ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সমস্ত শাড়ির দোহাই || ইশরাত তানিয়া

ইশরাত তানিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৬, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সমস্ত শাড়ির দোহাই || ইশরাত তানিয়া

বিষাদবিলীন এক ক্ষণে কী মনে করে শাড়িগুলো মেলে দিয়েছিলাম। ভাঁজ খুলে দেখছিলাম জমিনে-পাড়ে-আঁচলে কত বিচিত্র মোটিফে-রঙে নিতান্ত সাদাসিধে সব তাঁতের নরম শাড়ি। যত্নে ভালোবাসায় আলমারিতে তুলে রাখা একেকটি পাট না-ভাঙ্গা শাড়ির কী বিচিত্র গন্ধ! কোনোটির সাথে কোনোটির মিল নেই। কোনো কিছুর সঙ্গেও এই ঘ্রাণের যোগ নেই। কেমন যেন ওই জলের ধারে গেলে, যেমন শীতল গন্ধ পাওয়া যায় তেমনি। কিংবা হেমন্তের বিকেলে জঙ্গুলে বিশাল গাছ আর লতাগুল্ম যে গন্ধ ছড়ায় তেমন বনজ ঘ্রাণ। ফিকে সুগন্ধ।   

মেলে দেয়া ভেজা শাড়িতে আলো হাওয়ার খেলা। টাটকা কড়া রোদে ফি বছর তসর আর সিল্কের শাড়ি তাপিয়ে গুমোট উড়িয়ে দেয়া। কত না এমন টুকরো ছবির কোলাজে ভরপুর মন ক্যানভাস। ব্যথার আলমারিতে তোলা থাকে মায়ের পুরাতনী শাড়ি। ন্যাপথলিনের ফাঁকে ফোঁকরে সেই শাড়িগুলো ম্লান মুক্তোর আলো ছড়ায়। কত যে লিখেছি এক সময় শাড়ি নিয়ে! সেই কবিতা লেখার তুমুল দিনগুলোতে। শাড়ির মতো এমন উদাস, মোহনীয় সুন্দর, ভালোবাসা জাগানিয়া, মনোরম ডিপ্রেশানবাস্টার, একইসঙ্গে অভিজাত-আটপৌড়ে আর কিছু হয় না।

কখনওবা জোছনা রূপোলি শাড়ি লুটিয়ে গলি দিয়ে চলে যায়। আমার ভারী অভিমান হয় তার পথ চেয়ে। তখন ভাবি, এই মন খারাপের রাজ্যে ভাগ্যিস শাড়ি ছিল! একটু ছুঁলাম, তক্ষুনি মন কী ভালো! ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘দূরের টেবিল’ কবিতাকে তখন আরও ভালোবেসে ফেলি-   

এবার বয়স হলো। মাছরাঙাদের কথা কেন?

আমার, তাঁতের শাড়ি

ভালো লেগেছিল খুব ষাটের দশকে।

আরো ভালো লেগেছিল তাঁতের শাড়ির মহিলাকে।

অনেক বছর হলো সেইসব-

আজ কিছু ক্লান্ত, তবু ভালো লাগে যেই দেখি

একটি মেয়েকে ঘিরে চার-পাঁচজন বসে আছে

দূরের টেবিলে।

তাঁতের শাড়ি পরা দূরের টেবিলের মেয়ে তো জানে না, কবিকে সে নস্টালজিক করেছে। মৃদু ব্যথাচ্ছন্ন করেছে। শুধু ভাস্কর নয় কালিদাস থেকে শুরু করে অজস্র কবি যুগে যুগে তাকে বন্দনা করেছে। নীলাম্বরী শাড়ি পরে নীল যমুনায় যে যায়, সে জানতেই পারেনি কত গান রচিত তাকে নিয়ে। একজন কবির বা লেখকের লেখার স্বাধীনতা আছে। সৌন্দর্য নিয়ে তিনি বলতেই পারেন নিজস্ব রূপকে, ব্যাঞ্জনায়, দৃশ্যকল্পে। এমনকি সেই সৌন্দর্য শুধু দৈহিক হলেও। কিন্তু মুশকিল তখনই, যখন ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়। নিঃসন্দেহে শাড়ি এক রহস্যচকিত দেহ আচ্ছাদন। মুগ্ধ লেখক এর ভাঁজে ভাঁজে দেখেন প্রবহমান নদী, পাকে পাকে উঁচুনিচু পাহাড় পর্বত। কুচির পরতে পরতে পুড়ে যেতে হয়, এমনই অনন্ত আগুন সেখানে। নারী একইসঙ্গে হয়ে ওঠে রমণীয় ও অপরূপ। একেক সময় লেখকের সৌন্দর্য প্রকাশের ভারে চাপ খেয়ে নদী-পাহাড় সমস্তই যেন বেরিয়ে আসে শাড়ি উপচে। শরীরের গাঙে বইয়ে দেয়া শাড়ি ঢেউয়ে ঢেউয়ে খুলে যায়। শাড়ির শ্রেষ্ঠত্বের অধিক হয়ে ওঠে নারীর দেহবল্লরীর সাবলিমিনাল যৌনাবেদন।

