ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পরকীয়ার দোষ চাপানো দায় এড়ানোর কৌশল || রুমা মোদক

রুমা মোদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ২৯ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরকীয়ার দোষ চাপানো দায় এড়ানোর কৌশল || রুমা মোদক

রিফাতের রক্তাক্ত মৃত্যুর ভিডিওটি ভাইরাল হবার পরপরই শহরবাসী ছিলো কাঠগড়ায়। একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে কোপাচ্ছে, ব্যস্ত শহরবাসী কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রগতিবাদীরা তীব্র ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো। এই ভণ্ড সমাজে পরশ্রীকাতর জনতা অপ্রকাশ্যে, গোপনে প্রেম করা প্রেমিক-প্রেমিকাকেও সুযোগ পেলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়, গণধোলাই দেয়। কিন্তু কাউকে হত্যা করতে দেখলে এগিয়ে আসে না। 

হ্যাঁ, বরগুনায় দিন-দুপুরে মিন্নির স্বামী রিফাতকে যখন কোপানো হচ্ছিলো তখন চারদিকে ব্যস্ত শহর,শহরের মানুষ, কেউ এগিয়ে আসে নি। প্রকাশ্য দিনের আলোয় একটা সভ্য সমাজে একটা ছেলেকে কোপাচ্ছে আরেকটা ছেলে, রক্ত ঝরছে, একটা মেয়ে; হতে পারে সে স্ত্রী কিংবা বন্ধু কিংবা প্রেমিকা। বাঁচানোর জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় একবার ওকে, আরেকবার তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। তার অজান্তে ধারণ করা ভিডিওতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে মেয়েটির এই চেষ্টায় কোনো ভণিতা ছিলো না। তারপরও রিফাতের মৃত্যু পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা পার হতে না হতেই কাঠগড়ার নির্দেশ ঘুরে গেলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ তর্জনী উঁচু হলো মেয়েটির প্রতি। ক্ষমতাবান থেকে ধর্ষকাম- কেউ বাকি রইলো না। নানা অভিযোগের তীর ধেয়ে আসতে লাগল মেয়েটির দিকে। এ এক অদ্ভুত আত্মপ্রতারক জাতি! যে ডালে বসে, সেই ডাল কাটে। পরিণামে যে নিজেদের ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে তা টের পাওয়ার দূরদর্শিতাও তার নেই।

ভিডিও পরবর্তী প্রাপ্ত ফুটেজ, ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, খুনী ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির ঘনিষ্ঠতা ছিলো। হয়তো সে ঘনিষ্ঠতা প্রেম পর্যায়ের, হয়তো নয়, হয়তো সে ঘনিষ্ঠতা বন্ধুত্বের, হয়তো নয়। কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে খুনীর সঙ্গে মেয়েটির বিয়ের কাবিন পর্যন্ত বের করে ফেলেছেন। এবং মেয়েটিকেই খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। খুনী দুজনের একজন যদি মেয়েটির প্রাক্তন কিংবা বর্তমান প্রেমিক হয় তবে কি এই খুন জায়েজ হয়? কেনো মেয়েটি একটি সম্পর্ক ছেড়ে আরেকটি সম্পর্কে জড়ালো এই অপরাধে খুনের দায় কি মেয়েটিরই? যদি মেয়েটি পূর্বে খুনী ছেলেটিকে বিয়ে করেই থাকে তবে কি এই খুন জায়েজ হয়? কেনো মেয়েটি তাকে ছেড়ে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করলো? যদি খুনী ছেলেটি মেয়েটির বন্ধুস্থানীয় কেউ হয় তবে কি এই খুন জায়েজ হয়? এই খুনের জন্য মেয়েটি দায়ী হয়?  

