ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

তুমি নারী, আঙুলটি তোমার দিকেই || ইশরাত তানিয়া

ইশরাত তানিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৬, ৩০ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তুমি নারী, আঙুলটি তোমার দিকেই || ইশরাত তানিয়া

‘লাইক আ কম্পাস নীডল দ্যাট অলওয়েজ পয়েন্টস নর্থ, আ ম্যান’স অ্যাকুইজিং ফিঙ্গার অলওয়েজ ফাইন্ডস আ ওম্যান। অলওয়েজ। ইউ রিমেম্বার দ্যাট, মারিয়াম।’ অনেক বছর আগে খালেদ হুসেইনি’র উপন্যাস ‘আ হাউজেন্ড স্প্লেনডিড সানস’ পড়ছিলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম উপরের কয়েকটি বাক্য পড়ে। যেমন আজকে বসে ভাবছি!

হেরাত উপত্যকায় এক তাজিক ছোট্ট মেয়ে মারিয়াম আর তার মায়ের সংসার। মারিয়ামকে তার মা কথাগুলো বলেছিলেন, ‘মনে রেখো মারিয়াম, কম্পাসের কাঁটা যেমন সব সময় উত্তর দিক নির্দেশ করে, একজন পুরুষের তিরস্কারের আঙুল সব সময় একজন নারীকে খুঁজে নেয়।’

মিন্নিকে আমার মারিয়াম মনে হলো। এত বছর পরও আফগানমুলুকের নারী আর বাংলামুলুকের নারীর অভিন্নতা ঘোরতর অস্বস্তি গেঁথে দিল আমার চামড়ায়।            

শেষ পর্যন্ত রিফাত শরীফ রক্তক্ষরণে মরে গেল। ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাকে চোখ রাখলে দেখি বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কোপাকুপি। ভিডিও ক্লিপিং-এ পরিষ্কার দেখা গেলো রাম দা হাতে দুই তরুণ এক তরুণকে কোপাচ্ছে। কোপ খাওয়া তরুণের নাম রিফাত শরীফ। তার স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নি চিৎকার করছে। একবার এ কোপালে গিয়ে আটকাচ্ছে, আরেকবার ও কোপালে বাধা দিচ্ছে। স্বামী রিফাত স্ত্রী’র ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করেছিল। আপাতদৃষ্টিতে সে কারণেই একের পর এক কোপ উড়ে আসছে৷ এই অপ্রতিরোধ্য পৈশাচিকতা লোকজন দাঁড়িয়ে দেখছে। এদের মধ্যে কেউ হয়তো আক্রমণকারীদের সহচর। বাকিরা কেউ ছবি তুলছে। কেউ ভিডিও করছে। দিনের আলোর স্পষ্টতায় দেখা গেল সবকিছুই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দ্রুত একজনকে অভিযুক্ত করা হলো। অপ্রত্যাশিতভাবে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নি। এতে আর বিস্ময়ের কী আছে? দু’ চারটা কোপ যে ভুলেও মিন্নির গায়ে পড়েনি। ধারণা করে নেয়া হলো হত্যাকারীর সাথে বিয়ের আগে মিন্নির প্রেম ছিল। তাই প্রেমকাতর নয়ন মিন্নির গায়ে কোপ দেয়নি। সেই প্রেম এখনও আছে। তাই মিন্নিই খুনটা করিয়েছে। ঝটপট এই চাটনি চাখার সুযোগ হাতছাড়া করে কোন বোকা? অন্ধ? মূঢ়? এরই মধ্যে স্বাদে গন্ধে ভরপুর নানা পদের মুখরোচক ব্যাঞ্জন পাতের শোভা আর খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তুলছে। একে তো নারী। তাতে যদি হয় সুন্দরী; বয়সও কম, তাহলে তো কথাই নেই। নাও, এবার চোখেমুখে দুঃখিত, নাকেমুখে গোগ্রাসে খাও। খাদ্য তালিকায় প্রধান খাবার মিন্নির চরিত্র। সাইড ডিশ হিসেবে যুক্ত হলো খুনি নয়নের সাথে মিন্নির কেক মিষ্টি খাওয়ার গ্রুপ ছবি, সাংবাদিক সম্মেলনে মিন্নির চোখের কাজল আর বোরকাহীনতা। শেষ পাতে পড়ল রসে ডোবানো বিবাহপূর্ব প্রেমের কড়া মিষ্টির রসগোল্লা। পুরো রসগোল্লা তো বটেই, চিনির শিরার শেষ বিন্দুটুকুও মানুষ জিভছাড়া করতে নারাজ। বিয়ের আগে যেন কেউ কখনও প্রেম করেনি। যেন বিবাহপূর্ব প্রেম এই শতাব্দীর এক আশ্চর্য আবিষ্কার।