সৌন্দর্যবোধের বিপরীতে অসৌন্দর্যবোধটিও আসে মানুষের নিজস্ব ধারণায়। অসম দেহ গঠন কারো দৃষ্টিতে হতে পারে দৃষ্টিকটু এবং অসুন্দর। কিন্তু বহিঃপ্রকাশটি কোথায় যেন সাটল মিসোজিনিক, সেক্সিজমের প্রতিভাস হয়ে ওঠে। খুব সূক্ষ্মভাবে যেন নারী দেহের গড়নের প্রতি বিদ্বেষ আর ঘৃণা। এটা সত্য যে, উপমহাদেশের মধ্য বয়সী নারী শরীরের লেমন সিন্ড্রোম বা স্ফীত মধ্যদেশ শাড়িতে লুকিয়ে ফেলা যায়। অপটিক্যাল ইলিউশানে খাটোকে লম্বা লাগে। ‘অসম ত্রুটি’ ঢাকতে শাড়ির জুড়ি মেলা ভার। এই ‘অসম’ ত্রুটি বা ‘সম’ এর উৎকর্ষতা কিন্তু খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। প্রসঙ্গত বলা যায়, যে কোনো সমাজে সামষ্টিক সৌন্দর্যবোধ একটি সাংস্কৃতিক উপাদান। সৌন্দর্যবোধের ধারণা ও সৌন্দর্য নিরূপণের মাপকাঠিতেও ভিন্নতা থাকে। তাই গ্রীক ভাস্কর্যের মতো গড়নের মানুষের মতো আফ্রিকার ঘনকৃষ্ণ বর্ণের মানুষও সুন্দর। সুন্দর খাটো গড়নের, সরু চোখের চৈনিক বালিকা। পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে বেয়ে মোটা হয়ে যাওয়া পায়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীও অপরূপ লালিত্য ধারণ করে।

নানান বৈচিত্র্যের সেই সৌন্দর্যবোধও সময়ের সাথে বদলে যায়। অন্ধকার বিদিশার নেশাতুল্য দীঘল কালো চুল রুঢ় বাস্তবতায় ব্যস্ততর জীবনে খাটো হয়ে কাঁধ বা ঘাড় পর্যন্ত উঠে আসে। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ছোট চুলে তখন আর সৌন্দর্যহানি হয় না বরং সুন্দরতা যুক্ত হয়।           

দিন বদলে গেছে। মহাকাল পাতা উলটে দিচ্ছে তাই সময়ও। সময়ের প্রয়োজনে নারীর পোশাক, খাদ্যাভ্যাসসহ সব কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। শুধু পোশাকের কথা যদি বলি- আরামদায়ক, বেস্ট ফিটেড, জলদি পরা যায় এমন পোশাক ফেলে অনেক নারীই আর দীর্ঘ কাপড়ের টুকরো জড়াতে চায় না। কিন্তু তাই বলে, পাশ্চাত্য পোশাক পরে নারী ইউরোপিয়ান ‘সুন্দরী’র সমকক্ষ হতে চায়, এই ভাবনাটি অভ্রান্ত সত্য নয়। মারাত্মক ভুল। বরং কাটিং, ডিজাইন সবেতেই পশ্চিমের সঙ্গে পূর্বের এক ধরনের ফিউশান হওয়া পোশাক এখন সমাজে প্রচলিত। যেমন- তাগা বা কোর্তা। সেলোয়ার কামিজের বাইরে শাড়ির বিকল্প হয়ে উঠছে এসব আধুনিক পোশাক। এসব পোশাকের সবই যে প্রাতীচ্যের নারী দেহে বেমানান সেটাও নয়। তবে উৎসবে, পার্বণে, উদযাপনে বাকি সব পোশাক হটিয়ে শাড়ি এখনও সমান দাপুটে।

সুন্দরতা সামগ্রিকতায় পূর্ণ বিকশিত হয়। শুধুই দৈহিক সৌন্দর্য দিয়ে এর তুল্যমূল্য পরিমাপ করা ঠিক না। মেধা ও মনন, আত্মবিশ্বাস, ভাবনা প্রসারতা আর চিন্তার গভীরতাও সৌন্দর্যের অংশ হয়ে ওঠে। সৌন্দর্য বাড়ানোর ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন। একটি শাড়িও ব্যক্তিত্ব ধারণ করে। মননশীলতা, মার্জিতবোধ, রুচি আর সৌন্দর্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আবার চোখের জলটুকুও মুছে দেয় শাড়ির আঁচল। এলোমেলো বাতাসে ওড়ে আঁচল। ঘরে বাইরে পরিশ্রমী নাকের ওপরে কিংবা কপালের স্বেদবিন্দু শুষে নিয়ে স্বস্তি দেয় ওই আঁচলেরই সুতোর বয়ন।     

শাড়ি তাই একান্ত কিছু। দেহের সৌন্দর্যবর্ধক আচ্ছাদনের বাইরে অতল, অনন্য কিছু। এই সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে শাড়িকে যদি শুধুই যৌনচেতনাময় দৃষ্টিতে দেখা হয়, এতে বরং নন্দনতত্ত্বের হানি ঘটে। একটা আকাশী শাড়ি শুধু শাড়িই নয়। সেই শাড়ি হয়ে উঠতে পারে কারও অলৌকিক মোহময় নিজস্ব আকাশ।

লেখক: কবি ও গল্পকার

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়