ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারে নয়া সমীকরণ

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারে নয়া সমীকরণ

অলোক আচার্য : আধিপত্যবাদ শব্দটি দ্বারা সাধারণত বোঝানো হয় প্রভাব বিস্তার করা। নিজের কর্তৃত্ব যেকোনো উপায়ে বজায় রাখার একটি কৌশল। সহজ ভাষায় মোড়লীপনা করা বা খবরদারি করা। নিজেকে সুরক্ষিত রেখে আধিপত্য বিস্তারের কৌশল বেছে নেয়া হয়। এটি যেমন প্রতিটি দেশে সামাজিক শৃঙ্খলাকে বাধাগ্রস্থ করে, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আধিপত্যবাদ প্রভাব বিস্তার করে। আজকের বিশ্বে এটি নতুন কোনো ধারণা নয়।

আধিপত্যবাদ নির্ভর করে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার ওপর। আর ক্ষমতা বলতে বোঝায় আর্থিক সামর্থ্য, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন যা অন্য দেশের থেকে এগিয়ে থাকে এবং উন্নত অবকাঠামোর সমন্বয়। পৃথিবীজুড়ে বহু বছর ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলাবাহুল্য, এক্ষেত্রে মার্কিন প্রযুক্তি, শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি এবং দক্ষ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে প্রভাব বিস্তারের প্রধান নিয়ামক যে ক্ষমতা তা আজ না বোঝালেও চলবে। আমাদের সামাজিক পরিমণ্ডলেও যাদের ক্ষমতা বেশি তারাই প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাদের সিদ্ধান্তই মেনে চলতে হয়। বিশ্ব পরিমণ্ডলেও একই অবস্থা। উন্নত ক্ষমতাধর দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। আধিপত্যবাদে অন্যকে নিজের আয়ত্ত্বে রাখা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজের পক্ষে মতামত দেয়াকে প্রাধান্য দেয়া হয়। আজ বিশ্বজুড়ে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের খেলায় মত্ব ক্ষমতাশালী দেশগুলো। এসব দেশের রয়েছে আধুনিক অস্ত্রসম্ভার, কারিগরী দক্ষতা, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ইত্যাদি। নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে তারা।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এসব দেশ নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে মরিয়া। এই আধিপত্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতা আজ থেকে শুরু হয়নি। প্রথম শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন দেশ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলে। সেই সাথে প্রযুক্তির বিকাশ সাধনের ফলে নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে তারা। সেই সময়ে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিল। প্রথম দিকে এসব খুব বেশি প্রভাব বিস্তার না করলেও ধীরে ধীরে শক্তিমত্তার বিস্তার ঘটতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নিত্য নতুন অস্ত্র আবিষ্কারের শুরু সেই তখন থেকেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের। সেক্ষেত্রে স্নায়ুযুদ্ধকালীন ঘটনাকে স্মরণ করা যেতে পারে। আধিপত্যবাদের সাথে সাথে আমরা উপনিবেশবাদের সাথেও পরিচিত।

একসময় এই ভারতীয় উপমহাদেশও ব্র্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল। ধীরে ধীরে উপনিবেশবাদ বিদায় নেয়। শুরু হয় আধিপত্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আধিপত্য বিস্তারের খেলায় যা যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে দেয়। এরপর বিভিন্ন সময় নতুন নতুন আধুনিক অস্ত্র, বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র আবিষ্কার অব্যাহত থাকে। এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব দিক থেকে অনেক অনেক এগিয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে আরও কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে। অবস্থা এমন যে, এই অস্ত্র হাতে থাকলেই ক্ষমতাধর দেশগুলোর সঙ্গে মাথা উঁচু করে কথা বলা যায়। এখন ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যে দ্বন্দ্ব চলছে তার মূলেও রয়েছে পরমাণু অস্ত্র তৈরি। যদিও ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে না বলে জানিয়েছে কিন্তু সে আশংকা থেকে বিশ্ব মুক্ত হতে পারেনি। বাস্তবিকপক্ষে অস্ত্র মানেই ক্ষমতা! আর ক্ষমতা মানেই প্রভাব বিস্তার। পরমাণু অস্ত্রসম্পন্ন দেশগুলো শেষমেশ নিজেদের রক্ষায় যে এই পথ বেছে নেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব ক্ষমতার কারণে পৃথিবীব্যাপী বহু বছর ধরেই মার্কিন আধিপত্য রয়েছে। আরও দীর্ঘ সময় থাকা সম্ভব। কিন্তু কতদিন?

