ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জ্বলে ওঠার আগেই নোবেল যেন নিভে না যান

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২০, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জ্বলে ওঠার আগেই নোবেল যেন নিভে না যান

রাহাত সাইফুল : সংগীতশিল্পী অন্বেষণে প্রতিযোগিতামূলক রিয়েলিটি শো করা হয়। বিচারকদের যাচাই-বাছাইয়ে উঠে আসে কিছু শিল্পী। এদের শুরুটা বেশ রমরমা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি এসব রিয়েলিটি শো থেকে উঠে আসা শিল্পীদের অধিকাংশই হারিয়ে যান কালের অতল গহ্বরে। সদ্য শেষ হওয়া ‘সা রে গা মা পা ২০১৯’-এর দ্বিতীয় রানারআপ বাংলাদেশের নোবেল। দুই বাংলায় বেশ আলোচিত তিনি। তাকে নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। বিতর্কের ঝড়ে জ্বলে ওঠার আগেই নিভে যেন না যায় নোবেল।

নোবেল, পুরো নাম মাইনুল আহসান নোবেল। ওপার বাংলার জী বাংলা সা রে গা মা পা-২০১৮তে অংশ নেয়া বাংলাদেশী প্রতিযোগী। অনেক লম্বা জার্নির পর গত ২২ জুন ২১ জন বাছাইকৃত শিল্পী নিয়ে অর্ধশত পর্বেরও বেশী হয়ে যাওয়ার পরই এই সিজনের টপ টেনে স্থান করে নেন নোবেল। টপ টেন এ প্রতিযোগীরা উঠে এসেছে একের পর এক ভ্যারাইটি দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে ভার্সেটাইলিটি। ফোক, ক্লাসিক, রোমান্টিক, দেশাত্মবোধক, হেমন্ত, আর ডি বর্মণ, কিশোর কুমার, জাজেস চয়েজ, ইন্সট্যান্ট কোন গান এবং প্রতিযোগীদের একজন আরেকজনের সাথে ফেইস টু ফেইস পর্বের মত সকল পর্বেই দেখাতে হয়েছে নিজেদের বিশেষত্ব।