না, কোনো কারণেই এই প্রকাশ্য বর্বরতা জায়েজ হয় না এবং কোনো কারণেই এর দায় মেয়েটির উপর বর্তায় না। খুনী ছেলেটির সঙ্গে প্রেম করলেও না, ছেলেটিকে একদা বিয়ে করলেও না, ছেলেটি তার বন্ধুস্থানীয় কেউ হলেও না। কেননা প্রতিটি মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে স্বতন্ত্র সত্তা। তার সিদ্ধান্ত তার নিজের। নিজের আকর্ষণ থেকে সে যেমন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে, তেমনই আকর্ষণ ফুরিয়ে গেলে সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার অধিকারও ব্যক্তি মানুষের রয়েছে। কেবল অধিকার নয়, আধুনিক মানুষের জন্য তা দায়িত্বও বটে। সেটা প্রেম কিংবা বিয়ে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তখন, যখন এই আকর্ষণ কিংবা বিকর্ষণের কোনোটি একপাক্ষিক হয়। অন্যপক্ষ তা মেনে নিতে পারে না। আমাদের মতো শিক্ষা রুচি অসংস্কৃত সমাজে অন্যপক্ষ তখন হিংস্র প্রতিশোধপরায়ণ এবং খুনী হয়ে ওঠে। খুনী হয়ে ওঠে কারণ, এই অসুস্থ সমাজ তাকে ব্যক্তি মানুষকে সম্মান করতে শেখায় নি। শেখায় নি অপরের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে মূল্য দিতে। শিখিয়েছে নিজের পেশী আর ক্ষমতার দম্ভ শেখাতে। শিখিয়েছে নিজের ইচ্ছা অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে। শিখিয়েছে ধর্ষকাম হতে।

মূল সমস্যা এই সমাজ বিকাশের বিকলাঙ্গতায়। যে বিকলাঙ্গতার কারণে এই সমাজে প্রভার ভিডিও ভাইরাল হয়। রিফাত খুন হয় এবং সেই খুনের জন্য  তার স্ত্রীর উপর দায় চাপিয়েই মানুষ ক্ষান্ত হয় না, তাকে মানসিক বিপর্যস্ততার এমন পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হয়, মেয়েটি নিজেকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত আর শান্তি পায় না। মেয়েটি যদি নিজেকে ধ্বংস না করে তাহলে এই সমাজের ক্রমাগত অপবাদ আর আক্রমণের নির্দয় তর্জনীর নিচে তার জীবনযাপন দুঃসহ হয়ে ওঠে- এই বিধিলিপি তাকে মেনে নিতে হয়।

আদিম সমাজ থেকে এই আধুনিক সমাজে মানুষের উত্তরণের ইতিহাস সামাজিকায়নের ইতিহাস। মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় তা সামাজিক সম্পর্ক। দেশে কালে এই সামাজিক সম্পর্ক ভিন্ন হয় এবং সময়ের মতোই নিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতার সাথে খাপ খাইয়ে চলার নামই প্রগতি।  আর এর বিরুদ্ধাচারণ করা প্রতিক্রিয়াশীলতা। এই সামাজিকতা নির্ভর করে কিছু সামাজিক মূল্যবোধের উপর। যে সমাজ শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতে যতো উন্নত হবে, সে সমাজ ততোই উন্নত মূল্যবোধ ধারণ করবে। এবং সময়ের পরিবর্তনের সাথে তা উত্তরণের পথেই অগ্রসর হবে।

