ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

করুণাময়, ওর হাঁটুতে জোর দাও

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৩০ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করুণাময়, ওর হাঁটুতে জোর দাও

জাফর সোহেল: কিছুদিন আগে বাংলাদেশের কয়েকজন সরকারি চিকিৎসক নিজেদের দায়িত্বে অবহেলা করেছেন বলে মাশরাফি তাদের সতর্ক করেছেন। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে সে অধিকার তিনি রাখেন। এরপরও চিকিৎসক সমাজের বৃহৎ অংশ তাকে গালমন্দ করেছে। বলেছে- সে দুই টাকার ক্রিকেটার; বলেছে অশিক্ষিত, অপরিণত! মাশরাফি এর উত্তরে বলেছেন, প্রিয় চিকিৎসক ভাইয়েরা, ভুল হলে ক্ষমা করবেন! এখানেই মাশরাফি অন্যদের চেয়ে আলাদা। তিনি বলেননি, এদেশের চিকিৎসকেরা অনেকটা ‘ডাকাত শ্রেণি’র পর্যায়ে পড়েন। আমরা অনেকেই কিন্তু এভাবে বলি। যদিও এভাবে বলাটা অন্যায়। মাশরাফি তার পরিমিতিবোধ প্রমাণ করেছেন। মাশরাফি যে অন্য সবার চেয়ে অনন্য, তিনি যে সাধারণের সীমার বাইরে গিয়ে অসাধারণ একটা সত্তা- তার প্রমাণ ঐ ছোট্ট উত্তর দিয়েই দিয়েছেন।

অনেকে হয়ত জেনে থাকবেন আমাদের পাশের দেশ ভারতে প্রায়শ দেবতাদের পাশাপাশি পূজা হয় শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, বিরাট কোহলিদের! আবার কখনো কখনো ম্যারাডোনা-রোনালদো কিংবা মেসি-নেইমারদেরও পূজা হয়। অনেকের কাছে এরা একেকজন দেবতাতুল্য। কেন? কারণ, দেবতারা যেমন পূজারিদের আনন্দ এনে দেন, খুশি এনে দেন, তৃপ্তি এনে দেন, চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেন- এরাও প্রায়শই তা করেন। বাংলাদেশের মানুষ সিংহভাগ মুসলিম হওয়ায় পূজা-অর্চনা না হলেও এদেশের ক্রিকেটারদের জন্য অন্তর থেকে দোয়া করেন সাধারণ মানুষ। মাশরাফি-সাকিব-তামিমরা আমাদের কাছে ভারতের টেন্ডুলকার-কোহলিদের মতোই পূজনীয়। এটা কেউ বলবেন, কেউ বলবেন না; কিন্তু মনের ভেতরে মানবেন সবাই। মাশরাফি বিন মুর্তজা সম্ভবত বাঙালির হৃদয়ে এই সবগুলো নামের অগ্রভাগে থাকবেন, আছেন।

কেন, মাশরাফির বিশেষত্ব কোথায়? এর জবাবে অনেকটা এভাবে বলা যায়, মাশরাফির বিশেষত্বের অভাব কই? এদেশে নয় কেবল, সারা পৃথিবীতেই মাশরাফি একজন, যে সাতবার অস্ত্রোপচারের টেবিলে শুয়েছেন, হাঁটু কাঁটাছেটা করেছেন; আবার মাঠে ফিরেছেন, জর্জরিত হাঁটুতেই পট্টি বেঁধে রানআপে দৌড়েছেন। বল করেছেন, উইকেট তুলেছেন আর দলকে জিতিয়েছেন! একবার নয়, দুবার নয়, অনেকবার।

মাশরাফি একটি নাম, যেটি দলের সঙ্গে ট্যাগ করা থাকলে আমরা বুঝি- কিছু একটা হবে! মাশরাফি থাকলে টিমমেটরাও জয় নিয়ে চিন্তা করে না। তারা ভাবে, এটা তো মাশরাফির কাজ! আর মাশরাফির নিজের কাজ কে করবেন? তার দায়িত্বও তাকেই সামলাতে হয়। পরাজয়ের পর ভেঙে পড়া থেকে কিংবা দুঃসময় থেকে সুসময়ে ফিরতে কে মাশরাফিকে সাহস দেবে? তাও সে নিজেই। মাশরাফি এজন্যেই আশ্চর্য মানব এক। তিনি ভাঙেন, মচকান, কিন্তু রেস ছেড়ে যান না কখনো; তিনি কখনো হেরে যান না।

