ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: জন্মদিনে স্মরণ

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৫ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: জন্মদিনে স্মরণ

অলোক আচার্য: স্বাধীনতা এমন একটি শব্দ যা মানুষের জন্মগত অধিকার। মুক্তভাবে, মুক্ত পরিবেশে, বাধাহীন জীবনযাপনের সঙ্গে আত্মপরিচয়ে বাঁচার নামই স্বাধীনতা। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর থেকে বাংলার স্বাধীনতা ব্রিটিশের হাতে চলে যায়। আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ব্রিটিশ এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি শাসকের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে আমাদের অনেক জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। যুগে যুগে এই ভূমিতে জন্মেছে বীর নারী-পুরুষ। যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা এমন একজন নারীর নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

‘স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে পারব, প্রাণ নিতেও মায়া হবে না। কিন্তু নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যি মায়া হয়, পারব না’- এই উক্তিটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মরণীয় নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের। আমরা দেশভাগের আগে ব্রিটিশদের অধীনে ছিলাম। তখন ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য বহু তরুণ-যুবা, তরুণী আন্দোলন করেছেন। দেশের জন্য অকাতরে জীবন দিয়েছেন। ক্ষুদিরাম বসু নিজ হাতে বোমা বানিয়ে ট্রেনে হামলা চালিয়েছিলেন সাহেবদের দর্প চূর্ণ করতে। সেই অপরাধে তার ফাঁসি হয়। এরকম বহু স্বাধীনতাকামী স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষদের নাম বেশি শোনা যায়, আলোচিত হয়। নারী স্বাধীনতাকামীদের কথা খুব একটা আলোচনায় আসে না। হয়তো সে সংখ্যা হাতে গোনা বলেই। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম প্রীতিলতা। তার নাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে গাঁথা। শুধু তাই নয়, তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে এবং থাকবে।  একজন নারী সেই সময়ের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাতৃভূমি মুক্ত করতে, চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে ত্যাগ এবং সাহসীকতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা আজও মানুষের মনে অম্লান। তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তিনি ছিলেন প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ। তিনি যুগ যুগ ধরে নারীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে সাহস যুগিয়ে আসছেন।

প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে এবং মৃত্যু ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নায়ক মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনে তিনি সক্রীয়ভাবে অংশ নেন। আজকের নারী সমাজে পুরুষতান্ত্রিক যে মনোভাব, যে অত্যাচার তার বিরুদ্ধে প্রীতিলতার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শিক্ষা নেয়া যায়। দেশের জন্য, দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য তিনি জীবন দিয়েছেন। যে বছর তিনি শহীদ হন সেবছর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করতেন। সেই ক্লাবের একটি সাইনবোর্ড থেকে ভারতীদের প্রতি ব্রিটিশদের ঘৃণা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। সাইনবোর্ডে লেখা ছিল: ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। এই একটি বাক্য থেকেই বোঝা যায় সাদা চামড়ার সাহেবরা ভারতীয়দের নিন্ম শ্রেণির প্রাণি থেকে ভিন্ন কিছু মনে করতো না। এবং এটি ছিল উপমহাদেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদাহানীকর। এছাড়াও প্রতি পদে পদে ভারতীয়দের অবমূল্যায়ন করা হতো। এসব অবমূল্যায়ন ক্রমেই মনে গভীরভাবে দাগ কাটতে শুরু করেছিল ভারতবাসীর মনে।

ভীষণ লাজুক স্বভাবের প্রীতিলতার ডাকনাম ছিল ‘রাণী’। মা তাকে এই নামে ডাকতেন। লাজুক স্বভাবের এই মেয়েটিই যে একদিন প্রচণ্ড সাহসিকতার সঙ্গে দেশের জন্য জীবন বাজী রাখবে তা ক’জনে ভেবেছিল? প্রখর মেধার অধিকারী হওয়ায় পিতা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। ঢাকার ইডেন কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী লীলা নাগের সংস্পর্শে আসেন তিনি। এই লীলা নাগ ওই সময় দীপালি সংঘে ছিলেন। দীপালি সংঘ ছিল ঢকার বিপ্লবী দল শ্রীসংঘের নারী শাখা। তার বিপ্লবী চেতনা মূলত এখান থেকে প্রভাবিত হয়েছে। একটি বিপ্লবী চেতনা জন্ম থেকেই থাকে। প্রয়োজন কেবল সময় ও সঠিক পথের। বিকশিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রীতিলতার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। তার সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত আছে আরেক সংগ্রামী মাষ্টারদা সূর্যসেন। মাষ্টারদার যোগ্য শিষ্যা প্রীতিলতা। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের প্রধান কেন্দ্র ধলঘাটের ঘাঁটিতে মাষ্টারদার সাথে প্রথম দেখা করেন প্রীতিলতা। তার আগে তার বান্ধবী কল্পনা দাশের কাছে মাষ্টারদার সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এই বান্ধবীই তাকে মাষ্টারদার সান্নিধ্যে আসার ব্যবস্থা করে দেন। স্কুলজীবন থেকেই প্রীতিলতা তার মনে স্বাধীনতার ইচ্ছা পোষণ করতেন। তার পাঠ্য তালিকা থেকেই বোঝা যায়। প্রীতিলতা যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী তখন লুকিয়ে লুকিয়ে বাঘা যতীন, ক্ষুদীরাম, দেশের কথা আর কানাইলাল পড়তেন। মনে মনে তিনি নিজেকে স্বাধীনতার একজন যোদ্ধা হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন। এই সব বই তাকে বিল্পবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। ভেতরে ভেতরে দেশকে শত্রুমুক্ত করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বিশেষ  করে বিট্রিশ শাসন থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর চিন্তা করতে থাকেন। প্রীতিলতার মায়ের ডাকা রাণী নামটি স্বার্থক। কারণ তিনি আজও মানুষের মনে রাণীর মতই বেঁচে আছেন।

ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পর পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে প্রীতিলতা নিঃশেষে প্রাণ দান করেন। কারণ তার কাছে জীবনের থেকে দেশ অনেক বেশি মূল্যবান ছিল। তার কাছ থেকে যেন তথ্য ফাঁস না হয়ে যায় সে কারণেই তিনি এটি করেছিলেন। অপারেশনে গিয়ে তার অবশ্য গুলি লেগেছিল। কিন্তু গুলি মৃত্যুর কারণ ছিলো না। মৃতদেহ তল্লাশির পর তার কাছ থেকে বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, রিভলবারের গুলি, ছবি এবং একটা হুইসেল পাওয়া যায়। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বিপ্লবী চেতনার যে বিশ্বাস তা যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতাকামী মানুষকে প্রেরণা দিয়েছে। তা আজও প্রবাহমান। জন্মদিনে এই বিপ্লবী নারীর প্রতি রইল শ্রদ্ধা। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়