ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কামরুল হাসান মঞ্জুর কবিতা-কনসার্ট || রবিশঙ্কর মৈত্রী

রবিশঙ্কর মৈত্রী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কামরুল হাসান মঞ্জুর কবিতা-কনসার্ট || রবিশঙ্কর মৈত্রী

দেশে যা চিনতে পারিনি, বুঝতে পারিনি, প্রবাসবাসের সুবাদে তা নতুন করে জানতে পারছি। জেনে আনন্দিত হচ্ছি। মাঝে মাঝেই তাই রবীন্দ্রনাথের গানই গুনগুন করি— কতো অজানারে জানাইলে তুমি...

কবিতার কনসার্টকে পাঁচ বছর আগেও মানতে পারিনি। যেদিন শুনেছিলাম কোলকাতায় কবিতার কনসার্ট হচ্ছে। শোভন সুন্দর বসু, পলাশ দাস— এঁরা আবৃত্তির ব্যান্ড চালু করেছেন, শুনে একটু মাথা ঘুরে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এই বুঝি কবিতা নষ্ট করার মোচ্ছব শুরু হলো।

ভুল ভেঙেছিল ফ্রান্সের আলেসে এসে। এখানে এসে দেখি, ফরাসিরা দুশো বছর আগে থেকেই কবিতার কনসার্ট করেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত লোককবি ক্লোদ সির্ক খোলা ময়দানে এবং ইনডোরে আশি বছর বয়সেও কবিতার কনসার্ট করেন। এ দেশে সারা বছরে নগরে ও গ্রামে ছন্দময় কবিতা সুরে সুরে মুখে মুখে ফেরে।

ফরাসি দেশে কবিরাই মূলত আবৃত্তি করেন বা কবিতা-কনসার্ট করেন। অভিনয় ও সংগীত শিল্পীরাও কবিতার কনসার্টে অংশ নেন মাঝে মাঝে। তবুও বলাবাহুল্য, বাংলা ভাষার জগতেই আবৃত্তির প্রসার সবচেয়ে বেশি।

ফরাসি দেশের থিয়েটার এবং নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত মুগ্ধ দর্শক আমি। এ দেশে এসে আমারও কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার কথা অন্যখানে অন্য কোনোদিন আলোচনা করা যাবে। আজ আমি আবৃত্তির কনসার্ট এবং কামরুল হাসান মঞ্জুকে নিয়েই কিছু বলতে চাই।

একুশে সেপ্টেম্বর রাতে কামরুল হাসান মঞ্জু চলে গেছেন জীবনের ওপারে, মাত্র পঁয়ষট্টি বছর বয়সে। আমি তাঁকে চিনি জানি সেই উনিশশো উননব্বই থেকে। আজ ভীষণ খারাপ লাগছে, মঞ্জু ভাইকে বলা হলো না— আপনাকে খুঁজে পেয়েছি আলেসে, নিমে, মোঁপেলিয়ে এবং প্যারিস শহরে কবিতার কনসার্টে।

কনসার্ট মানে যদিও ঐকতান-বাদন। কনসার্ট মানে যদিও সমবেত সংগীতানুষ্ঠান। কিন্তু ফরাসি দেশে থিয়েটার ছাড়া প্রায় আর সকল অনুষ্ঠানই কনসার্ট। এই মতে আমরা বলতেই পারি— বাংলা ভাষার জগতে ঢাকা কোলকাতায় রাজশাহী চট্টগ্রাম-সহ নানা স্থানে বহু বছর আগে থেকেই কবিতার কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়।

কবিতার সঙ্গে যদি সরাসরি বাদ্যযন্ত্রানুষঙ্গ থাকে, কবিতা যদি সমবেত কণ্ঠে আবৃত্তি হয়, কবিতার সঙ্গে যদি হাততালি দেওয়া হয়, কবিতা বা ছড়া যদি সুর করে একসঙ্গে কজনে মিলে উপস্থাপন করা হয় তাহলেই ফরাসি দেশের সংজ্ঞা মেনে তাকে আমরা কবিতার কনসার্ট বলতে পারি।

