ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

পেঁয়াজের বিমান ভ্রমণ ও হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ

নজরুল মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৯, ১৯ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পেঁয়াজের বিমান ভ্রমণ ও হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ

মানবসভ্যতার ইতিহাসে অনেক আগে থেকেই পেঁয়াজ রন্ধন শিল্পের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পেঁয়াজ নিয়ে বাংলাদেশে যে কাণ্ড হচ্ছে তা নিকট ইতিহাসে আর ঘটেনি। এমনকি পেঁয়াজ নিয়ে নৈরাজ্য রোধে সরকারের একাধিক পদক্ষেপও কাজে আসছে না। সর্বশেষ এক সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দাম না কমলে হস্তক্ষেপ করা হবে বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট। ১৭ নভেম্বর রোববার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

এর আগে রোববার সকালে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন এক আইনজীবী। ওই রিটে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আরজি জানানো হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়। এর একদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সভায় বলেছেন, পোঁয়াজ বিমানে আসছে। এক সপ্তাহের মধ্যে দাম কমে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এর আগে জাতীয় সংসদে পেয়াঁজের দাম নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়। এছাড়া পেঁয়াজ নিয়ে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মাঝেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কোন নৈরাজ্যই বেশি দিন টেকে না। পেঁয়াজের নৈরাজ্যও অচিরেই ধ্বংস হবে এটা নিশ্চিত। তবে প্রশ্ন- কেন এমন হলো? মজুদদার ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই কি পদক্ষেপ নেয়া যেত না? পেঁয়াজ নিয়ে কেন এই উদাসিনতা? এমন প্রশ্ন এখন অনেকের। অনেকে মনে করছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের উদাসিনতায় এই দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যে কারণেই পেঁয়াজের ঝাঁঝ বাড়ুক না কেন- এর দায় বর্তায় কর্তৃপক্ষের ওপর।

পেঁয়াজ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত এক ডিসির কথা মনে পড়ল। ১৯৭৪ সালে পেঁয়াজের মত লবণের দামও বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সময়ের সরকার লবণের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। ওই ডিসি তখন সীমান্তবর্তি এক জেলার দায়িত্বে ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি একদিন বলেছিলেন, তার ভাষ্য অনুযায়ী লবণের দাম যেহেতু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না, তখন তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে একটু বেআইনি পন্থা অবলম্বন করলেন। ওই জেলায় যত কালোবাজারি ও চোরাচালনকারি ছিল তাদের এক স্থানে ডেকে পাঠালেন। তাদের তিনি বললেন, তোমরা এখন ভারত থেকে অন্য পণ্য চোরাচালান বন্ধ করে লবণ আনা শুরু করো। এজন্য তোমাদের আলাদা টাকা দেয়া হবে। ডিসি সাহেবের কথা শুনে চোরাচালানকারিরা এক কথায় রাজি হয়ে গেল।  কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকারও ব্যবস্থা হয়ে গেল। দুই দিনের মাথায় ওই জেলায় ভারতীয় লবণে সয়লাব হয়ে গেল। সেইসঙ্গে বাজারও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসে গেল। এটা ছিল তৎকালীন এক আমলার উপস্থিত সিদ্ধান্ত। ফলে ওই জেলাসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলায় লবণের দাম কম ছিল। অনেক সময় রাষ্ট্রীয় নীতির বাইরে থেকেও জনগণের কল্যাণ করা যায়। এটা প্রমাণ করেছিলেন তিনি।

পেঁয়াজ কাণ্ড এড়ানোর আনেক কৌশল ছিল। সরকারের আগেই বুঝা উচিত ছিল পেঁয়াজ নিয়ে সিন্ডিকেট হচ্ছে। সাথে সাথে বাজার মনিটরিংয়ে নামলে হয়তো পেঁয়াজের ঝাঁঝ থেকে জনগণ কিছুটা রক্ষা পেত। বেশি দিনের কথা নয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সার এবং পেঁয়াজ নিয়ে এমন নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল। সে সময় বেশকটি পত্রিকায় সার ও পোঁয়াজের মজুদ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল। সংবাদ প্রকাশের পর সেনা অভিযানে সার ও পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছিল। কিন্তু বর্তমানে হয়েছে ঠিক উল্টো। যেদিন সংবাদপত্রে প্রকাশ হলো পেঁয়াজ ডাবল সেঞ্চুরি করেছে। তারপর দিনই প্রতি কেজিতে বেড়ে গেল ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এ ক্ষেত্রে সংবাদ প্রকাশে মিডিয়াকেও আরও কৌশলী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ অনেক সময় মিডিয়ার খবরে মজুতদার বাড়তি সুবিধা নিয়ে থাকে। কারণ মিডিয়ায় মাধ্যমে ক্রেতা ভোক্তা যেমন সুবিধা পায় তেমনি অসুবিধাতেও পড়েন।

যেমন আলুর জন্য বিখ্যাত বৃহত্তর রংপুর।  ক’বছর আগে রংপুরে আলুর অস্বাভাবিক দর পতন হয়। মিডিয়াতে খবর আসে কৃষকরা আলু বিক্রি না করে গরুকে খাওয়াচ্ছেন। এ ধরনের খবরের নেতিবাচক জের গিয়ে পড়ল আন্তর্জাতিক বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আলুর দাম নিচে নেমে গেল। সে সময় চট্টগ্র্রাম থেকে এক রপ্তানীকারক ফোনে বলেছিল আলুর নেতিবাচক খবরে বিদেশী  ক্রেতারা ভারতীয় ও পাকিস্তানি আলুর দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশি আলুর দাম কমিয়ে দিয়েছে। অথচ ভারত-পাকিস্তানের থেকে বাংলাদের আলুর মান অনেক ভালো। সে সময় বিদেশে আলুর ওই দরপতন হয়েছিল মিডিয়ার কারণে এমনটাই দাবি করেছিল অনেক রপ্তানীকারক। তাই সংবাদ প্রচারেও আরো সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

আবার পেঁয়াজ প্রসঙ্গে আসি। পৃথিবীর প্রায় সব সমাজেই রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রধান দেশ হচ্ছে চীন ও ভারত। বাঙালির খাদ্য তালিকায় পেঁয়াজ অবিচ্ছেদ্য উপাদান। পেঁয়াজ সাধারণত মসলা হিসাবে ব্যবহৃত হলেও সবজি ও সালাদ হিসাবেও পিঁয়াজের ব্যবহার সব দেশেই প্রচলিত। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে বছরে ২২ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা আছে। গত মৌসুমে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ১৯ লাখ ৩০ হাজার টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৯২ হাজার টন পেঁয়াজ। গেল মৌসুম থেকে এখন পর্যন্ত পেঁয়াজের জোগান এসেছে ২৪ লাখ ২২ হাজার টন। এ পরিমাণ পেঁয়াজ আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত খাওয়ার পরও ২ লাখ টন উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তবে এই পরিসংখ্যান নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি মোকাবেলা করতে হয় বিদেশ থেকে আমদানি করে।

পরিশেষে বলতে চাই, পেঁয়াজ নিয়ে যে কাণ্ড হয়েছে এর সুষ্ঠু তদন্ত দরকার। সেই সাথে মজুতদারদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দ্রুত প্রয়োজন। তা না হলে পেