ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শাড়ি নারী এবং...|| ম্যারিনা নাসরীন

ম্যারিনা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শাড়ি নারী এবং...|| ম্যারিনা নাসরীন

কখন কীভাবে শাড়ি পরার চল ভারত উপমহাদেশে শুরু হয়েছিল সে ইতিহাসে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রাচীন ভারতের পোশাক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: ‘তখন মেয়েরা আংটি, দুল, হার এসবের সঙ্গে পায়ের গোছা পর্যন্ত শাড়ি পরিধান করত, উপরে জড়ানো থাকত আধনা (আধখানা)। পাহাড়পুরের পাল আমলের কিছু ভাস্কর্য দেখেই তা অনুমান করা যায়।’

এই তথ্য অনুযায়ী বলা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি ছিল প্রচলিত পোশাক। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে: ‘দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার রেওয়াজ আদিম কালে ছিল না। এই সেলাইবিহীন অখণ্ড বস্ত্র পুরুষের ক্ষেত্রে ‘ধুতি’ এবং মেয়েদের বেলায় ‘শাড়ি’ নামে অভিহিত হয়।’

মনে করা হয় ‘শাড়ি’ শব্দের উৎস সংস্কৃত ‘শাটী’ শব্দ থেকে। শাটী অর্থ পরিধেয় বস্ত্র। আবার  অন্য আরেকটি সূত্র বলছে, ‘শাড়ি’ শব্দটি জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে মহিলাদের পোশাক হিসেবে উল্লেখিত ‘সাত্তিক’ থেকে উদ্ভুত হয়েছে। সাত্তিক  তিন অংশের একত্রে পরিধেয় একটি পোশাক। একটি নিচের অংশের অন্ত্রিয়ের পোশাক, কাঁধ বা মাথার ওপর একটা পর্দা এবং বুক বন্ধনী। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর সংস্কৃত এবং বৌদ্ধ পালি সাহিত্যে সাত্তিকের উল্লেখ রয়েছে। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে প্রথম শতাব্দীর মধ্যে এই তিন অংশের কাপড়কে একীভূত করে নারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পরিধেয় বস্ত্রে পরিণত করা হয়েছিল যা শাড়ি নামে পরিচিত। এটি সেলাইবিহীন একটি পাতলা লম্বা বস্ত্র যার দৈর্ঘ্য দশ থেকে বারো হাত। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর তৈরি প্রাচীন ব্রজ-মথুরার মহিলার ভাস্কর্যের পরিধানে এমনই শাড়ি দেখা যায়।

এতে প্রতিয়মান হয়, শাড়ি প্রচলনের শুরুর সময় নিয়ে বেশ গোলমাল রয়েছে। তবে এর উৎপত্তি যে ভারতবর্ষ তাতে সন্দেহ নেই। কালক্রমে শাড়ি হয়ে ওঠে ভারতীয় নারীদের প্রধান পোশাক। বিশেষ করে বাঙালি নারী আর শাড়ি যেনো সমার্থক শব্দে পরিণত হয়। কালের বিবর্তনে সালোয়ার কামিজ, টি শার্ট, জিন্স, ল্যাহেঙ্গা, দোপাট্টা ইত্যাদি পোশাকের প্রচলন বাড়লেও নানা পালা পার্বণ সামাজিক অনুষ্ঠানে শাড়িই থাকে এ দেশী নারীর পার্বণ উদযাপনের মূল অনুষঙ্গ।

যাইহোক, শাড়ির উৎপত্তি বা ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে এই লেখার কলেবর বিশাল আকার ধারণ করবে। তাতে হয়ত পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। আমার লেখার উদ্দেশ্যও সেটি নয়। বরং শাড়িতে নারী বা নারীতে শাড়ির যে মেলবন্ধন সেদিকে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

অনেকের মতে সুন্দর করে শাড়ি পরাটা একটি শিল্প বা আর্ট। সুন্দর করে শাড়ি পরতে না জানলে শাড়ি যতই সুন্দর হোক, নারীকে আকর্ষণীয়া দেখাবে না। নারী অঙ্গের বাঁক স্পষ্ট করতে শাড়ির জুড়ি নেই। আবার অন্যদিকে বলা যায়, শাড়ি পরার মূল উদ্দেশ্য কি সুন্দর বা আকর্ষণীয়া দেখানো? না কি প্রয়োজন? আমার মনে হয়, সময় সুযোগ এবং অবস্থান ঠিক করে দেয় শাড়িটি কতটা নান্দনিক, কতটা আবেদন, আবার কতটা প্রয়োজন হয়ে একজন নারীর শরীর পেঁচিয়ে ধরবে।

