরো এক ধাপ উপরে উঠলো।  তিনি বললেন- আপনার বাড়িতে লাশ আমাকে আগে বললেন না কেন? আমি ঢাকা থেকে লোক পাঠাতাম সংবাদ সংগ্রহের জন্য। এবার ওই মফস্বল সাংবাদিক অনুনয় করে একই কথা পুনরায় বলতেই কর্মকর্তা বললেন- অজুহাত শুনতে চাই না। আপনি খবর পাঠান। তা না হলে কাল লাল নোটিশ পাবেন। এ অবস্থায়  বাড়িতে লাশ রেখেই বাধ্য হয়ে উক্ত সাংবাদিক সেদিন খবর পাঠিয়েছিলেন।

এই হচ্ছে আমাদের মফস্বল সাংবাদিকদের অবস্থা। সম্মানজনক বেতন ভাতার বালাই নেই কিন্তু তথাকথিত ঢাকাওয়ালাদের হুমকি ধামকিতে তটস্থ থাকতে হয় সব সময়। বলা চলে বিগত কয়েক বছর ধরে সাংবাদিকদের বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন হয়রানির মাত্রাটা বেড়েছে। নির্যাতনের ফলে অনেক সময় সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশে পিছপা হতে বাধ্য হচ্ছেন। সাংবাদিকদের এই দুর্গতি থেকে রক্ষায় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসার আগে সাংবাদিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

তবে এ কথা না বললেই নয়, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা পেশায়  কিছুটা অবক্ষয় ঘটেছে। বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকতায়।  তা যদি যথা সময়ে রোধ করা সম্ভব না হয় তাহলে এ পেশার সাথে যারা জড়িত তাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল। দেশের হাতে গোনা পাঁচ-ছয়টি সংবাদপত্র ছাড়া মফস্বল শহরের অধিকাংশ সাংবাদিক বিনে পয়সায় সংবাদ পাঠাচ্ছেন তাদের পত্রিকায়। সম্মানজনক পেশাটিকে ধরে রাখার জন্য অনেক সাংবাদিককে পকেটের পয়সা খরচ করে খবর পাঠাতে হয়। অর্থের প্রশ্নে তখন সংবাদ পাঠানো হয়ে ওঠে অনিয়মিত। তখন উক্ত পত্রিকাটি অনেক সময় জরুরি সংবাদ থেকে বঞ্চিত হয়। আর্থিক ও চাকরির অনিশ্চয়তা এখনও এদেশের সংবাদপত্র শিল্পে বড় সমস্যা। পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়া আতঙ্কে সব সময় সাংবাদিকরা ভোগেন। বেতনের ক্ষেত্রে ওয়েজ বোর্ড অনুসরণ করে না অধিকাংশ পত্রিকা। ফলে শিল্প হিসেবে গড়ে উঠলেও সঠিক অর্থে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি মফস্বল সাংবাদিকতায়। গুটিকয়েক পত্রিকা বাদে ক্রমবর্ধমান জটিলতার কারণে অধিকাংশ সাংবাদিকদের বেকার হয়ে পরতে হয়। বেকারত্বের ভয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিকল্প পথ খুঁজতে বাধ্য হন তারা। অনেক সাংবাদিক অর্থনৈতিক কারণে নৈতিকতা বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অবক্ষয় হচ্ছে। ফলে সাংবাদিকদের প্রতি জনমনে এক ধরণের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠছে। সমাজের অসৎ দুর্নীতিবাজ লোকেরা তখন উক্ত সাংবাদিককে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন। বর্তমান সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেখা যায় অধিকাংশ পেশা নৈতিক অবক্ষয়ের ব্যাধিত জর্জরিত। সেখানে সাংবাদিকতা সৎ পেশা হিসেবে টিকে থাকা কষ্টকর।

আগে সাংবাদিকতায় নিয়োগ দেয়া হতো যোগ্যতার ভিত্তিতে। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ সাংবাদিক নিয়োগ পান সম্পাদককে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে। অনেক সাংবাদিক রয়েছেন কোনো রকম একটি পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে পারলেই নেমে পড়েন অবৈধ আয়ের উৎসবের সন্ধানে। যারা সৎ এবং নির্ভীক সাংবাদিক তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হন তখন। যে সাংবাদিক অসাধু পন্থায় সংবাদপত্রে এসেছে তার কাছ থেকে সাধুতা অর্থাৎ সত্য সংবাদ আশা করা যায় না। এ কারণে পত্রিকাগুলোও পাঠকের কাছে আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ পত্রিকা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো না কোনো রাজনৈতিক মতের সমর্থক। পত্রিকা সমাজ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক দিক নিদের্শনা দিতে পারে। হতে পারে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে সচেতন। কিন্তু পত্রিকা যখন কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে তখন তার দৈন্য সুষ্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনেক সময় দেখা যায় মফস্বল সাংবাদিক সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করলো কিন্তু সংবাদটি সম্পাদকের স্বার্থের পরিপন্থি হওয়ায় ছাপলো না। তখন সাংবাদিক বাধ্য হয়ে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকে।

এ অবস্থা থেকে এখনই যদি বের হয়ে আসা না যায় তবে এ পেশায় যারা জড়িত রয়েছেন সৎ ও নির্ভীকভাবে লিখতে চান তাদের কপালে দুর্ভোগ আছে। প্রকৃত সংবাদপত্রসেবীদের সংবাদপত্র বের করতে হবে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিক নিয়োগের মাধ্যমে এ পেশায় নিজেদের রুটি রুজির সংস্থান করতে হবে। মালিকপক্ষকে এগুলো অনুধাবন করতে হবে। আর্থিক নিরাপত্তা প্রতিটি মানুষের কাম্য। তাহলে একজন সাংবাদিকের জীবনে কেন আর্থিক নিরাপত্তা থাকবে না? মালিকপক্ষ কেন এই সহজসত্য বুঝবেন না। সাংবাদিকদের সামাজিক নিরাপত্তাও জরুরি। তারা যেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সহায়তা পান সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতার কারণে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের দৈন্য প্রকটভাবে চোখে পড়ছে। এগুলো প্রতিরোধ করে মফস্বল সাংবাদিকদের জীবন মান উন্নয়নে এবং উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে সকল সাংবাদিকদের মধ্যে পেশাগত ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সকলকে একমত হতে হবে। এর বিকল্প নেই। 

লেখক: কবি ও সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়