ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

উদয়তারার আলো দিয়ে বোনা শাড়ি || পাপড়ি রহমান

পাপড়ি রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১১, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উদয়তারার আলো দিয়ে বোনা শাড়ি || পাপড়ি রহমান

 

‘আমার উদয়তারার শাড়ি ছিঁড়েছে কবে?
কামরাঙা শাখা আর হাতে কি রবে?’

আহা! কবি হৃদয় বড় বিষণ্ণ! উদয়তারার আলো দিয়ে বুনে তাকে উপহার দেয়া শাড়িটা কবে কীভাবে যেন ছিঁড়ে গিয়েছে!
প্রেমিক চাঁদকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে তাই আঁধারকে সঙ্গী করে নিচ্ছে সে- এ বড় বিষম জ্বালা!

শাড়ি ভারত, বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের ঐতিহ্যবাহী ও নিত্যনৈমিত্তিক পরিধেয় বস্ত্র। শাড়ির মতো পোশাকের ইতিহাস পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতায়। শাড়ি শব্দটি জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে মহিলাদের পোশাক হিসেবে উল্লিখিত ‘সাত্তিক’ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। শাড়ি বা সাত্তিক নিচের পোশাক অন্ত্রিয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি তিন অংশের পরিধেয় পোশাক। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর সংস্কৃত ও বৌদ্ধ পালি সাহিত্যে শাড়ির উল্লেখ আছে। প্রাচীন ধুতিসদৃশ অন্ত্রিয় মাছের লেজের মতো পেঁচিয়ে পরা হয়। যা ঢিলেভাবে পা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে নিম্নাংশ আবৃত রাখে।

প্রাচীন ভারতে মহিলারা মধ্যাচ্ছাদন হিসেবে শাড়ি পরার পরও ধর্মশাস্ত্র লেখকরা এমন বলেছিলেন যে, ‘নারীদের এমন পোশাক পরা উচিৎ যাতে তার নাভি দৃশ্যমান না হয়। এরপর থেকে নাভি প্রদর্শন ট্যাবু হয়ে ওঠে এবং একইসঙ্গে চলে নাভি আড়াল করে চলা। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে ও নাট্যশাস্ত্রে পরম সত্তার নাভিকে জীবন ও সৃজনশীলতার উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাই শাড়ি পরার সময় মধ্যাচ্ছাদন উন্মুক্ত রাখা হয়। নাভি আড়াল ও উন্মুক্ত রাখার টানাপোড়েনের মাঝেই শাড়ির বয়স গড়িয়ে যায়। আসে নানান বরণ আর নানা ধরনের শাড়ি। সেইসঙ্গে পাল্টাতে থাকে শাড়ি পরার কায়দা-কানুন।

এখনকার আধুনিকারা যে ঢঙে শাড়ি পরেন তা প্রথম আসে ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ থেকে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী এই ঢংটি বোম্বাই (মুম্বাই)গিয়ে আমদানী করেছিলেন। ‘বাইরে বেরোবার জন্য জ্ঞানদানন্দিনী বাঙালি মেয়েদের দিলেন একটি রুচিশোভন সাজ। অবশ্য দেশি ধাঁচে শাড়ি পরা যে খারাপ তা নয়, তবে তাতে সৌষ্ঠব ছিল না। বোম্বাইয়ে গিয়ে তিনি প্রথমেই জবরজং ওরিয়েন্টাল ড্রেস বর্জন করে পাড়শি মেয়েদের শাড়ি পরার মিষ্টি ছিমছাম ধরনটি গ্রহণ করেন। নিজের পছন্দমতো একটু অদল-বদল করে জ্ঞানদানন্দিনী এই পদ্ধতিকেই রাখলেন।

... বোম্বাই থেকে আনা বলে ঠাকুরবাড়িতে এই শাড়ি পরার ঢঙের নাম ছিল ‘বোম্বাই দপ্তর’। কিন্তু বাংলাদেশে তার নাম হলো ‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি’। জ্ঞানদানন্দিনী বোম্বাই থেকে ফিরে এ ধরনের শাড়ি পরা শেখানোর জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। অনেক সম্ভ্রান্ত ব্রাক্ষ্মিকা এসেছিলেন শাড়ি পরা শিখতে; সবার আগে এসেছিলেন বিহারী গুপ্তের স্ত্রী সৌদামিনী। অবশ্য তখনও তার বিয়ে হয়নি। শাড়ির সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনী শায়া-সেমিজ-ব্লাউজ-জ্যাকেট পরারও প্রচলন করেন।