শুরুর দিকে বাঙালি নারী শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ বা পেটিকোট পরতেন না। পরার ধরনেও বৈচিত্র ছিল না। শাড়িটিকে এক প্যাঁচ করে ঘুরিয়ে আঁচল এমন বড় করে পরা হতো যাতে পুরো শরীর ঢেকে মাথায় ঘোমটাও টানা যায়। যাকে বলে আটপৌড়ে। সামনে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা বা পেটিকোট, ব্লাউজ পরার প্রচলন প্রথম হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী ছিলেন দেবী জ্ঞানদানন্দিনী (১৮৫০-১৯৪১)। অত্যন্ত আধুনিক মনস্কা এই নারীই প্রথম আধুনিক কায়দায় শাড়ি পরার রীতি প্রচলন করেন। অর্থাৎ কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার রীতি। শাড়ির সাথে ব্লাউজ, পেটিকোটের ব্যবহারও তিনিই প্রথম শুরু করেন । মূলত তাঁর এই নতুন পোশাক ভদ্রমহিলাদের প্রকাশ্যে জনসম্মুখে বের হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।

যা বলছিলাম; সময়, সুযোগ, অবস্থান অনুযায়ী শাড়ি নামক পোশাকটি নানাভাবে নারীর শরীরে উঠে আসে। যেমন একজন বিমানবালা যখন শাড়ি পরেন তাদের নির্দিষ্ট একটি কাঠামোতে ফেলে নিভাঁজ পাটপাট করে পিনআপ করে নেন। মডেল, অভিনেত্রী বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কোনো নারীর শাড়ি পরার সময় সচেতনভাবে খেয়াল রাখেন যাতে তাঁর দেহের প্রতিটি বাঁক নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে। অথচ একজন নির্মাণ শ্রমিক শাড়ি পরার সময় একদমই খেয়াল করেন না, তাকে কতটা সুন্দর বা যৌন আবেদনময়ী লাগবে। বরং তার চিন্তা থাকে শাড়িটি এমনভাবে পেঁচিয়ে পরতে হবে যেন কাজে বাধা তৈরি না করে। বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে যারা কর্মরত তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অথবা গ্রাম বাংলার রমণীরা যখন শাড়ি পরেন তখন তাদের মধ্যে এসব ভাবনা কাজ করে না। কারণ পোশাক হিসেবে তারা শাড়ি দেখে অভ্যস্ত, পরেও অভ্যস্ত।  বছরে সূতির প্রিন্টের দুটো শাড়ি পেলেই তাঁরা খুশি। কোন কবি শাড়ি নিয়ে কী কাব্য করলেন, শরীরের কোন অংশ আবৃত আর কোন অংশ উদোম রাখলে সেক্সি দেখায় সেসব ভাবনা থেকে তাঁদের অবস্থান বহু বহু দূরে।

অন্যদিকে বয়সের তারতম্যেও শাড়ির আবেদন আমাদের কাছে বদলে যায়। সদ্য বিবাহিতা নারী লাল বেনারসি পরে যখন ঝুমুর ঝুমুর হেঁটে যায় তখন তার সেই লাল আলোকধারায় আশেপাশের মানুষগুলো চমকিত হয়, আন্দোলিত হয়। কিন্তু কোনো মা যখন আটপৌড়ে শাড়ি পরেন, আঁচল মাথায় দিয়ে সন্তানের পানে চান, তখন সেই মমতাময়ীর মুখ বাংলা মায়ের শাশ্বত রূপ। কেন জানি না এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমার মাথায় জাতীয় সংগীতের একটি চরণ বারবার ঘুরছে: ‘কি আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে...’। দেশ মায়ের সাথে সাথে এই আঁচল তো আমার মায়ের শাড়ির। পরম শান্তির আশ্রয়। শাড়ির সঙ্গে বাঙালি মা নামটি যেনো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শাড়ি মনে হলে মা মনে হয়, মা মনে হলে শাড়ি।

ছোটবেলায় আমার দাদী নানীকে কখনো ব্লাউজসহ, কখনো ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরতে দেখেছি। এখন মনে পড়ে গরমের সময় তাঁরা ব্লাউজ পরতেন না। মা কুঁচি দিয়ে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরতেন। কখনো অন্য কোনো পোশাকে তাঁকে দেখিনি। ফলে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার পরেও কল্পনাতে শাড়িতে কমনীয় লাবণ্যময়ী একজন মাকেই দেখি। এখনো গ্রামের বেশিরভাগ বিবাহিতা নারী শাড়ি পরেন। শহরের নারীদের মধ্যে শাড়ির চল অনেক কমে গেছে। তার পেছনে কারণও রয়েছে। ইট বালুর তপ্ত এই শহরে ভাগতে ভাগতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। তার মধ্যে সময় বের করে বারোহাত শাড়ি গুছিয়ে পাট পাট নিভাঁজ করে পরার সময় কোথায়?

