ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মানুষের কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করুন || প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৮ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মানুষের কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করুন || প্রভাষ আমিন

ডেঙ্গু মহামারী কিনা- এই নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। বিশেষজ্ঞরা মহামারীর সংজ্ঞা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বলছেন, দুই কোটি লোকের মহানগরীতে কয়েক হাজার মানুষ কোনো রোগে আক্রান্ত হলে তাকে ‘মহামারী’ বলা যাবে না। বিশেষজ্ঞরা যাই বলুন, রোগ হিসেবে ডেঙ্গু মহামারী না হলেও, ডেঙ্গুর আতঙ্ক ছড়িয়েছে মহামারী আকারেই। হাসপাতালগুলোতে এখন উপচেপড়া ভিড়, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেও ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই দশা। ডাক্তাররা বলছেন, সতর্ক হতে হবে, তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ডাক্তাররা বললেও মানুষের আতঙ্ক কমছে না।

এতদিন ডেঙ্গু ছিল ঢাকার রোগ। এবার তা ঢাকার বাইরে অন্তত ১০ জেলায় ছড়িয়েছে। সবাই জানেন, এডিস অভিজাত মশা। অভিজাত এলাকায়, পরিষ্কার পানিতেই এর আবাস। দেশের যেসব শহরে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে, এডিস মশা পৌঁছে যাচ্ছে সেখানেও। আবার অনেকে ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে অন্য শহরে যান, সাথে নিয়ে যান ডেঙ্গুর জীবাণু। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অন্য মশা কামড়ালে, পরে সেই মশা অন্য কাউকে কামড়ালে তিনিও ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারেন। তাই এডিস মশা না কামড়ালেও আপনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন।

ডাক্তাররা যতই বলুন, মানুষ আতঙ্কিত হচ্ছে। কারণ নিছক সতর্কতায় তারা পাড় পাচ্ছেন না। অনেক সতর্ক থাকার পরও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। আপনি আপনার বাসা, বাসার আশপাশ পরিষ্কার রাখতে পারবেন। কিন্তু আপনার সন্তানের স্কুল, কোচিং, আপনার অফিস, বাজার সব তো পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব নয়। তাই মানুষ অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। কাকে যে কখন এডিস মশা কামড়াবে, কে যে কখন ডেঙ্গু আক্রান্ত হবেন; তার কোনো গ্যারান্টি নেই।

ডেঙ্গু সিরিয়াস বিষয়। এটা নিয়ে হাসিঠাট্টার সুযোগ নেই। বিশেষ করে দায়িত্বশীল পদে যারা আছেন, তাদের কাছ থেকে লোকজন দায়িত্বশীল মন্তব্যই আশা করে। আপনি মশা মারতে পারেননি। সেই মশার কামড়ে আমাদের ডেঙ্গু হয়েছে। এখন আপনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারুন আর না পারুন; এমন কিছু বলবেন না; যা আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়। এই অসুস্থতার সময়ে আমরা চাই মমতার হাতটা কেউ কপালে রাখুক। কিন্তু আমাদের দায়িত্বশীলদের যথেষ্ট সংবেদনশীল মনে হচ্ছে না। ডেঙ্গুর বিস্তারের কারণ ব্যাখ্যা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘এডিস মশাগুলো অনেক হেলদি এবং সফিস্টিকেটেড।’ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মশার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। যেভাবে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ছে, আমাদের দেশে সেভাবে মশার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। প্রজনন কম হলে এডিস মশা কম হতো। মানুষ মশার কামড় কম খেত। ডেঙ্গু কম হতো।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হিউমার সেন্স ভালো। তবে এখন নাগরিকদের রোহিঙ্গা আর মশার প্রজনন ক্ষমতার তুলনামূলক চিত্রের রসাস্বাদন করার মত পরিস্থিতি নেই। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ মশার জন্মনিয়ন্ত্রণের নানান জটিলতা নিয়ে রসিকতা করছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা মশা মারতে না পারার কারণ হিসেবে আদালতে বলেছেন, ‘উত্তরে ওষুধ দিলে মশা দক্ষিণে যায়, আবার দক্ষিণে ওষুধ দিলে মশা উত্তরে যায়। এতে করে মশা নিধন সম্ভব হয়নি।’ তার কথায় মশা মারা নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের সমন্বয়হীনতাটা ফুটে উঠেছে। মশা উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে পারে কি পারে না, সেটা নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। আমরা চাই মশা মারা হোক। উত্তর হোক, আর দক্ষিণ; মশা তো কামড়ানোর সময় দেখে কামড়াবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বর্তমানে ডেঙ্গু যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, এখানে দল দেখে এডিশ মশা কাউকে কামড় দেবে না। কাজেই সবাইকে বিষয়টি নিয়ে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।’

