ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মোজাফফর আহমদ : আদর্শিক মহীরুহের প্রস্থান

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ২৪ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মোজাফফর আহমদ : আদর্শিক মহীরুহের প্রস্থান

অজয় দাশগুপ্ত : তিনি ছিলেন প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিং যুগের মানুষ। ছবি দেখলেই বুঝবেন- সারল্য আছে, আছে প্রাণখোলা ভাব; কথা বলতেন জমিয়ে। বাংলাদেশে যে ক’টি রাজনৈতিক দল থাকলে; মানে মাঠে থাকলে আমরা লাভবান হতাম ন্যাপ তার একটি। আমাদের যৌবনে তিনি এবং তাঁর সহকর্মী পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন আদর্শ আর প্রেরণার প্রতীক।

আমি বলছি, কমরেড মোজাফফর আহমদের কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল বহুদলীয় মতের ভিত্তিতে। সে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন অনেক দলের নেতা কর্মী। ন্যাপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘেঁষা কমিউনিস্ট পার্টি ছিলো তাদের অন্যতম। এদের স্বপ্রাণ অংশগ্রহণ আর ত্যাগ মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছে। আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় গুণ ছিলো মানুষ চেনা। চিনতেন বলেই মোজাফফর আহমদকে উপদেষ্টা হিসেবে রেখেছিলেন। এবং তিনি ও তাঁর দল শেষদিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার প্রতি অনুগত ছিলো। ছিলো বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

মোজাফফর আহমদ কখনও স্বার্থ আর গদীর জন্য রাজনীতি করেননি। কথাটা ভালোভাবে বুঝতে হলে আগে তিনি কীভাবে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে রাজনীতি করতে এলেন তার শুরুটা জানতে হবে। 

১৯৩৭ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলনের নেতৃত্বে আছেন ভারতের মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। আদর্শবাদী সাধু পুরুষ। সবার কাছে তিনি পরিচিত মহাত্মা গান্ধী নামে। তিনি দেশ সফরে বেরিয়েছেন। আসবেন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লায়। চান্দিনায় জনসভা। পার্শ্ববর্তী উপজেলা দেবীদ্বারের কিশোর মোজাফফর আহমদ পায়ে হেঁটেই রওনা দিলেন জনসভার উদ্দেশ্যে। কিন্তু জনসভাস্থলে পৌঁছার আগেই সভা শেষ হয়ে গেল। মোজাফফর পথিমধ্যে একথা শুনে সভা ফেরত লোকদের কাছে জানতে চাইলেন, মহাত্মা গান্ধীজী কী বলেছেন? লোকেরা উত্তর দিলো, তিনি বক্তৃতা নয়, বাণী দিয়েছেন। বাণীতে বলেছেন, হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে যাও। ব্রিটিশ তাড়াও। নিজেরা ভেদাভেদ করলে ইংরেজ তাড়াতে পারবে না। কৌতূহলী মোজাফফর জানতে চাইলেন, আর কী বলেছেন? লোকেরা এবার উত্তর দিলো, গান্ধীজী আর কিছু বলেননি।

মুগ্ধ হয়ে গেলেন কিশোর মোজাফফর আহমদ। মনে মনে ভাবলেন- এমন নেতাই তো চাই। যারা কথা কম বলেন, কিন্তু কাজ বেশি করেন। সেদিনের সেই কিশোর পরবর্তী সময়ে সারাজীবন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণ করে এসেছেন। তাকে দেশবাসী গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ময়দানে, জনসভায়, মিছিলে লুঙ্গি পরে ছুটতে দেখেছে। হ্যাঁ, প্রথাবিরোধী রাজনীতিবিদ মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা ছিল এমনই।

মোজাফফর আহমদ যে আদর্শের জন্য লড়েছিলেন তার প্রতি আমাদের আস্থা থাকলেও স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সরকার তা রাখতে পারেনি। আজ সত্য বলতে হলে বলতে হয় ৭৩-এর নির্বাচনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কেন্দ্রে জেতা ন্যাপ প্রার্থীকে জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ সেদিন যদি এই পরাজয় মেনে নেয়া না হতো ন্যাপের রাজনীতি ঐ এলাকায় বৃদ্ধি পেতো। তাতে কী হতো? অন্তত আজকের মতো ঐ এলাকা জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি হতে পারতো না। যেমন করে দাউদকান্দিতে পরাজিত খন্দকার মোশতাককেও জিতিয়ে আনা হয়েছিল। আর সে ফিরে আসার মাশুল আমরা গুনেছি পঁচাত্তরে।

