ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আরবে নারী শ্রমিক নিগ্রহ, মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ২ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আরবে নারী শ্রমিক নিগ্রহ, মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ চাকরি, ব্যবসা, পড়াশোনা করছেন। তারা প্রতিবছর দেশে ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ফলে আমাদের ফরেন রিজার্ভ  ফান্ড একটি শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়িযে আছে। যারা যখন সরকারে থাকে তারা তখন এর ক্রেডিট নেয়। আসলে বিদেশে লোক যাওয়ায় সরকারের কতটা সদিচ্ছা এবং বাস্তবসম্মত ভূমিকা আছে তা সচেতন মানুষ সবারই কমবেশি জানা। বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট থেকে শুরু করে বিমানবন্দর এবং বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর যে ভূমিকা তাও অজানা নয়।

পাসপোর্ট পাওয়া নাগরিক অধিকার। অথচ পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে, বিভিন্ন অজুহাতে নাগরিককে ঘাটে ঘাটে হয়রানির শিকার হতে হয়। এত সরকার এলো-গেলো কিন্তু এই জায়গাটিতে আশানুরুপ কোন পরিবর্তন এখনও এলো না। বিমানবন্দরের সেবার কথা না-ই বা বললাম। সবাই ভিআইপি হতে চায়। বড় বড় মাস্তান, বড় বড় চাঁদাবাজরাও বিমানবন্দরে ভিআইপি মর্যাদায় পার হতে চায়, কারণ তারা অযথা হয়রানির শিকার হতে চায় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ কী করবে?

বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। কিন্তু এসব দেশ বিশেষ করে সৌদি আরব আমাদের দেশের শ্রমিকদের সঙ্গে যে আচরণ করছে তা মানবতাবিরোধী। কিন্তু আমাদের মিশনগুলোর ভূমিকা বরাবরের মতোই দুঃখজনক। সেই সুযোগে দেশগুলো আমাদের শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের ওপর সৌদি আরবের ব্যবহার। মহানবী (দ:) মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণের সময় সেখানকার মানুষ ছিলেন বর্বর, নিষ্ঠুর। কিন্তু মহানবীর সংস্পর্শে এসে তারা হয়েছিলেন সোনার মানুষ। পরশ পাথরের মতো তারা খাঁটি ও বিশুদ্ধ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। লুণ্ঠনকারী আর দস্যুরা এমন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন যে, পানির অভাবে তারা মারা গিয়েছেন কিন্তু অন্যের কষ্টের কথা মনে করে কেউ আগে পানি পান করেননি।

চৌদ্দশ বছর পরে কী হয়েছে সেই সৌদি আরবের? সৌদি আরবের ক্ষেত্রে নিয়ম কানুন, আমাদের দূতাবাসের দুর্বলতা ইত্যাদি সবই ধরে নিলাম ঠিক আছে কিন্তু মানবতা এবং ইসলামের শিক্ষা বলতে তো একটি কথা আছে। সেটি যদি খোদ সৌদি আরবেই চর্চা না হয় তাহলে হবেটা কোথায়? ইসরাইলে না আমেরিকায়? কিন্তু আমেরিকাও তো সৌদি আরবের মতো মানুষের ওপর এত নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে না, বরং তারা অনেক মানবিক আচরণ দেখায়।

গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায় শুধু ২০১৮ সালেই সৌদি আরব থেকে দশ হাজারের বেশি শ্রমিক বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৮ হাজারেরও বেশি শ্রমিক সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন। যে সব কোম্পানিতে গিয়ে তাদের কাজ করার কথা, দালালদের সুবিধামতো তারা অন্য জায়গায় কাজ করতে যাওয়ায় পুলিশ অবৈধ হিসেবে তাদের ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তারা ধার দেনা করে বিদেশে গিয়ে খালিহাতে দেশে ফিরছেন। দূতাবাসের কথা- এক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে কাদের করার অছে? অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থা বলছে- সেখানে ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে এ বছর ৯০০ জনের মতো বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে নারী শ্রমিকদের মৃতদেহ দেশে আসার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। ৪৮ জনের মৃতদেহ দেশে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০জনই সৌদি আরবে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে আত্মহত্যা করেছেন।

এক নারী বলেছেন, তিনি দেড় বছর ছিলেন সৌদি আরবে। তার মধ্যে পাঁচ মাসই কাটাতে হয়েছে পুলিশের হেফাজতে। যৌন প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় টানা তিনদিন তাকে খেতে দেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে মেরে হাত ভেঙে দেয়া হয় এবং বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। গভীর রাতে পুলিশ বাসার সামনে পেয়ে থানায় নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা দেয়ার পর সেখানকার এজেন্টের মাধ্যমে তাকে আবারো ঐ বাড়িতেই ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিরে যাওয়ার পর তার উপর শারীরিক অত্যাচার এবং যৌন নির্যাতন চলতে থাকে। ঐ বাসায় এক বছর কাজ করে মাত্র দুই মাসের বেতন দেয়া হয়েছে। অথচ সৌদি আরবে যাওয়ার আগে দালাল গোপন করেছিল যে, তাকে গৃহকর্মীর কাজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ‘বাবা-মা সুদে টাকা ধার নিয়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিল। সেখানে সব নির্যাতন, অত্যাচার সহ্য করেও কাজ করতাম টাকার জন্য। কিন্তু টাকা চাইলেই আমার ওপর চালানো হতো অকথ্য নির্যাতন। একবছর কাজ করলেও শেষপর্যন্ত দুইমাসের আংশিক বেতন দেয়া হয়।’ সেই নারী নিজেই বলেছেন তার ভয়াবহ দুরবস্থার কথা। পত্রিকার পাতাতেও এসেছে এসব ঘটনা। এরকম প্রায় একই ধরনের ঘটনা সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা শত শত নারী গৃহকর্মীর সঙ্গে ঘটেছে।