মিন্নির বিবাহপূর্ব প্রেম নিয়ে নারী-নর নির্বিশেষে সবাই ফেবু পুকুরে সাঁতার কাটতে নেমেছে। একেকটা ডুব দিয়ে উত্তেজনা আর আন্তরিকতার সাথে পাঁক-কাদা তুলে আনছে। নিউজ ফিডে মাখিয়ে দিচ্ছে পরমানন্দে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে (ফেসবুক) দেখছি শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, ধনী-গরিব, নারী-নর, পেশাজীবী-গৃহজীবী সব দলেদলে গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছে। মিন্নি শরীফ নামের ছয়টি আইডি পেলাম। ফেক আইডিগুলো খোলা হয়েছে আগে। এর মানে আগে থেকেই মেয়েটাকে উত্যক্ত করা হচ্ছিল। সেখানে যে যার ইচ্ছা মতো কুরুচিপূর্ণ ভাষায় মিন্নি-নয়নের প্রেম আর প্রেমের ফলে হত্যার মতো অপরাধের বিচার শালিশ করছে। কেউ কেউ নিজের টাইম লাইনে মিন্নির চরিত্র হনন করছে। তাদের পোস্ট এবং পোস্টের তলায় মিন্নিকে নিয়ে কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ, বিশ্লেষণ প্রকাশের ভাষা, ভাষায় অজস্র বানান ভুল- এইসব ছাপিয়ে সারবস্তু যা পেলাম, তা হলো মিন্নি ‘চরিত্রহীন’ নারী। যেন কোথাও কেউ খুন হয়নি, বরগুনা নামের কোনো জেলা নেই, আইন নেই, দেশ নেই, পৃথিবীই নেই। আছে বিয়ের আগে প্রেম করা চরিত্রহীন এক ও অদ্বিতীয় মিন্নি আর মিন্নির মিষ্টি/কেক, কাজল, পোশাক।    

একজন পুরুষ লিখল: ‘মেয়েটা কোন সতী সাবিত্রী না, যে ছেলেটা দা হাতে কোপাচ্ছে ঐ মেয়ে সেই ছেলেরই বউ ছিল।’ কেউ লিখল: ‘এক বিয়া না দুই বিয়া? কে স্বামী, কে প্রেমিক?’ ‘মেয়ে নাকি মাগী? এদের জন্যই সমাজের এই অবস্থা।’ এটাও আমরা দেখলাম, একজন নারী খবরের লিঙ্কের নিচে লিখল: ‘যাই হোক না কেনো, কোপানো উচিত ছিল মেয়েটারে।’  মিন্নির উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়া মন্তব্যগুলো পড়লেই নির্দ্বিধায় বলা যায় মিন্নি ‘মিসোজিনি’র শিকার। এক্ষেত্রে নারীর প্রতি বিদ্বেষ আর রাগের আচরণিক দিকই যে শুধু প্রকাশিত হয়েছে তা নয়, নারীকে নিজের চেয়ে হেয় মনে করার ইঙ্গিতটিও বোঝা গেছে। আরও গভীর ভাবনার বিষয় এই, পুরুষের সাথে সাথে নারীও কেন নারীর চরিত্র হননে ব্যস্ত? পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার এই আগ্রাসন এতোই সূক্ষ্ম আর কৌশলী যে নারীরাও নারীকে অভিযুক্ত করে অনায়াস অক্লেশে।