যতদিন না অন্য কোনো সুপার পাওয়ার নিজেদের শক্তি নিয়ে মাথা উঁচু করে না দাঁড়ায় ততদিন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই পাল্লা দিয়ে চলেছে রাশিয়া, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ। এখন একক আধিপত্যের যুগ আর নেই। একক আধিপত্য বজায় রাখা বেশ কঠিন। ক্ষেত্রবিশেষে সম্ভবও নয়। কারণ প্রযুক্তির যুগে যেসব দেশ উন্নত সামরিক প্রতিযোগিতায় রয়েছে তারাও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অস্ত্র আবিষ্কার করতে ব্যস্ত। নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কেবল পৃথিবী নামক গ্রহের নিয়ন্ত্রণ নিতেই ব্যস্ত নেই, সেসব দেশ বরং মহাশূন্যেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টায় রত আছে।

যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে বিশ্বের চোখ কপালে তুলে দিয়েছিল এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নিজেদের বিশাল উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। আজও তারাই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে একক আধিপত্য বিস্তারের চেয়ে মিত্রদের সঙ্গে চলতেই বেশি পছন্দ করছে। সবচেয়ে দ্রুত বদলাচ্ছে চীনের অবস্থান। পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন অস্ত্র বানিয়ে এবং আঞ্চলিক কূটনৈতিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। গত কয়েক বছরে চীন তাই বিশ্বের পরাশক্তির কাতারে। যার ফলশ্রুতিতে কৌশল হিসেবে মিত্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিজ বলয়ের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারত নিজেদের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে মিত্র হিসেবে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু এখন এসব ছাড়িয়ে চীনের আধিপত্য বেশি লক্ষণীয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ এখনও চলমান। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিপরীতে চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। এতেই বোঝা যায় চীন পিছিয়ে যেতে আগ্রহী নয়। এর কারণ চীনের পৃথিবীব্যাপী পণ্যের বিশাল বাজার যা চীনের অর্থনীতিকে ক্রমেই শক্তিশালী করছে, রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্টতা ইত্যাদি।

সম্প্রতি অষ্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনির যুক্তরাষ্ট্র ষ্টাটিজ সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়- চীনের কাছে এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় একক আধিপত্য হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বহুদিন ধরেই চীন নিজেকে প্রতিযোগিতার পর্যায়ে এনেছে। নিজেদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করার সাথে সাথে সামরিক ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের কাজে মনোযোগী হয়েছে। বহুদিন ধরেই চীনকে সামরিক খাতে যে রাইজিং পাওয়ার বা উঠতি শক্তি বলে ধরা হচ্ছিল এখন সেই উঠতি শক্তি পূর্ণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে। চীনও আজ এক সুপার পাওয়ার হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। চীনকে সুপার পাওয়ার বিবেচনা না করলে তা ভুল হবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কৌশল ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নজিরবিহীন সংকটে রয়েছে। ওয়াশিংটনকে হয়তোবা তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে রক্ষা করার জন্য চীনের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের একক সামরিক আধিপত্য নেই। সেই রিপোর্টে আরও বলা হয় বেইজিংয়ের দারণ সব ক্ষেপণাস্ত্র যে সম্ভার রয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও তার বন্ধু দেশগুলোর জন্য হুমকি। চীন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু তা অর্জনে যে তাদের লক্ষ্য নেই তা বলা যাবে না। চীনের যে জিনিসের অভাব রয়েছে তা হলো ‘ওভারসিজ মিশন’। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে দাপিয়ে বেড়ানো তা এই ওভারসিজ মিশনের জন্যই। যুক্তরাষ্ট্র এখনও যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠত্বে এগিয়ে আছে। এর মধ্যে রয়েছে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান। এশিয়া এবং ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপে গভীর নেটওয়ার্ক বজায় রাখতে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র। এসব দিকে চীন পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু কতদিন পিছিয়ে থাকবে সেটাই প্রশ্ন? কেউ এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে থামানো সম্ভব নয়।

প্রযুক্তির বাজারে এশিয়ার বাইরেও চীন টেক্কা দিয়ে চলেছে। ভূমি, আকাশ বা সাগরে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এখন হয়তো চীন এশিয়া বা নিজের আশেপাশে প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী। ভবিষ্যতে এর বিস্তার যে আরও বৃদ্ধি পাবে না তার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। দশকের পর দশক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালানোর মধ্যে দিয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনী পুনর্গঠিত হয়ে গেছে। তারা নতুন নতুন অস্ত্র সজ্জিত হচ্ছে। পাশাপাশি বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। ফলে আধিপত্য বিস্তারের খেলা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়