ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ঋণ শেষ করে দিচ্ছে প্রাণ

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৫, ১৩ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঋণ শেষ করে দিচ্ছে প্রাণ

প্রতীকী ছবি

সাইফ বরকতুল্লাহ:  আমি মাঝে মাঝেই একটা হোটেলে সকালে নাস্তা খেতাম। একদিন নাস্তা খেতে গিয়ে দেখি ওই হোটেলের মালিকের পরিবর্তে পরিচালনা করছেন মালিকের ভাই। জিজ্ঞেস করলাম, মালিক কোথায় গেছেন? উনি বললেন, বাড়িতে গেছে, ভাইয়ের সাথে বিবাদ। আমি বললাম কী নিয়ে? উনি বললেন, ঋণ করে ভাইয়ের সাথে আরেকটা দোকান দিয়েছিল কিন্তু লস খেয়ে দোকান বন্ধ। এ নিয়ে। ঋণ দরকার ছিল না। এই হোটেল দিয়েই তার সংসার চলে যেতো সুন্দরমতো। ওই যে বেশি আশায়...। আমি আর কথা না বাড়িয়ে নাস্তা সেরে চলে এলাম।

ঋণ করে ঘি খাওয়ার প্রবাদ ছোটবেলায় অনেক শুনেছি। একবার ছোট চাচার কাছে ছোটবেলায় গল্প শুনেছিলাম, ঋণ করে বিলাসিতায় চা খেতেন এক লোক। ঋণের কারণে শেষ জীবনে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হয়েছে তার। যদিও দিন এখন পাল্টেছে। এখন অনেকের কাছে ছোটখাটো ঋণ অনেক বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। এ কারণেই মানুষের নানা চাহিদাকে সামনে রেখে ঋণও একটি পণ্য হয়ে উঠেছে।

পত্রিকার শিরোনাম দেখে নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘নিজ বাসায় ঝুলন্ত লাশ, পুলিশের ধারণা অভাবের তাড়নায় অত্মহত্যা’ শিরোনামে ১১ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। খবরে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার বদরপাতি এলাকায় নিজ বাসা থেকে আয়াজ মোহাম্মদ মওদুদ খান (৫৬) নামের এক ব্যক্তির ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে অভাবের তাড়নায় ঋণগ্রস্ত হয়ে ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ। কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক কামরুজ্জামান বলেন, ‘ভোরে পরিবারের সদস্যরা সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন তিনি ঘরের একটি ফ্যানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে জেনেছি, সেখানে একটি চিরকূট পাওয়া গেছে। চিরকূটে লেখা আছে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ এছাড়া তিনি জানান, প্রাথমিক তদন্তে জেনেছি- সংসারে অভাব ছিল। ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েছিলেন। এজন্য সম্ভবত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

মওদুদ খান চাক্তাইয়ে একটি চালের আড়তে চাকরি করতেন। তার পরিবারের সদস্যরা বলেছেন- সম্প্রতি তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এজন্য সংসারে অভাব-অনটন শুরু হয়। একমাত্র ছেলে এবার এসএসসি পাস করেছে। হঠাৎ করে অভাবে পড়ে যাওয়ায় সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এজন্য তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে লোকজনের ধারণা। [সূত্র: সারাবাংলা, মে ১১, ২০১৯]।

১২ মে এরকম আরো একটি খবর। ‘ঋণে জর্জরিত ক্রিকেটারের মাকে নিয়ে আত্মহত্যা!’। ২৫ বছর বয়সী বিনোদ ক্রিকটকেই ধ্যান-জ্ঞান মনে করতেন। পূর্ব ভিরারের সাইবা ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতেন তিনি। কিন্তু ক্লাব ক্রিকেটে খেল যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে সংসার চলছিল না। ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকরিও করতে শুরু করেছিলেন বিনোদ। কিন্তু দেনার দায় মাত্রাতিরিক্তি বেড়ে গিয়েছিল। সঞ্জীবনী চৌগুলের সঙ্গে তার স্বামীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। ছেলেকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন তিনি। ভিরারের নারাঙ্গিতে সাই হেরিটেজে একটি ফ্ল্যাটে ছিল তাদের ছোট সংসার। ঋণের টাকা শোধ না করতে না পেরেই তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে অনুমান পুলিশের। মা ও তার ক্রিকেটার ছেলে, দুজনকেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় নিজ ফ্ল্যাটে। পুলিশের ধারণা, দেনার দায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তারা। [সূত্র: বহুমাত্রিক, ১২ মে ২০১৯]।

এছাড়া ‘ঋণের দায়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ’ শিরোনামে গত বছরের ৬ আগস্ট বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয়। সত্যি বেদনাদায়ক খবর। এরচেয়ে কষ্ট আর হতে পারে না। শুধু গত বছরের ৬ আগস্ট নয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে ঋণের দায়ে স্কুল শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরের ৫ জুলাই কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের সোনাইকুন্ডি গ্রামে ঋণের দায়ে মোহন মোল্লা নামে এক বেকার যুবক আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরের ৮ জুলাই বড়াইগ্রামে ঋণের দায়ে গলায় ফাঁস নিয়ে সাইদুল ইসলাম নামে এক দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরের ১০ জুন নারায়ণগঞ্জে ঋণের দায়ে জর্জরিত এক গার্মেন্ট কারখানার মালিক আত্মহত্যা করেছেন। তার নাম আবদুল মতিন। তিনি ফতুল্লার এনএম ফ্যাশনের মালিক ছিলেন। শুধু যে বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটছে তা কিন্তু নয়। গত বছরের ১৫ জুলাইয়ের খবর, ‘ভারতে ঋণের দায়ে আরো একটি পরিবারের গণআত্মহত্যা!’। কতটা হৃদয়ক্ষরণ ঘটনা বলা যায়!

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। মান বাড়ছে। গত বছরের মার্চে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রোফাইল অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় ওঠার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল ও উন্নত-এ তিন পর্যায়ে বিবেচনা করে। বাংলাদেশসহ ৪৮টি দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে। এই সময়েও কিছু কিছু গরীব লোকতো দেশে রয়েছেই। তবে ঋণ নিয়ে এভাবে সম্ভাবনাময় কিছু প্রাণ হারিয়ে যাবে বিষয়টা চিন্তার। বিষয়টি নিয়ে সবারই সচেতন হওয়া উচিত। স্বল্প আয় কিংবা একটু বেশি অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার আশায় ঋণ অনেকেই করছেন বা করবেন। তবে তার আগে বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত, আপনি কতটুকু ঋণ নিলে পরিশোধ করতে ভবিষ্যতে আপনার কোনো সমস্যা হবে না। কিংবা ঋণ করে আপনার সেই টাকা জলে গেলেও কষ্ট করে ঋণ শোধ করতে পারবেন। বিষয়গুলো ভেবে ঋণ গ্রহণ করুন। কারণ, ঋণ করে ঘি খাওয়ার চেয়ে যতটুকু আপনার আছে তা দিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন অনেক সুখী করতে পারেন। কথায় আছে When ambition ends, happiness begins. যখন উচ্চাকাঙ্ক্ষা শেষ হয়, সুখ শুরু হয়। সুতরাং ঋণ করে জীবন শেষ নয়, বাস্তবতা মেনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছেড়ে সুখী জীবনযাপনই কাম্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৯/সাইফ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়