...‘বোম্বাই দপ্তর’র যেসব অসুবিধে ছিল সেগুলো দূর করবার চেষ্টা করেন কুচবিহারের মহারানী কেশব-কন্যা সুনীতি দেবী। তিনি শাড়ির ঝোলানো অংশটি কুঁচিয়ে ব্রোচ দিয়ে আটকাবার ব্যবস্থা করেন। তার সঙ্গে তিনি মাথায় পরতেন স্প্যানিশ ম্যানটিলা জাতীয় একটি ছোট্ট ত্রিকোণ চাদর। তার বোন ময়ূরভঞ্জের মহারানী সুচারু দেবী দিল্লীর দরবারে প্রায় আধুনিক শাড়ি পরার ঢংটি নিয়ে আসেন। এটিই নাকি তার শ্বশুরবাড়ির শাড়ি পরার সাবেক ঢং। বাস্তবিকই উত্তর ভারতের মেয়েরা, হিন্দুস্থানী মেয়েরা এখনও যেভাবে সামনে আঁচল এনে সুন্দর করে শাড়ি পরে, তাতে ওই ধরনটিকেই বেশি প্রাচীন মনে হয়। বাঙালি মেয়েরা অধিক স্বাচ্ছন্দ্যগুণে এটিকেই গ্রহণ করলেন, তবে জ্ঞানদানন্দিনীর আঁচল বদলাবার কথাটি তারা ভোলেননি, তাই এখন আঁচল বাঁ দিকেই রইলো। কিছুদিন মেমেদের হবল্ স্কার্টের অনুকরণে হবল্‌ করে শাড়ি পরাও শুরু হয়; তবে অত আঁটসাঁট ভাব সকলের ভালো লাগেনি। শাড়ির সঙ্গে সঙ্গে উঠল নানান ফ্যাশনের লেস দেয়া জ্যাকেট ব্লাউজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিলিতি দরজির দোকান থেকে যত ছাঁটাকাঁটা নানা রঙের রেশমের ফালি’র সঙ্গে নেটের টুকরো আর খেলো লেস মিলিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হতো।’[ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব, পৃষ্ঠা নং ১৯-২০]। এই গেল মোটামুটি বাঙালি নারীর শাড়ির যৎসামান্য ইতিহাস।

উপরে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি থেকে এটুকু প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তখনকার চলতি ফ্যাশনের দিকে তীক্ষ্ম নজর রাখতেন। ‘রেশমের ফালি’, ‘খেলো লেস’ দিয়ে মেয়েরা যে জামা বানিয়ে পরতো, তা তাদের কতখানি খেলো করে তুলত তিনি কিন্তু সেসবের ধারেকাছেও যাননি। বরং তাঁর ওই কথা থেকে আমদের চোখের সম্মুখে রেশমি, নেট আর লেসের নান্দনিক ঝলকের সামান্য ঝিলিক চলে যেতে দেখি। ওরকম ফ্যাশনের জামা তখন মেয়েদের গায়ে মানাতো কি মানাতো না, তা নিয়ে ঠাকুরের কিন্তু কিচ্ছুটি বলা নেই। কারণ তিনি তো বরাবরই বলে গেছেন:

আমি    রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।
আমি    হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব॥
            ভরাব না ভূষণভারে,  সাজাব না ফুলের হারে-
            প্রেমকে আমার মালা করে গলায় তোমার দোলাব॥

আদতে এটাই সবকিছুর মূল! হোক না সে খর্ব-বেঢপ, কালো-স্ফিত উদর, কদাকার অথবা কুলহারা কলঙ্কিনী... ভালোবাসার অসীম ক্ষমতায় কত কি-ই না তুচ্ছ হয়ে যায়। তুচ্ছ মনে হয়!

 

০২.

শাড়ি নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র গান, অজস্র কবিতা! গল্পেও রয়েছে শাড়ি। উপন্যাসে বহুবার বহুভাবেই এসেছে।

ওই জলেকে চলে লো কার ঝিয়ারী
রূপ চাপে না তার নীলশাড়ি!
                    [কাজী নজরুল ইসলাম]

বা 

ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্যা আসা যাওয়া-
                    পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর
                     [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

বা

চলে নীল শাড়ি, নিঙাড়ি নিঙাড়ি- পরাণ সহিত মোর
                      [কবি চণ্ডীদাস]

বা

যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি পরে কোনো এক সুন্দরীর শব
চন্দন চিতায় চড়ে- আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা;
সেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ- সবচেয়ে গাঢ় বিষণ্ণতা
                       [জীবনানন্দ দাশ]

     

সবখানেই শাড়ির চাইতে শাড়ির আধারই কিন্তু অধিক উজ্জ্বলতা পেয়েছে। তা এই আধার জল ভরতে যেতে যেতে নীল শাড়িটাকেই ম্লান করে দিয়েছে। এদিকে মনে যার নিত্য আসা-যাওয়া, তার পরনের ঢাকাই শাড়িকে মনে রাখার দরকারই বা কি? এমনকি কল্কাপেড়ে শাড়ি পরা শবের সৌন্দর্যও পৃথিবীর সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায়। আধারকে উজ্জ্বল করে তুলতে সেখানেই যেন বেশি আলো উপচে পড়ে। আর যে কোনো অপার্থিব সৌন্দর্যের পাশে বিষণ্ণতা এসে নিঃশব্দে দাঁড়ায়, দাঁড়াবেই!