তাই বলে নারীরা শাড়ি পছন্দ করেন না সেটা কিন্তু নয়। আমার মনে হয় প্রত্যেক নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। শাড়ি পরার কোনো সুযোগ তাঁরা সহসা হাতছাড়া করতে চান না। কিন্তু এখন নারীরা আর শাড়িতে ফুল তুলে ঘরে বসে থাকেন না। তারাও কর্মযজ্ঞে যোগ দিয়েছেন। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে বাসে ঝুলতে ঝুলতে তাঁরাও অফিস আদালত করছেন। সাথে বাচ্চার স্কুল, রান্না বান্না, ঘর গৃহস্থালীর সবকিছু এখনো বাঙালি পরিবারে তাকেই সামলাতে হয়। তার মাথায় তখন পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চিকে বাড়িয়ে পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চি করবে সেই চিন্তা কাজ করে না। বরং কোন পোশাক পরলে দ্রুত রেডি হওয়া যাবে বা বাসের হাতলটা ধরা সহজ হবে সেই চিন্তা অস্থির করে রাখে। ফলে তাকে শাড়ি ফেলে সালোয়ার কামিজ তুলতেই হয়। কারণ শাড়ির তুলনায় সালোয়ার কামিজ হাজার গুণ সুবিধাজনক।

আমি নিজে কলেজ শিক্ষক। শাড়ি আমার অত্যন্ত প্রিয়। এবং আমি জানি, আমি খুব সুন্দর করে শাড়ি পরতে জানি। কলেজে আমি শাড়ি পরতেই বেশি পছন্দ করি। তবে এজন্য বেশ সময়ের দরকার হয়। কোনো কোনো দিন এত তাড়াহুড়ো থাকে যে নাস্তা খাবার সময় পর্যন্ত পাই না। তখন পাঁচ মিনিটে সালোয়ার কামিজ পরব, নাকি বিশ মিনিট ধরে শাড়ি পরব? শহরের গৃহবধূ যারা চাকরি না করলেও তাদের হরদম নানান কাজে বাইরে যেতে হয়। ইদানিং বাজার সদাই নারীরাই করেন।  বাচ্চাকে স্কুল কোচিং মিলিয়ে কয়েকবার দৌড়াতে হয়; ফাঁকে সংসারের কাজকর্ম। সুতরাং তার সামনেও কিন্তু শাড়ি পরার অপশন খুব একটা নেই।

তবুও কি কর্মজীবী বা গৃহিণীগণ শাড়ি পরছেন না? পরছেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, পুলিশ অফিসারসহ নানা পেশার নারীরা নিয়মিত না হলেও সময় সুযোগে শাড়ি পরছেন। নারী ডাক্তার শাড়ির ওপর এপ্রোন ঝুলিয়ে যখন হাসপাতালে রাউন্ড দেন আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। একজন আত্মবিশ্বাসী মেধাবী বাঙালি নারীর স্ফুরণ দেখি। শাড়িতে একজন প্রফেসর আরো বেশি দীপ্ত, পরিশীলিত, মার্জিত। হোক তিনি উচ্চতায় এভারেজ বাঙালি নারী। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, পুজো পার্বণে শাড়ি ছাড়া নারীকে খুব একটা দেখা যায়? বিয়ে জন্মদিন বা নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে এখনো নারীর প্রিয় পোশাক শাড়ি। সুতরাং শাড়ি যে বিদায় হয়েছে সে কথা বলার কারণ নেই। পোশাকের সৃষ্টিই হয়েছে প্রয়োজনের জন্য, লজ্জা নিবারণের জন্য। সময়ের ক্রমবিবর্তনে এসব পোশাকে যোগ হয়েছে আরাম, সুবিধা, সামর্থ্য। একজন গার্মেন্টস কর্মী তিনশ টাকা দিয়ে থ্রিপিস কিনে ছয়মাস চালিয়ে নিতে পারেন, দ্রুত সময়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে যেতে পারেন, সারাদিন এক পায়ে খাড়া থেকে আরামে কাজ করতে পারেন, কিন্তু শাড়িতে সেই সুযোগ কোথায়? তাই বলে এই দ্রুত পায়ে হেঁটে যাওয়া নিজের আলোয় আলোকিত মেয়েগুলোকে দেখতে স্মার্ট লাগে না? আমার কাছে কিন্তু ভীষণ স্মার্ট মনে হয়।

এরপরেও আমরা কবে ভাবতে শিখব, নারীর স্মার্টনেস শাড়িতে নয়, আত্মমর্যাদায়!

লেখক: প্রভাষক ও কথাসাহিত্যিক

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়