এই হলো জেন্ডার পলিটিক্স। সমাজ ব্যবস্থা যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক, নারীকে দেখার নারীচোখটিও তাই মেল শোভিনিস্ট। ‘পুরুষ শ্রেষ্ঠতম’, ‘নারীই সকল নষ্টের মূল’- নারীর ভেতর এই বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি  আর উপলব্ধি তৈরী করে দিয়েছে পুরুষতন্ত্র। একই সাথে বেড়ে ওঠা ভাই-বোনের মধ্যে বোনটি অধিক মানবিক আর যোগ্যতাসম্পন্ন হলেও মাছের মাথা আর মাংসের বড় টুকরোটি তাই ভাইয়ের জন্যই বরাদ্দ। মিন্নির মতোই আরেক আছে তিন্নি। স্বামীর অত্যাচারের কথা বলেও যে তার শিক্ষিত মায়ের কাছে আশ্রয় পায়নি। মা ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে স্বামীগৃহে। কারণ পুং শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী আমজনতা অর্থাৎ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সম্মিলিত স্বরে বলবে- মেয়েটারই দোষ। চরিত্র খারাপ। প্রেম-পরকীয়া ইত্যাদি। এসব অভিজ্ঞতা থেকেই মা বলে দেয়- মুখ বুঝে সইতে। আজ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তিন্নি ফের মায়ের কাছেই। আসলে মেয়েদের কোথাও কোনো ঘর হয় না। আর হ্যাঁ, বলাবাহুল্য এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তিন্নির পুনর্বাসন বা চিকিৎসার দায় বা দায়িত্ব কোনটাই নেয়নি।       

এবার মিন্নির প্রসঙ্গে আসি। এবারও আমজনতা বলছে- মিন্নিই অপরাধের গোড়া। রিফাত খুন হয়েছে মিন্নির জন্য। নয়ন খুন করেছে মিন্নির জন্য। আবহমান কাল থেকেই অন্যকে টেনে নামিয়ে নিজের উচ্চতা বাড়ানোর প্রবণতা আমাদের স্বভাবজাত। নারী হলে নামানোটা সহজ। বিচার-বিবেচনা না করে, যুক্তির ধারে কাছে না গিয়ে দোষটা চাপিয়ে দেয়া যায় নারীর ওপর। বিশেষ করে নারীকে চরিত্রহীন প্রমাণ করতে পারলে নিজের চরিত্রে গৌরব যোগ হয়। রিফাত হত্যার পর মিন্নির সঙ্গে এই ঘটনাটিই ঘটেছে। রিফাত হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনাটিকে সার্বিকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক এবং আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। প্রাসঙ্গিকভাবে আসতে পারে বিশ্বজিৎ, অভিজিৎ, নুসরাতের কথা। এই প্রেক্ষিতগুলো পরে কোথাও আলোচনা করা যাবে। আপাতত মূল বিষয়ে ফিরি। মিন্নি অপরাধী নাকি নির্দোষ সেই রায় দেবার আমরা কেউ নই। হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার। আইনগত প্রক্রিয়ায় যদি মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বা রিমান্ডে নেয়া হয় সেটা নিয়েও কিছু বলার নেই। কিন্তু দোষ প্রমাণের আগেই দোষী সাব্যস্ত করার প্রবণতা নিয়ে বক্তব্য আছে। একজন মানুষ বিয়ের আগে প্রেম করতেই পারে, সেটা একাধিকও হতে পারে। প্রেম করা অন্যায় না। প্রেমিক-প্রেমিকার মিষ্টি, কেক, চটপটি, ফুচকা খাওয়াও অন্যায় না। ছবি তোলা বেআইনি কাজ না। এতে কারো চরিত্র ধসে পড়ে না। বিয়ের আগে মিন্নি্র সাথে নয়নের প্রেমের সম্পর্ক থাকতেই পারে। একসাথে ওরা মিষ্টি বা ঝাল খেতে পারে। তাহলে কেন বিয়ের আগে প্রেম করার জন্য মিন্নিকে চরিত্রহীন বলা হচ্ছে? কেন বলা হচ্ছে- মিন্নিকে কোপানো উচিত? নয়নের ইভ টিজিং-এর শিকার মিন্নি অথচ তাকে কখনও স্বামীহত্যাকারী, কখনও স্বামীহত্যার প্ররোচক বলা হচ্ছে। কথা হলো, মিন্নি যদি নয়নের সাথে প্রেমে প্রতারণা করে থাকে এবং ভিকটিম নয়ন যদি প্রতারণা সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা করে তবে সেটার বিচার হবে। দুটো ঘটনা গুলিয়ে ফেলা যাবে না। মিন্নির প্রতি নয়নের প্রেমকাতরতা কোনোভাবেই প্রকাশ্যে (আড়ালে) রিফাত শরীফকে খুন করার ন্যায্যতা দিতে পারে না।