নোবেল শুরুতেই জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, মাইলসের গান গেয়ে দুই বাংলার শ্রোতাদের মাত করেছেন। এছাড়া  অনুষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী, নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘মুক্তির মন্দিরও সোপান তলে’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’, ‘আমারও পরাণও যাহা চায়’, ‘তুমি কত যে দূরে’, ‘কফি হাঊজের সেই আড্ডাটা’, এবং ‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে’সহ বলিউডি অনেকগুলো সিনেমার গান গাইতে হয়েছে। এই গানের প্রায় প্রতিটিতেই নোবেল পেয়েছে গোল্ডেন গিটার। নোবেলের শুরুর পরিবেশনা থেকেই দেখা গেছে বিচারকরা অনেকবার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এই অনুষ্ঠানের শুরু থেকে প্রাপ্তির খাতায় শুধু যোগই হতে থাকে।  শেষদিকে এসে, প্রিন্স মাহমুদের আরো কিছু গান, এলআরবি-র রুপালী গিটার, বেলা বোসও নোবেল কণ্ঠে তুলে নিয়েছে তার মত করেই, শ্রোতাদের মুগ্ধতা শুধু বেড়েছেই। বাংলাদেশের শ্রোতাগণ শুধু নোবেলের পার্ফম দেখার জন্য টেলিভিশন সেটের সামনে অপেক্ষা করতেন। নোবেলের পার্ফম দেখে মুগ্ধ হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেসবুক, টুটাইরে নোবেল বন্দনায় ভাসিয়ে দিতেন। বাংলার মানুষের এমন উপচে পড়া ভালোবাসায় ছেদ পরে চ্যাম্পিয়ন না হয়ে দ্বিতীয় রানারআপ হওয়ায়। এ নিয়েও কম আবেগ প্রকাশ করেনি এদেশের মানুষ। শুরু থেকেই এদেশের মানুষ ও মিডিয়াগুলা সার্পোট দিয়ে আসছিলো নোবলেকে। সেই নোবেল হওয়া ‘সা রে গা মা পা-২০১৯’ সিজন শেষ হওয়ার পরই প্রথম আঘাত দেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের উপর। জাতীয় সংগীত নিয়ে নোবেলের মন্তব্যে এদেশের লাখো কোটি শ্রোতাদের হৃদয় ভেঙ্গে যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ নয়, গীতিকার-সুরকার প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটিই বাংলাদেশকে অনেক বেশি করে চিনিয়ে দেয় বলে মত নোবেলের। নোবেল বলেন, এটি তার ব্যক্তিগত মতামত। তার এই মন্তব্যের বিরোধিতাও অনেকে করতে পারেন বলে জানান নোবেল। এমন কি, প্রিন্স মাহমুদের ওই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করার দাবিতে একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলও হয়েছিল বলে দাবি নোবেলের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওতে নোবেলকে বলতে শোনা যায়, “প্রিন্স মাহমুদ স্যারের যে ‘বাংলাদেশ’ গানটা, আমি একটা কথা বলব এইটা নিয়ে। কেউ হয়তো খারাপ মনে করতে পারে, বাট আমার পারসোনাল অপিনিয়ন এইটা। আমি মনে করি, আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ আমাদের দেশটাকে যতটা এক্সপ্লেইন করে, তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি এক্সপ্লেইন করে কিন্তু প্রিন্স মাহমুদ স্যারের লেখা এই গানটা। আমাদের জাতীয় সংগীত যেটা আছে, সেটা হয়তো রূপক অর্থে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়, বাট এইটা (প্রিন্স মাহমুদের লেখা বাংলাদেশ গানটি) কিন্তু আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আবেগের জায়গা সবকিছু কিন্তু প্রোপারলি আমাদের কাছে তুলে ধরে।”

নোবেলের মন্তব্য শুনে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। নেটিজেনদের মত, জাতীয় সংগীতের সঙ্গে কোনো গানেরই তুলনা চলে না। এহেন মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেছেন অনেকেই। অনেকে নোবেলের বিচারের দাবিও জানিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশেই নয়, নোবেলের মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কলকাতার কয়েকজন সংগীতশিল্পীও। নোবেল ‌জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কিত এক মন্তব্য করে কলকাতা ও বাংলাদেশ দুই দেশের সংগীতপ্রেমীদের রোষানলের শিকার হন।

এর আগেও রিয়েলিটি শো চলাকালে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন নোবেল। ‘এত কষ্ট কেন ভালবাসায়’ গানটি গেয়ে ‘আর্ক’ ব্যান্ডের গান বলে পরিচয় করিয়ে দেন নোবেল। যে তথ্যটি ছিলো ভুল। এর আগে একই মঞ্চে জেমসের ‘বাবা’, ‘মা’ গান দুটি কাভার করেছিলেন নোবেল। সেসময় গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদের নাম বলেননি তিনি। পরে সমালোচনার মুখে পরে ক্ষমা চেয়েছিলেন নোবেল। তখন প্রিন্স মাহমুদ নোবেলকে ক্ষমা করে দেন বলে জানা যায়। এই বিষয়গুলো নিয়ে সংগীত সংশ্লিষ্ট অনেকেই নোবেলের এমন আচরণের কঠোর সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ তাকে ধুর্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এসব বির্তকের রেষ কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি এক কিশোরীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশ হয়েছে নোবেলের নগ্ন ছবি। সেইসঙ্গে নোবেলকে মাদকসেবী, নারীলোভী আখ্যা দিয়ে ওই কিশোরী আবেগঘন একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। যেখানে নোবেলের সঙ্গে তার প্রেম ও শারীরিক সম্পর্কের নামে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন তিনি। সেই কিশোরীর আইডিটি ফেসবুকে আর দেখা না গেলেও নোবেলকে নিয়ে দেয়া তার স্ট্যাটাস ও নগ্ন ছবিগুলো দুই বাংলাতেই এই মুহূর্তে ভাইরাল। অনেক ইউটিউব চ্যানেলেও দেখা যাচ্ছে নোবেলকে নিয়ে রসালো ফিচার ভিডিও। অনেক গণমাধ্যমেও এসেছে বিষয়টি। কলকাতার গণমাধ্যমে নোবেলকে নিয়ে সংবাদের শিরোনাম করা হয়েছে- ‘বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস, নোবেলের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ কিশোরীর’।