মশা মারতে হবে- সবাই জানি। কিন্তু মশাটা মারবো কীভাবে? মশা মারার ওষুধ কেনা নিয়ে নানান নয়-ছয়ের গল্প শুনি। এখনকার ওষুধে নাকি মশা মরে না- আইসিডিডিআরবি গবেষণা করে এটা বলেছে। যদিও ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন এটা মানতে রাজি নন। তার দাবি ওষুধ ঠিক আছে। ঠিক থাকলে, খুব ভালো। ঠিক আছে নাকি নাই, ওষুধ পুরোনো না নতুন; তা নিয়ে আমার আপাতত কোনো আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ মশা মরলো কিনা। বাস্তবতা হলো, মশা মরেনি। মরলে মানুষ সব দল বেঁধে হাসপাতালে যেতো না। মানুষ নিশ্চয়ই মনের আনন্দে হাসপাতালে বেড়াতে যায় না। তবে সাঈদ খোকনের একট বক্তব্য সংবেদনশীলতার সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন বলেছেন, ‘ছেলেধরা নিয়ে যে গুজব রটেছে, এটিও (ডেঙ্গুর বিস্তার) সে রকম।’ ডেঙ্গুর বিস্তারের সাথে ছেলেধরা গুজবের তুলনা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। ডেঙ্গু রোগী বা তাদের স্বজনরা এখন এ ধরনের কথার মারপ্যাঁচ শোনার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। 

আল্লাহ আমাদের দুটি কান দিয়েছেন, জিভ দিয়েছেন একটি; যাতে আমরা শুনি বেশি, বলি কম। কিন্তু আমরা সবাই উল্টোটা করি। কারো কথা শোনার ধৈর্য্য কারো নেই। সবাই বলতে চাই। সাধারণ মানুষ যাই হোক, দায়িত্বশীলদের কথা বলার ব্যাপারে আরো সতর্ক থাকা উচিত। বেশি কথা বললে, ভুল বেশি হতে পারে। কোনো একটা কথা হয়তো, ভুলে বলে ফেললেন; যেটা আর ফেরানোর সুযোগ নেই। যারা বেশি কথা বলেন, তাদের অসংবেদনশীল কথা মানুষের বেদনা আরো বাড়ায়। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মশার প্রজননের সাথে রোহিঙ্গাদের প্রজননের তুলনা করেছেন, আর মেয়র ডেঙ্গুর বিস্তারের সাথে তুলনা করেছেন ছেলেধরা গুজবের। অবশ্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের এই মন্তব্যের দায়িত্ব নেয়নি। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটা তাদের নিজেদের মতামত হতে পারে। দেখুন, বেশি কথা বললে, আপনিই বিপদে পড়বেন। আর বিপদে পড়লে দলকেও পাশে পাবেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর মেয়রের তুলনামূলক মন্তব্য প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সবার দায়িত্বশীল কথাবার্তা বলা উচিত। কথা বেশি না বলে সকলে কাজে মনোনিবেশ করবেন, এটাই আমি নেতাকর্মীকে আহ্বান জানাচ্ছি।’

খুব ভালো পরামর্শ। এখন এই পরামর্শ মনে রেখে যার যে কাজ তা দায়িত্ব নিয়ে পালন করলে মানুষ অন্তত স্বস্তি পাবে। বিনয়ের সঙ্গেই বলছি- মাননীয় মন্ত্রী, মাননীয় মেয়র; আপনারা একটু সামলে কথা বলুন। সবচেয়ে ভালো হয়, কথা না বলে, মশা মারা।

 

 

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়