২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের যৌথ আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। ঘরের মাঠের সেই বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি মাশরাফি। ফিট থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় কিংবা অনৈতিক সিদ্ধান্তে একজন মাশরাফির নিজের দেশের মাঠে বিশ্বকাপ খেলতে না পরা কতটা বেদনার? কজন আছে এই বেদনা সহ্য করে থাকতে পারবে? মাশরাফির আছে। সে সহে, রহে, তারপর বহে সুমুদ্দুর। মাশরাফি জানেন, দুঃসময় কেটে গেলেই সুসময় আসবে। তাই তিনি কিছু বলেন না, কিছু করেন না। চুপচাপ সয়ে যান অবহেলা, অন্যায়।

মশরাফির বিশেষত্ব এখানে যে তার বুকের ভেতরে একটা হৃদয় আছে। সে হৃদয়ের আকার কেমন, কত বড়? তা কেউ জানে না। মাশরাফির হৃদয়ের সীমা বোঝা সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। নড়াইল শহরের যে মুচি মাশরাফির জুতো পালিশ করে- সেও মাশরাফির আজীবনের বন্ধু হয়, বন্ধু থাকে। বড় হয়ে গেলেও ছোট যে, তাকে অসম্মান-অবহেলা করতে জানেন না মাশরাফি। মুচি বন্ধুর বোনের বিয়েতে অর্থের সংকট? মাশরাফি নীরবে সে সংকট মুছে দেন, যেমন বন্ধু তার জুতো মুছে দেন; আদরে, যত্নে।

মাশরাফির হৃদয় মাঝে মাঝে দেখতে পায় নড়াইলবাসী। তার বাড়ি যে সেখানে! হাঁটু টেনে টেনে বিপিএল জিতে গেলে কর্তৃপক্ষ মাশরাফিকে একটা বিশেষ উপহার দিতে চায়। বলে, তুমি বলো অধিনায়ক, কী চাও উপহার? মাশরাফি বলেন, আমার এলাকার মানুষের জন্য একটা এ্যাম্বুলেন্স দিন! দাতাদের চোখ কপালে উঠে যায়! এ কোন মানব, নিজের জন্য কিছুই চাইল না? উপহার চাইল অন্যদের জন্য?

সম্ভবত ২য় বিপিএল। ফিক্সিংয়ের চোরা কারবারিরা ঝাঁক বেঁধে এসে ঘাঁটি গড়েছে বাংলাদেশে। আরেকটু টেনে বললে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। সেখানে বাজিকরের দলেরা ম্যাশকে কুপোকাত করতে দেখালো কোটি কোটি টাকার লোভ। ম্যাশ তখন কী করবেন, কাকে বলবেন এই বিপদের কথা? মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের মনের ওপরই আস্থা রাখবেন তিনি। মন বলছে, সাহসী হও। বলে দাও সবাইকে এই নোংরামির কথা। মাশরাফি তাই করলেন। সাহস করে গোটা সিন্ডিকেটের অবৈধ কারসাজির খবর বলে দিলেন জাতিকে! নিজের ঝুঁকির কথা, জীবন-মৃত্যুর কথা এতটুকু ভাবেননি তিনি। তিনি ভেবেছেন দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের কথা। ভেবেছেন বুকের ভেতরে লালিত নীতি ও আদর্শের কথা। শেষ পর্যন্ত জয় তারই হয়েছে। এভাবে এক বুক সাহসই মাশরাফিকে ‘মাশরাফি’ করে গড়ে তুলেছে।

হৃদয়ের এই সাহস মাশরাফি এখন ক্ষণে ক্ষণে অনুবাদ করে দেখান ক্রিকেটের গোল মাঠে। স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনার ম্যাচে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি আসে ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিকের কাছ থেকে। কখনো কখনো বুঝে যান, সামনে থেকেই দলকে টেনে নিতে হবে। প্রতিপক্ষের উইকেট পড়ছে না তো পড়ছেই না? হঠাৎ করে দেখবেন, মাশরাফিই দৌড়াচ্ছেন বল হাতে। কারণ, মাশরাফি জানেন, তখন তাকেই দরকার। আর সে পথটা দেখাতে পারলে বাকিরাও ঝাঁপিয়ে পড়বে বাঘের হিংস্রতা নিয়ে। সবশেষ যে ট্রফিটা আমরা ঘরে তুলতে পেরেছি, সেটিও এসেছে অনেকটা মাশরাফির এমন ক্যারিশমাতেই। যথা সময়ে যথা আঘাত করে প্রতিপক্ষকে চমকে দেন তিনি বারবার।