আরেক এক নারী বলেছেন, ‘আমার নিয়োগদাতা আমাকে আসতে দেয়নি। আমার নামে কেস করেছে যাতে জীবনেও বাংলাদেশে আসতে না পারি। মামলায় বলেছে, আমাকে আনতে তাদের চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, সেই টাকা আমাকে ফেরত দিতে হবে। তখন দূতাবাসে অনেক কান্নাকাটি করেছি, হাতে পায়ে ধরেছি দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য। কিন্তু তারা বলেছে তোমার নামে মালিক মামলা করেছে। আমি বললাম, আামি যে বেতন বকেয়া দুই আড়াই লাখ টাকা পাব সেটা আর চাই না, আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তারা আমাকে কোর্টে তুলেছে। আদালতের রায় পাওয়ার পরই আমি দেশে ফিরি, তাও এক বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায়। কোন টাকা তো আনতেই পরিনি বরং বাড়ি থেকে আরও লাখখানেক টাকা খরচ হয়েছে। আমি গার্মেন্সে চাকরি করে খাব তবু আর বিদেশে যাব না।’

আরেক নারী অভিযোগ করে বলেছেন, ‘আমি যে গৃহে ছিলাম সেই গৃহের কর্তাসহ তার তিন ছেলে আমাকে নিয়মিত ধর্ষণ করতো। ঐ বাড়িতে কোন মেহমান এলে তারাও ধর্ষণ করতো। আমার চেয়ে কম বয়সী এক কাজের মেয়ে ছিল। তাকে পুরো উলঙ্গ করে কাঁচের একটি ঘরে রাখা হতো।’

যে দেশের মাটিতে মহানবী (দ:) ঘুমিয়ে আছেন সেই দেশের মানুষের এই আচরণ? স্রষ্টা তাদের মাটির নিচে দিয়েছেন অফুরন্ত সম্পদ। এই সম্পদের অংশীদার কি তাদের একার? তাদের উচিত দুনিয়ার যত গরিব দেশ আছে বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত তাদেরকে প্রকৃতঅর্থে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা। ইসলামের শিক্ষা তো তাই বলে। কিন্তু কী ভূমিকা তারা পালন করছে? গরিব দেশ থেকে তারা তাচ্ছিল্যভরে কাজের লোক নিচ্ছে। কাজের লোক নিয়ে তারা তাদের সাথে কৃতদাসের মতো আচরণ করছে। অথচ হংকং-এ যে সব মেয়েরা কাজে যায় তাদের সাথে গৃহকর্তারা নিজ মেয়ের মতো আচরণ করে। তাহলে সৌদি আরব যেখানে গোটা মুসলিম বিশ্বের পূণ্যভূমি সেখানে কেন এই অমানবিক আচরণ?  তাদের বাসায় প্রচুর উন্নত মানের খাবার। সেই খাবার তারা ফেলে দেয়, পশুকে দেয়, অথচ কাজের লোকদের খেতে দেয় না। উল্টো তাদের ওপর চলে পাশচিক নির্যাতন।

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল সৌদি আরব গিয়েছিলেন। প্রতিনিধিদলের সুপারিশে বিদেশে পাঠানোর আগে নারীদের কমপক্ষে একমাস প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ দেয়া এবং চুক্তির শর্ত সম্পর্কে বাস্তব ধারণা রিক্রুটিং এবং সৌদি নিয়োগকর্তার বিস্তারিত ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর রাখা, নারী গৃহকর্মীদের পাঠানোর আগে সব তথ্য সম্পর্কে দূতাবাসকে অবহিত করার কথা বলা হয়।  মন্ত্রণালয় থেকে আরও বলা হয় সৌদি আরবে নারীরা নির্যাতনের শিকার হলে আইনি পদক্ষেপ নেয়া যাবে। কিন্তু বিপদে পড়লে নারীরা দূতাবাসের সাহায্য নেন না। একথা বলেছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিজে ( প্রথম আলো)। তারা পালিয়ে সেফ হোম বা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে- নারীরা দূতাবাসে যায় না কেন? তখন মালিকপক্ষ উল্টো ওই নারীর বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। দেশে ফেরার পরও রিক্রুটিং এজেন্সি বা দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন না। অভিযোগ করে কি কোন লাভ আছে? সর্বদাই আমরা শুনছি- দালালদের কারণে, রিক্রুটিং এজেন্টদের কারণে নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মন্ত্রণালয় তাহলে কী ভূমিকা পালন করছে?

 

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়