মোজাফফর আহমদ সত্য বলতেন সাহস করে। সে কারণে আইয়ুব আমলে যেমন হুলিয়া থাকায় আত্মগোপন করেছিলেন, একইভাবে আত্মগোপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর। প্রলোভনে মন্ত্রী হবার খায়েশ ছিলো না বলেই চলে গিয়েছিলেন লোকজনের চোখের আড়ালে। সম্বল কেবল রিকশা ভাড়া। মন্ত্রী তিনি বঙ্গবন্ধু আমলেও হতে পারতেন। সে প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কেন? স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাল্যবন্ধু মোজাফফর আহমদকে আমন্ত্রণ জানালেন মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে। যদিও বা রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন ছিল, তথাপি তাদের বন্ধুত্ব ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, বিরোধী দলে থেকেই আমি স্বস্তি পাব। ‘ইগো প্রব্লেম?’ তিনি কি ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁর স্ত্রী আমিনা আহমদ বলেছিলেন, ‘তা নয়। তখন বঙ্গবন্ধুর আশেপাশে এমন কিছু সুবিধাবাদীর দাপট, তিনি (মোজাফফর আহমদ) সেখানে গেলেও কোনো কাজ করার সুযোগ পেতেন না।’

আবার এই মানুষ ৮১ সালে জিয়াউর রহমানের লৌহকঠিন শাসন আমলে নির্বাচন করে মানুষকে ভরসা যুগিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘কুঁড়েঘর’ মার্কায় প্রার্থী হন। ‘আমার নাম মোজাফফর, মার্কা আমার কুঁড়েঘর’ এই স্লোগানে দোকানে দোকানে তাকে সহজ সরলভাবে ভোট চাইতে দেখা গেছে। যদিও পাতানো সেই নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছিল মাত্র এক শতাংশ। তথাপি বন্দুকের নলের দিকে বুক তাক করা সেই সাহসী রাজনীতি ইতিহাসে দাগ রেখেছে।

আরো একটা ঘটনার কথা বলি। খালি চাই আর চাইয়ের সমাজে আমরা কি এমন কাউকে দেখি যিনি কিছু চান না? বা পেয়েও বলেন- আমি নেবো না? চোখ মেলে দেখুন কবি-সাহিত্যিক, নায়ক-গায়ক, নেতা-আভিনেতা সবাই কেমন করে চান। কত আকুল হয়ে মোসাহেবী করে যদি একটা পদক জুটে যায়। যদি মেলে আনুকুল্য। আর তিনি? ২০১৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদক পেয়েও নিলেন না। আর না নিয়ে হয়ে উঠলেন সংবাদ শিরোনাম। কোনো কোনো সময় জীবনে না পাওয়া বা না নেয়াটাও যে গৌরবের আমরা তা ভুলে যাই। বিশেষ করে যখন তিনি বলেন, আমি তো পদকের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এমন কথা বলার মানুষ দেশে আর  ক’জন আছেন?

চাঁদের কলঙ্কের মতো দু’একটা ভুল তাঁরও ছিলো। যেমন- কেন তিনি খাল কাটা সমর্থন করেছিলেন আজো তা বুঝে উঠতে পারিনি। আর একটি হচ্ছে, সমাজতন্ত্রের সাথে ধর্মকর্ম ও সমাজতন্ত্র যোগ করা। এই স্লোগান যে ব্যর্থ হয়েছিল তাও দেখেছি আমরা। তারপরও তিনি আদর্শবান। সে কারণেই জাসদ, বাসদ কিংবা চৈনিক বামদের মতো কোনো সেনানায়ক, খালেদা জিয়া কিংবা আওয়ামী লীগের হাতে পায়ে ধরে বা আঁতাত করে মন্ত্র হননি। মন্ত্রী হওয়া এখন যে আর কোনো গৌরবের ব্যাপার না সেটা তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর এককালের নেতা কমরেড মণি সিংহ বলতেন, মানুষ বাঁচে আশা নিয়ে আর কমিউনিস্টরা মারা যায় আশা বুকে ধারণ করে। কমরেড মোজাফফর আহমদ পরিণত বয়সে কি আশা বুকে ধারণ করে চলে গেলেন জানি না। তবে এটুকু জানি তাঁর স্বপ্ন আদর্শ কিংবা চেতনার স্বদেশ এখনো অনেক দূরের তারা। যদি পথ খুঁজে পাওয়া না যায়, যদি অন্ধকার ঘনীভূত হতে হতে সবকিছু ঢেকে দেয় তখন এরাই আমাদের আলোকবর্তিকা।

সহজ জীবনের সবল নেতা কমরেড মোজাফফর আহমদ আপনাকে সালাম।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়