২০১৫ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেমন ছিল, কী অবস্থায় ছিল- আমরা জানি। কিছু ম্যাচ আমরা জিততাম, বেশিরভাগ হারতাম। এক বিশ্বকাপে অপাঙক্তেয় থাকা মাশরাফি আরেক বিশ্বকাপে কী করে ফেললেন? একটা ভঙ্গুর দলকে তিনি টেনে নিয়ে গেলেন কোয়ার্টার ফাইনালে! কী আশ্চর্য, দলের প্রত্যেকের মধ্যেই তখন টগবগ করছে আত্মবিশ্বাস। যে দলটা বিদেশের মাটিতে জয়েরই দেখা পায় না, সেই দলটাই তুলে নিল পটাপট একের পর এক জয়। বিশ্ব অবাক তাকিয়ে দেখল লাল-সবুজের আশ্চর্য উত্থান! মাঠে মাশরাফি, গ্যালারিতে মাশরাফি, কমেন্ট্রি বক্সের আলোচনায়ও মাশরাফি। মাশরাফি ক্রিকেটের নতুন নেতা- দেখল বিশ্ববাসী। সেই শুরু। তারপর দেশের মাটি বলেন আর বিদেশের মাটি, এই কয়েক বছরে বাংলাদেশ কিন্তু কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি। ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা এশিয়ার তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকেই ঘুরে ঘুরে পরাজয়ের তেতো স্বাদ গিলিয়েছে মাশরাফির দল। হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। টানা ৫টি সিরিজ জেতার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন মাশরাফি। এ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাটিতেও হোয়াইটওয়াশ আর সবশেষ তিন দেশের সিরিজে টানা ৪ ম্যাচ জয়- এসবই মাশরাফির অপরাজেয় বাংলাদেশের সুন্দর ছবি।

বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা কত সকাল আর কত বিকেল অপেক্ষায় কাটিয়েছে এমন একটি বাংলাদেশ দেখার জন্যে। মাশরাফি বিন মুর্তজা আমাদের প্রিয় ম্যাশ সেই লড়াকু আর অপরাজেয় মানসিকতার বাংলাদেশ ভক্তদের উপহার দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন খেলবে, লড়বে, জিতবে। একটি বিশ্বকাপ জিতুক আর না জিতুক তাতে মাশরাফি ক্ষয়ে যাবেন না। মাশরাফি বীর বাঙালি, তিনি লড়তে জানেন, জিততে জানেন। তাই মাশরাফির জন্য আমাদের প্রার্থনা চাই; সবার সম্মিলিত প্রার্থনা। হাঁটুর বেদনা মাশরাফিকে যেন কাবু করতে না পারে, মাশরাফি যেন সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে দাঁড়ালে বাংলাদেশ দাঁড়াবে। বিশ্বকাপের মহারণের ঠিক আগে কী যেন সংবাদ বাতাসে ভেসে আসছিল গত দুদিন- মাশরাফি নাকি হাঁটুর ব্যথায় কাতরাচ্ছে! ইনজুরি নাকি তাকে মাঠ থেকে ছিটকে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত! আসুন প্রিয় দেশবাসী, আমরা সকলে প্রার্থনা করি, করুণাময় আল্লাহ যেন মাশরাফির হাঁটু ভালো রাখেন, তার হাঁটুতে যেন জোর দেন, সে যেন দৌড়াতে পারে, সে যেন জয় এনে দিতে পারে আমাদের। আস্ত একটা বিশ্বকাপ না হোক, অন্তত অনেকগুলো জয় চাই আমরা। মাশরাফি আমাদের অনেক অনেক জয় এনে দিক। আল্লাহ যেন তাকে সেই শক্তি দেন, সেই সাহস দেন।

লেখক: সাংবাদিক

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়