রহস্যজনক ব্যাপার হলো যে কিশোরীর ফেসবুক থেকে ছবিগুলো প্রকাশ করা হয়েছে তার পরিচয় মেলেনি এখনো। কারণ ছবিগুলো পোস্ট করার পর সেই অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভ রয়েছে। অ্যাকাউন্টটি নিজেই ওই কিশোরী আড়ালে রেখেছেন নাকি তার অ্যাকাউন্টটি হ্যাক করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। এই আইডিটি ফেক কি না সেই বিষয়েও কোনো নিশ্চিত তথ্য মিলেনি। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই নোবেলকে নিয়ে লেখা স্ট্যাটাস ও নগ্ন ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। সেগুলো পোস্ট করে অনেকেই নোবেলের চারিত্রিক দুর্বলতার সমালোচনা করছেন।

এদিকে নোবেলের বিরুদ্ধে উঠে নানান গুঞ্জন। কনসার্ট বা কোনো অনুষ্ঠানে তার পারিশ্রমিক আকাশচুম্বি। এছাড়া তার সঙ্গে থাকে বেশ কয়েকজন সহকারী। ফোন কল রিসিভ করেন ব্যক্তিগত সহকর্মী। এ নিয়ে অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তাহলে শিল্পী নয়, অর্থ আর স্টারইজমের পিছনে ঘুড়ছেন নোবেল?

নোবেলের নিজস্ব কোন গানে দর্শকদের মাত করতে পারেনি। জনপ্রিয় শিল্পীদের জনপ্রিয় গান করে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছেন নোবেল। অন্যের গান গেয়ে ভাইরাল হয়ে শুধুমাত্র পরিচিতি ছাড়া কিছুই নয়। নিজস্বতা না থাকলে পরবর্তীতে গানের জগতে টিকে থাকার নজির খুব বেশি নেই। এমন অনেক শিল্পী প্রায় প্রতি বছর একটি-দুটি গান গেয়ে ভাইরাল হয়েছে। আবার বানের জলের মত তা ভেসে গেছে। এমন শিল্পীর তালিকা ভুরি ভুরি। প্রকৃত শিল্পী হতে হলে কাভার সংয়ের পাশাপাশি নিজের গান তৈরী করার উচিৎ। দেশের জনপ্রিয় সংগীত রিয়েলিটি শো ‘ক্লোজআপ ওয়ান’। এই শো’র টপটেন শিল্পীর প্রত্যেকেই দর্শক মাত করতে সক্ষম হয়েছেন। চারিদিকে ছিলো তাদের জয় জয়কার। আজ কজন টিকে আছে? এই তালিকা খুঁজে হয়তো দু-একজন পাওয়া যাবে। এমন রিয়েলিটি শো থেকে আরো অনেক শিল্পী এসেছেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই খুব কম সময়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। নোবেল মুখে লাগাম দিয়ে একটু সংযত, অর্থ আর স্টারইজমের পিছনে না ঘুড়ে শিল্পী হওয়ার অন্বেষণে থাকলে জ্বলে উঠার আগেই নিভে যাবে না আমাদের নোবেল।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়