ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তিতাসের মৃত্যু এবং ভিআইপি’র দায়

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫১, ৩০ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তিতাসের মৃত্যু এবং ভিআইপি’র দায়

অলোক আচার্য: আমাদের দেশে মানুষের কত রকম শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। খুব স্বাভাবিক হিসেবে এই পার্থক্য সাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষ হলো খেটে খাওয়া মানুষগুলো আর যারা অর্থবিত্ত আর পদমর্যাদার অধিকারী তারাই এদেশে অসাধারণ মানুষ। তাদের সুযোগ সুবিধা সবার আগে নিশ্চিত হয়। ভিআইপি, ভিভিআইপি, সিআইপি আর সাধারণ মানুষ। পদমর্যাদা, অর্থবিত্ত এসব মর্যাদার ধারক। এসব পদমর্যাদাই নির্ধারণ করে সমাজে কে কীভাবে বেঁচে থাকবে। যার পদমর্যাদা যত বড় তার এই সমাজে সুযোগ সুবিধা সবচেয়ে বেশি। এটাই সিস্টেম। নানা প্রটোকলে পূর্ণ থাকে ভিআইপিরা। ভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতেই ব্যস্ত থকাতে হয় অনেকের। অথচ এমন উন্নত দেশের নজিরও আছে যেখানে মন্ত্রীদের কোনো গাড়ি দেয়া হয় না। সাধারণের মতোই তারা চলাফেরা করেন। কোনো অনুষ্ঠান, সভা সেমিনার যাই হোক না কেন এসব ভিআইপিদের জায়গা হয় সবার আগে বা মঞ্চে। আর জনগণ দর্শকের চেয়ারে বসে তাদের অমৃতবাণী শ্রবণ করে হাতে তালি দেয়। সবই সিস্টেম! সব মানুষই সমান হলেও কেবল তার সামাজিক অবস্থানের জোরে তিনি সমাজের আর দশটা মানুষের থেকে আলাদা। তিনি যে গাড়িতে চড়বেন সেটি সবার আগে যাবে, তিনি যে আসনে বসবেন তা হবে আরামদায়ক। এক কথায় তার সুযোগ সুবিধা ভিন্ন। কারণ তিনি তো আর সাধারণ কেউ নন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা এসব সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাদের ফোনের জোরও অনেক। মৃত্যুপথযাত্রী কোনো মানুষের আর্তনাদও এসব প্রটোকলে বাধা হতে পারে না।

এই যেমন মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ১ নং ফেরিঘাটে গত বৃহস্পতিবার রাতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত নড়াইলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যু আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তার স্বজনরা তাকে ঢাকায় আনছিল। কিন্তু সেই ফেরিঘাট দিয়ে সেদিন পার হওয়ার কথা ছিল এক ভিআইপির। তাই সেই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা যখন তিন ঘণ্টা দেরিতে আসেন ততক্ষণে তিতাসের জীবন প্রদীপ শেষ। ঢাকায় নেয়ার আগেই তো তিতাস চলে গেল। কিন্তু তার আগে জেনে গেল এদেশে আবার জন্ম নিতে হলে তাকে সেই সিস্টেমের ফাঁদে পড়তে হবে। অথচ তারা তিনঘণ্টা ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে কাকুতি মিনতি করেছে ফেরি ছাড়ার জন্য। কিন্তু তারা সেই ভিআইপির জন্য ফেরি ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়। ওপরের নির্দেশ বলে কথা! এমনকি জরুরি নাম্বারে ফোন করেও প্রতিকার হয়নি সমস্যার। কারণ ওপরের নির্দেশ যে বেদবাক্যের মতো! এখন সেই রোগীর পরিবার কাকে দোষ দেবে? সেই ভিআইপি যার জন্য ফেরিঘাটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মৃত্যুপথযাত্রী একজনকে তিন ঘণ্টা আটকে রাখলো, সেইসব দয়ামায়হীন ঘাট কর্তৃপক্ষ নাকি এই সমাজের সিস্টেমকে। যে প্রভেদের সিস্টেমের কবলে মাঝে মধ্যেই সাধারণ মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়। ফেরি কিন্তু অনায়াসেই তিতাসকে নিয়ে রওনা হতে পারতো। যেখানে পাঁচ-দশ মিনিটের জন্যে কারও জীবন বাঁচানো যায় সেখানে তিন ঘণ্টা অবহেলার জন্য অনেক অনেক সময়। এত দীর্ঘ সময় রক্তক্ষরণে তিতাসের শরীর সহ্য করতে পারেনি। ঠিক সময়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হলে হয়তো তিতাসকে বাঁচানে যেতো। ফেরিটি যদি তিতাসকে নিয়ে পৌছে দিত তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো? যদি সেই ভিআইপি কর্মকর্তাই ঘাটে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতো তাহলে কি দেশের বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো? মানুষের জীবন চলে যাওয়ার চেয়ে বড় কোনো ক্ষতি আর হতে পারে না। একদিন না হয় সমাজের উধ্বতন কেউ সাধারণ মানুষের জন্য একটু সময়ের অপচয় করলো। তাতে কোনো ক্ষতি হবে না।

ঘুষ খেয়ে ফ্ল্যাট বাড়ি গাড়ির মালিক হয়ে কত বড় বড় কর্মকর্তার ছবি পত্রিকায় দেখি। কোনো গরীব খেটে খাওয়া সেই মানুষগুলোর দুর্নীতির ছবি বা খোঁজ আমরা পাইনি। অথচ এরাই সবার পেছনে পড়ে থাকে। মানবিকতা, মূল্যবোধ এবং সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে আমরা কবে আর বেরিয়ে আসতে পারবো জানি না। মান মর্যাদা, সামাজিক উঁচু-নিচু প্রভেদ, ধনী-গরিবের প্রভেদ, বর্ণে বর্ণে প্রভেদ এরকম আরো কত ভেদাভেদে মানুষের আজ দফারফার অবস্থা। তিতাসের মারা যাওয়ার পরেও সমাজের কোনো পরিবর্তন হবে না। মানুষের বিবেক জাগবে না। সমাজের প্রভেদ দূর হবে না। মানুষে মানুষে পার্থক্য করার এই যে প্রথা তা একদিনে তৈরি হয়নি। সভ্যতা যত এগিয়েছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তত বেড়েছে। মানুষকে আলাদা করা হতে লাগলো শরীরের রংয়ের ভিত্তিতে, আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে, সামাজিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে। তারপর এক শ্রেণি নিয়মিত নিষ্পেষিত হতে লাগলো বিপরীতে অন্য শ্রেণি সমাজের সুযোগ সুবিধা পুরোদমে ভোগ করতে লাগলো। যাদের শ্রমে বড় বড় দালানকোঠা নির্মাণ হলো সেসব দালানকোঠায় আরাম আয়েশ করতে লাগলে সমাজের উঁচুস্তরে থাকা মানুষগুলো। এভাবে সভ্যতা এগিয়ে চললো। কিন্তু মানসিকতা পরে রইলো সেই আদিম যুগেই। তাইতো আমাদের দেশে আজ সমাজের মানুষের সাথে মানুষের এতটা পার্থক্য। কেউ সবার আগে চলবে কেউ যাবে সবার পেছনে। কোথায় সেই নীতিবাক্য, কোথায় সেই বইয়ের বুলি— সব মানুষই সমান, সব মানুষের সমান অধিকার। সব যেন মানুষের তৈরি নিয়মের কাছে পদানত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত তিতাস বাঁচতে চেয়েছিল। সঠিক সময়ে তাকে হাসপাতালে পৌছাতে পারলে তার কি হতো তা বলতে পারবো না। যদি ফেরিটি তিতাসকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হতো তাহলে পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম অন্যরকম হতে পারতো। কোথায় আজ মানবাধিকার, কোথায় আজ সেইসব মানুষ যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে চিৎকার করে। তিতাসের বেলায় কি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়নি। তার কি ওই সময় ফেরির সেবা পাওয়ার কথা ছিল না। সমাজের এক অনন্য নজির হয়ে থাকতো এই ঘটনা। যদি সেই ভিআইপি অসুস্থ তিতাসের জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতেন তাহলে কেমন হতো? মানুষ বুঝতে পারতো এই সমাজে তাদেরও সমান অধিকার আছে। উঁচু পদে থাকা মানুষেরা তাদের নিয়ে চিন্তা করে।

মোট কথা সমাজের এই নিয়মটার একটু ইতিবাচক পরিবর্তন হলে, মানসিকতার পরিবর্তন হলে সমাজটাই পাল্টে যেতো। যে সমাজে মানবিকতার বালাই নেই, মনুষ্যত্বের মূল্য নেই সেই সমাজে মানুষের ঠাঁই নেই। সবাই মিলে নিজেদের বিবেকটা একটু জাগাই, মানুষকে প্রাধান্য দেই তাহলে আর তিতাসের মতো কাউকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সকে কোনো ভিআইপির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। বরং ভিআইপিরাই ভালোবেসে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুলাই ২০১৯/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়