বাস্তবে দেখা গেল রিফাত শরীফের নির্মম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চেয়ে আয়েশা আক্তার মিন্নির চরিত্রহীনতা অধিক গুরুত্ববহ। আমাদের কাণ্ডজ্ঞান তো নেই-ই, এটাও জানি না যে, তদন্তনাধীন বিষয়ে ধারণামূলক মন্তব্য করলে আসল অপরাধের গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়। তদন্তকারী কর্মকর্তা জনতার তোপের মুখে যেন পড়তে না হয়, সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে যান। ব্যাপারটির প্রভাব আরও জটিল এবং ভয়াবহ। ইন্টারনেটের প্রসার ও সহজলভ্যতার কারণে আজকাল একজন মানুষের ধারণামূলক মন্তব্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। সমাজে সেই ধারণার সঙ্গে সম্মত হবার মানুষও প্রচুর। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ঢালাও মন্তব্যে, আলাপচারিতায় তদন্ত ব্যাহত হয়। ঘটনা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হবার আশঙ্কা থাকে। প্রকৃত অপরাধী আড়ালে চলে যাওয়ার সুযোগ পায়। পর্যাপ্ত সময় পায় অপরাধ সংশ্লিষ্ট সাক্ষ্য এবং আলামত নষ্ট করার। স্বাভাবিকভাবেই ভিকটিম আর ন্যায়বিচার পায় না বরং অনেক সময় সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে, একঘরে হবার ভয়ে শেষতক মামলা আপস-রফা করে ফেলে। তাই অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয় না। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে বিচার হলেও অপরাধীরা শাস্তি পায় না। শাস্তি পেলেও সেটা হয় গুরু পাপে লঘুদণ্ড। এই সমাজ ব্যবস্থায় তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না।

কারণে-অকারণে সর্বত্রই নারী অভিযুক্ত। অভিযোগের অঙুলিনির্দেশ করা হয় নারীর দিকেই। মিন্নি এর এক উদাহরণ মাত্র। বিচার ব্যবস্থার ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে বলছি- তদন্তের স্বার্থেই আয়েশা আক্তার মিন্নির বিরুদ্ধে বিবাহপূর্ব প্রেম ও স্বামীহত্যার অভিযোগ বন্ধ করা হোক। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্লক করা হোক ‘মিন্নি শরীফ’ নামক ফেক আইডিগুলো। মিন্নিকে ‘উইচ হান্টিং’-এর অপতৎপরতা থেকে রক্ষা করার জন্য নারী সংগঠন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো এগিয়ে আসুক। আশা করছি, যে রাষ্ট্রের প্রধান একজন নারী সেই রাষ্ট্র সাহসী মিন্নিকে সুরক্ষা দেবে। যাতে প্রকৃত সত্য আলোর সামনে আসে। যাতে রিফাতকে নৃশংসভাবে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা খুনিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়।

লেখক: গল্পকার

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়