কবে কখন কোথায় বাংলা কবিতার কনসার্ট শুরু হয়েছে তা গবেষণার বিষয়। কবিতার কনসার্ট হয়তো-বা প্রথম শুরু করেছিলেন কাজী সব্যসাচী, হয়তো বা শম্ভু মিত্র, হয়তো বা প্রদীপ ঘোষ অথবা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। কোনো আবৃত্তি দলের নাম উল্লেখ না-করেই বলা যায় প্রায় প্রতিটি দলই আবৃত্তির কবিতা-কনসার্ট করেছে। আবৃত্তি প্রযোজনা বলতে আমরা যা বুঝি তা আসলে কবিতা-কনসার্ট।

আমি বাংলা কবিতার কনসার্ট নিয়ে ইতিহাস রচনার দায়িত্ব নিইনি। আমি শুধু বলতে চাইছি— ফরাসি দেশের কবিতা-কনসার্টে আমি কামরুল হাসান মঞ্জুকে খুঁজে পেয়েছি, এখানে এসে তাঁকে নতুন করে চিনতে পেরেছি।

আমার জানা সীমিত, কিন্তু আমার আবেগ অসীম। আমি আমার আবেগ ভালোবাসা শ্রদ্ধা দিয়ে বুঝতে পেরেছি— কামরুল হাসান মঞ্জু আবৃত্তির নতুন কাণ্ডারী। উনিশশো উননব্বইয়ের আগে আবৃত্তি-অভিজ্ঞতা আমার নেই। সুতরাং আমি আমার উনিশ বছর বয়সের প্রথম বিহ্বলতার কথাই বলতে চাই।

দৃশ্য : এক

কামরুল হাসান মঞ্জু স্বরিত আবৃত্তি চক্রের সতীর্থদের নিয়ে দর্শকপূর্ণ মিলনায়তনে জীবনানন্দ দাশের বিমূর্ত শব্দাবলি মূর্ত করে তুলছেন— আমি দেখতে পাচ্ছি সত্যি সত্যি অদ্ভুত এক আঁধার এসে গ্রাস করছে সমগ্র পৃথিবীকে। আর এই পৃথিবীর কজন আর্ত অসহায় মানুষ করুণ সুরে অন্ধকারের গান গাইছে। দেখতে পাচ্ছি— ভারী ডানায় উড়ে যাচ্ছে একলা একা শঙ্খচিল। ভিজে মেঘের বিষণ্ন বিস্তীর্ণ এপারে দীর্ঘ দুপুর রচিত হচ্ছে মিলনায়তনে।

আহা! কী অপূর্ব সেই পরিবেশনা। কণ্ঠ, দেহভাষা, অর্থপূর্ণ আলো এবং ব্যাকুলমূর্ছনাময় আবহ।

আবৃত্তি যে কতো সহজে জাদুবাস্ততাসংলগ্ন দৃশ্য রচনা করতে পারে— সেদিনই প্রথম দেখেছি। বহু বছর পর সেই আবৃত্তি-কারিগর কামরুল হাসান মঞ্জুর কাজকে আন্তর্জাতিক পরিসরে মেলাতে পেরে আমি নতুন করে অনুপ্রাণিত।

দৃশ্য : দুই

বাংলাসাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’। উত্তরাঞ্চলের লোকজ ভাষায় রচিত প্রান্তিক মানুষের এই গার্হস্থ্যশ্লোক আমি বেশ কবার পাঠ করেছি। কিন্তু যেদিন কামরুল হাসান মঞ্জু মঞ্চে নিয়ে এলেন পরানের গহীন ভিতর, সেদিন সৈয়দ হককে আমি নতুন করে আবিষ্কার করেছি। আজও অক্ষরে অক্ষরে মনে পড়ে আবৃত্তির বাজিকররা ধ্বনিমাধুর্যঋদ্ধ রুমালের সুগন্ধি বিতরণ করছেন সমবেত সকলের শরীর ও মনে-

‘জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,

চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,

মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক

কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।

চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,

বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,

নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও

অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।

 

সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,

খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,

ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,

সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়।

এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর

যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।’