আমার মনে হয় কি, ওইসব শাড়ির হয়তো কোনো আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে- কী বুননে, কী সুতোয় বা নকশার বাহারে। ওইসব শাড়ির সবই হয়তো উদয়তারার আলো দিয়ে বোনা। যে তারাটি সূর্যোদয়ের আগে পূর্বাকাশে ওঠে আর পলকে হারিয়ে যায়। আলোর সুতো দিয়ে বোনা শাড়ি কিছুতেই আধার অতিক্রম করতে চায় না। অতিক্রম করতে জানেও না। ফলে শাড়ির আলো আধারকে যতো না উদ্ভাসিত করে, আধার নিজের আলোতেই তার চাইতে শতগুণ বেশি উদ্ভাসিত।

 

০৩.

আমার তীব্র পছন্দের পোশাক শাড়ি নয়। যা আমার সহজ চলাচল ব্যাহত করে তা নিয়ে খামাখা উচ্ছ্বাসের কারণ নেই। যা কম সময়ে, সহজভাবে পরে চলাফেরা করা যায়, আমি তার পক্ষে যেতেই ভালোবাসি। এত দীর্ঘ বস্ত্রে নিজেকে পেঁচিয়ে রাখলে কেমন দম বদ্ধ লাগে! মনে হয় কেউ যেন আমায় বেঁধে রেখেছে, এই বন্ধন থেকে মুক্তির আর কোনো আশা নেই! বাঙালি নারী এই বন্ধন থেকে নিজেদের আজও মুক্ত করতে শেখেনি। অথচ নিজের জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, নিজের কাজটি করবার জন্য মুক্তি জরুরি। উড়াল দরকারি। অবিশ্রাম উড়াল জীবনকে নানা রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারে।

তবে শাড়ি পরতে আমি ভালোবাসি। শাড়ি পরতে ভালো লাগে। শাড়ির মাঝে কেমন যেন এক নিবিড় মায়া জড়ানো থাকে। যেমন কাঁথার শরীরে লেগে থাকে পুরনো শাড়ির মায়া।

আমার কাছে শাড়ি মানে আমার মা। আমার দাদী। শাড়ি মানে আমার মায়ের মাথার আধখান ঘোমটা। আর দাদীর আদুল গায়ে পড়ে থাকা নেতানো শিউলি ফুলের মতো ম্লান-আঁচল! বহু বছর আগে, ধনেখালি শাড়ি পরে রমনার বটমূলে ভোর ভোর গান শুনতে যেতাম। এসো হে বৈশাখ...।  তখন গুলাচ ফুটতো থরে থরে। কিছু বেলিফুলের গুচ্ছ ভারী বিনুনীর ভাঁজে ভাঁজে। পায়ে আলতার দাগ স্পষ্ট দেখা যেত। অনেককাল হলো সবই ভুলেছি! ভুলে যেতে হয়েছে হাসি আর তুমুল আনন্দের দিনগুলি। জীবনের কালো ডাইনীরা দখল করে নিয়েছে সাজানো সবুজ-বাগান। তবুও কখনো কখনো চমকে উঠি। কেউ কেউ হঠাৎ করে আমাকে চমকে দেয়। কেউ একজন আমার আমূল নাড়িয়ে দেয়! একদিন শাড়ির প্যাকেট খুলে আপাদমস্তক কেঁপে উঠি! অপরূপ এক শাড়ি! গাঢ় লালপাড়ে বহু বর্ণিল সুতোতে লতাপাতা আঁকা, কোরারঙ জমিনে অগণন কল্কেফুলের লালচে উঁকিঝুঁকি। দেখেই আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেলি। এই রঙ বহুকাল আগে পেছনে ফেলে এসেছি! এই রঙ নিষেধের বেড়াজালে আটকে রেখেছে কোনো বিজন ব্যথা। তবুও এই রঙ এমন ঘোর সাঁঝে আচানক নেমে এসেছে আমার আঙিনায়! আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি- কেন সে চায় এই রঙে রাঙাতে? কেন সে পরাতে চায় এমন শাড়ি? কেন সে এত অবুঝ আর এত প্রেমময়? সে কি জানে না এই শাড়ির আধার বহু আগেই ফেলে এসেছে তার অবিশ্রাম উড়ালের বসন্তদিন! সবকিছু জেনে বুঝেও বড় মমতায়, বড় ভালোবেসে উদয়তারার আলো দিয়ে সে বুনে পাঠিয়েছে এক অলৌকিক শাড়ি!

              পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,

              প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,

              হয় নাকি?’- ব’লে সে তাকালো তার সঙ্গিনীর দিকে;

              আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে

              প্রাণ তার ভরে গেছে।

                          [জীবনানন্দ দাশ]

 

লেখক: কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক ও অনুবাদক

 

**


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়