ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূল দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জোরালো হচ্ছে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১২ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপকূল দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জোরালো হচ্ছে

বছর ঘুরে আবার এসেছে ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের প্রেক্ষাপটে এই দিবসের গুরুত্ব অনেক বেশি। সে বছর এই দিনে উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রলয় বয়ে গেছে। ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল গোটা উপকূল। অসংখ্য মানুষ স্বজন হারিয়ে পথে বসেছিল। অনেক পরিবার একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। সরকারি হিসাবে পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণহানির কথা বলা হলেও বেসরকারিভাবে এ সংখ্যা প্রায় দশ লাখ! সাদাচোখে এটা অনেক বড় ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু যখন জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠান এই প্রলয়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতি বলে আখ্যা দেয়; তখন আমাদের কাছে এ ঘূর্ণিঝড়ের গুরুত্ব অনেকখানি বেড়ে যায়। এই প্রলয়কে সামনে রেখে উপকূল অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অধিকার ও সম্পদের সুরক্ষার তাগিদে ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস হিসাবে পালন করা হচ্ছে।  

শুধু সংকট নয়, উপকূল অঞ্চলজুড়ে রয়েছে অবারিত সম্ভাবনা। নোনাজলের ঝাপটা, দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মধ্যেও জেগে থাকে স্বপ্ন। উপকূলের কৃষক-জেলে-মজুর আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে দেয়, গতিশীল করে। এরা থাকে প্রাকৃতিক বিপদে। সংকট এদের পিছু ছাড়ে না। মৌসুমজুড়ে হাজারো দুর্যোগ দুর্বিপাক মোকাবেলা করে এগিয়ে চলে মানুষগুলো। এই মানুষগুলোর কথা বলতে, তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরতে একটি দিবস অপরিহার্য। এ অঞ্চলের সুরক্ষা, এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় এমন একটি দিবসের প্রয়োজনীয়তা এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। প্রস্তাবিত সেই দিবসটি উপকূল দিবস। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় স্মরণে এ দিবসের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাংলাদেশের উপকূল নির্ধারণ করা হয়েছে তিনটি নির্দেশকের ভিত্তিতে। এগুলো হচ্ছে: ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি ও লবণাক্ততার প্রভাব। ১৯টি জেলা উপকূলের আওতাভূক্ত। এরমধ্যে তিনটি জেলা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। বাকি ১৬ জেলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, পূর্ব-উপকূলের ৫ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর; মধ্য-উপকূলের ৮ জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, বরিশাল, চাঁদপুর, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। প্রতিনিয়ত বহুমূখী প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে এই এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। দুর্যোগে সব হারাচ্ছে; তারপরও আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সংকট ও সমস্যা যেমন এই এলাকায় রয়েছে, তেমনি অবারিত সম্ভাবনাও রয়েছে উপকূলজুড়ে। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিপুলসংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর তাদের আহরিত মাছ জাতীয় অর্থনীতির বিরাট অংশীদার। উপকূলের উন্নয়ন, সংকট সমাধান, সম্ভাবনা বিকাশ, পর্যটনের প্রসারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্যে ২০০৫ সালে ‘উপকূল অঞ্চল নীতিমালা-২০১৫’ গৃহীত হয়। কিন্তু এই নীতির প্রতিফলন কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

কেন প্রয়োজন আরেকটি দিবসের? অবশ্যই প্রয়োজন আছে। উপকূলের জন্যও একটা দিবস প্রয়োজন আছে। উপকূলবাসীর দিকে বছরে অন্তত একটি দিনে বিশেষভাবে নজর ফেলার জন্য, উপকূলের সংকট-সম্ভাবনার কথা বছরে অন্তত একটিবার সবাই মিলে বলার জন্যে একটি বিশেষ দিন চাই। দুর্যোগ ধেয়ে এলেই গণমাধ্যম, উন্নয়নকর্মীসহ, সরকারি-বেসরকারি সকল স্তরের প্রতিনিধিগণ ছুটে যান উপকূলে। দুর্যোগে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলে আরও বেশি মানুষ ছুটে যান সেখানে। এক পর্যায়ে আসে বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ। বিশেষভাবে কেন্দ্রীয় গণমাধ্যমসমূহ তখনই উপকূলের কথা বেশি প্রচার করে। কিন্তু দুর্যোগকালীন সময়ের বাইরে স্বাভাবিক সময়েও উপকূলের মানুষের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে খবর কে রাখে? সে কারণেই উপকূলের জন্য একটি দিবসের এই দাবি। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বের জন্যই এই দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোস্টাল ডে’ হওয়া উচিত।

ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জনপদের নাম উপকূল। যেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে। কৃষকের শ্রম-ঘামের বিনিময়ে কোন বছর মাঠে ভালো ফসল হলে প্রকিৃতর বৈরিতায় সে ফসল আর ঘরে তোলা সম্ভব হয় না। কষ্টের জমানো অর্থের সঙ্গে ঋণের টাকা যোগ করে নতুন ঘর হয়তো এবছর মাথা তুলেছে, ঠিক পরের বছরই ঝড়ের ঝাপটায় মাটির সঙ্গে মিশে যায় সে ঘর। জলোচ্ছ্বাস, নদী-ভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে মানুষগুলোকে। এই হলো উপকূল!

উপকূল দিবসের ভাবনাটা আসে উপকূলের কাদামাটিতে বসেই; সঙ্গে তখন উপকূলের মানুষেরা। একজন সংবাদকর্মী হিসাবে আমি বাংলাদেশের গোটা উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে কাজ করি। আমার মনে হলো, একটা দিবসের সঙ্গে উপকূলের বিষয়গুলো যুক্ত করতে পারলে উপকূলবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি আরও সহজ হতো। ভাবতে থাকি, কোন দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে প্রস্তাব করা যায়। এমন দিবস ঠিক করতে হবে, যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। অনেক ভেবেচিন্তে বের করি ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এইদিনে উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে যে প্রলয় বয়ে গিয়েছিল; সেটাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতি। ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস প্রস্তাব করে আমি সংবাদপত্রে লেখা শুরু করি ২০১৬ সালে। ২০১৭ সাল থেকে প্রথমবারের মত উপকূল দিবস পালিত হয় উপকূলজুড়ে। প্রথম বছর ৩৪ স্থানে দিবসটি পালিত হয়। অন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ দেশীয় সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে কাভারেজ পায়। ২০১৮ সালের আরও বর্ধিত পরিসরে রাজধানী ঢাকাসহ উপকূলের ৫৩ স্থানে দিবসটি পালিত হয়। এবার ২০১৯ সালে ঢাকাসহ উপকূলের ৬০ স্থানে দিবসটি পালিত হচ্ছে। উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে উপকূল নিয়ে নিবিড়ভাবে রিপোর্টিং করতে গিয়ে আমি উপকূল দিবসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। দিবস থাকলে উপকূল ভাবনা সবার মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে সকল মহলে উপকূল-ভাবনার সুযোগ বাড়বে।

উপকূলে গণমাধ্যমের নিবিড় নজরদারির কথা আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। গণমাধ্যম কেন শুধু জরুরি সময়ে আসবে? ঘূর্ণিঝড়ের বাইরে উপকূলে কী আর কোন খবর নেই? এই আশ্রয়কেন্দ্রের কথা বলছি, বাঁধের কথা বলছি, সিগন্যালিং কিংবা সচেতনতার কথা বলছি, এগুলো নিয়ে তো বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশের কিংবা প্রচারের সুযোগ আছে। একেবারে যে প্রচার হচ্ছে না, তা নয়। তবে মাত্রাটা আরও বাড়ানো দরকার। ফলে মানুষ সচেতন হতে পারে। অসংলগ্নতাগুলো দূর হতে পারে। এর ফল হয়তো আমরা বিশেষ সময়ে অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় এলে পেতে পারি। এভাবে গণমাধ্যম উপকূলের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। ১২ নভেম্বর উপকূল দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে উপকূলকে প্রকাশে আনার পথ সুগম হতে পারে।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়