সেদিন আবার মনে হয়েছিল— কবিতাপাঠের অনুপ্রেরণা আসে এভাবেই। শব্দের আড়াল ও রহস্যময়তা ভেদ করে আমরা যারা কবিতাপাঠে মনোযোগী হতে পারি না, তাদের জন্য এই সকল কবিতার কনসার্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

দল নিয়ে কিছু একটা করতে চাইলে ব্যক্তিকে গণতন্ত্রও মানতে হয়। কিন্তু সৃজনশীল মানুষ মাত্রই একটু ক্ষ্যাপাটে একরোখা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কামরুল হাসান মঞ্জু ছিলেন চূড়ান্ত সৃজনশীল পাগলাটে নাছোড়বাঁধা শিল্পী। আবৃত্তি নিয়ে যা ভাবতেন তিনি তাই করতে চাইতেন। ফলে দলের আর সবার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তিনি হয়তো একটু উদাসীন ছিলেন। সকলে মিলে যা করা যায় একলা একা তা করেওঠা যায় না।

কামরুল হাসান মঞ্জু  বারবার একা হয়ে পড়েছিলন, ফলে তাঁর কাছ থেকে আরও অসামান্য কিছু আবৃত্তিকর্ম থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আবৃত্তির পাঠশালা খুলেছিলেন কামরুল হাসান মঞ্জু। সেই পাঠশালা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একঝাঁক তরুণ তরুণী আবৃত্তিকে জীবনের অভিন্ন অবলম্বন করে নিয়েছেন। সেই তরুণ তরুণীদের বড়ো একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নতুন নতুন দলে যূথবদ্ধ হয়ে আজও সৃজনশীল আবৃত্তিচর্চা করছেন।

আমরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একেকজন প্রতিশ্রুতিশীল আবেগপ্রবণ সৃজনশীল মানুষের কাছে ঋণী হয়ে যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতার ভাস্কর্যর সামনে থেকে এক বিকেলে আবৃত্তি করছিলেন কামরুল হাসান মঞ্জু-

‘চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়

আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে,

বুকের ভেতরটা ফাঁকা

আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ

শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস...

বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা

তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর

তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে

নেমে গেছে

শুকনো রক্তের রেখা...’

সেদিনই প্রথম শুনেছি আর শিহরিত হয়েছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বিপ্লবী চে গেয়েভারাকে নিয়ে কবিতার খোঁজ আমার কাছে ছিল না। তারপর থেকে চে আমার জীবনে অন্যতম প্রেরণা। জয় গোস্বামীর কবিতা পড়ার আগে শুনেছি মঞ্জু ভাইয়ের আবৃত্তি। জয়ের মেঘবালিকার জন্য রূপকথা এবং মেঘে ঢাকা তারা— কামরুল হাসান মঞ্জুর আবৃত্তি সততই কানে বাজে। সুকান্তের সব লেখা পাঠের পরও খেয়াল করিনি তিনি লেনিনকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কামরুল হাসান মঞ্জু আবৃত্তি না করলে আমি হয়তো লেনিন কবিতাটি খুঁজেই পেতাম না।

একজন আবৃত্তিকার কতোভাবে কতো যত্নে কতো নান্দনিক করে তুলতে পারেন একেকটি কবিতা— কামরুল হাসান মঞ্জুর আবৃত্তি একনাগাড়ে শুনলে প্রতিটি ধ্বনিতে তার পরিচয় মেলে। কোনো নিয়ম বা কোনো শৈলী যদি অপরিবর্তিতভাবে চলতেই থাকে তবেই তাকে আমরা প্রথা বলতে পারি। কামরুল হাসান মঞ্জু প্রথা ভেঙেছেন। তাঁর আবৃত্তিপ্রথাকে এখনও আমি সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারিনি, চিনতে পারিনি, অতএব তাঁর নতুন প্রথা ভাঙার প্রশ্নই ওঠে না।

কামরুল হাসান মঞ্জু আর সকলের মতোই একলা একা অমৃত পথের যাত্রী হয়েছেন, কিন্তু আবৃত্তির যাত্রা পথে নতুন কিছু বাহন দিয়ে গেছেন। আমরা তাঁকে ভুলব না।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়