নানা কারণে আমাদের সমাজের বিকাশ স্বাভাবিক ধারায় অগ্রসর হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেকগুলো পটভূমি মিলিত হয়ে আজকের এই অসুস্থ সমাজের সৃষ্টি। যেখানে কেউ প্রেমিকাকে দখল করতে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকার স্বামীকে হত্যা করে, নির্বিকার মানুষ সেই হত্যা দাঁড়িয়ে অবলোকন করে, কেউ এগিয়ে এসে রুখে দাঁড়ায় না, কেউবা মেয়েটির চরিত্র ব্যবচ্ছেদ করে, কেউবা সেই চরিত্র ব্যবচ্ছেদ ঠিক হচ্ছে কিনা তা পর্যালোচনা করে। অথচ তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে- এর মতো একটা অসুস্থ পঙ্গু অসংস্কৃত প্রজন্ম তৈরি হয়ে আমাদের ভবিষ্যতকে এক অতল অন্ধকারে টেনে নিচ্ছে তা নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন নয়। সামগ্রিকভাবে জাতির এই অধঃপাতের আয়োজন একদিনে সম্পন্ন হয়নি। আমরা আমাদের প্রজন্মকে আত্মকেন্দ্রিক আত্মপ্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত একটি রোবটে পরিণত করেছি দীর্ঘদিনের চর্চায়। যেভাবে প্রোথিত করেছি ধর্মীয় পরিচয়, সেভাবে প্রোথিত করতে পারি নি দার্শনিক চেতনা। আজ তারই মাশুল গুনছি।     

মূলত মেয়েটির উপর পরকীয়ার দায় চাপানো নিজেদের কিংবা সমাজের দায় এড়ানোর একটি কৌশল। আমরা, আমাদের সমাজেরই অধিকাংশ যেভাবে মেয়েটির অতীত কাসুন্দি ঘাঁটছি যাতে মেয়েটির সামান্য ত্রুটির উপর সব দায় ফেলে দিয়ে অস্বীকার করা যায় নিজেদের সব দায়িত্ব। এমন একটি  অসহনশীল খুনী প্রজন্ম তৈরি করার দায় এবং দায়িত্ব, কারো বিপদে এগিয়ে না আসা নির্বিকার প্রজন্ম তৈরি করার দায় এবং দায়িত্ব সবাইকেই নিতে হবে।

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সকল সংবাদ, ভিডিও ফুটেজ, ছবি সব কিছুতে স্পষ্ট প্রতীয়মান মিন্নি নামের মেয়েটি, খুনি রিফাত, নয়ন, নিহত রিফাত কারো বয়স পঁচিশের বেশি নয়। যে কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের জন্য এই বয়সের তারুণ্য বিশাল সম্পদ। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল নিয়ামক শক্তি। অথচ আমাদের দেশে এরা হয়ে উঠেছে সকল ক্রাইমের হোতা। মাদক থেকে অস্ত্র, চোরাকারবার থেকে সন্ত্রাস। খুন থেকে দখলদারি- যখন এভাবেই একটা দেশ এবং জাতি উন্নয়নের রঙিন চশমা চোখে এটে সাংস্কৃতিক বিকাশের পরিবর্তে চলে যাচ্ছে ধ্বংসের খাদে তখন আমরা এসব দুষ্কৃতির পেছনে ছলেবলে কৌশলে পরকীয়ার গন্ধ খুঁজে দায় এড়িয়ে যাচ্ছি।  

একদা পরকীয়ার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছিলো এইচ ডি লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’। পর্ণগ্রাফির অভিযোগ ছিলো বইটির বিরুদ্ধে। কিন্তু পরবর্তীকালে মুক্ত দৃষ্টকোণ আবিষ্কার করেছে- লেডি চ্যাটার্লির নিজ শ্রেণি অতিক্রম করে একজন শ্রমিকের সঙ্গে প্রেম ও যৌনতা মেনে নেয় নি তৎকালীন রক্ষনশীল সমাজ। যখনই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিবেচনায় এসেছে তখন উপন্যাসটি বিশ্ব ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে ‘বিষবৃক্ষ’, ‘চোখের বালি’র মতো অসংখ্য কালজয়ী উপন্যাসের ভিত্তিভূমি এই সোকল্ড পরকীয়া। পরকীয়া একটি সম্পর্ক যার পিছনে মনো-দৈহিক নানা কারণ বিদ্যমান থাকতে পারে এবং যার সবক’টি  মানবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসমৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব। তা না করে আমরা সব দায়িত্ব পরকীয়ার উপর দিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করছি। 

লেখক: নাট্যকার, গল্পকার, সংস্কৃতিকর্মী

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৯/তারা 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়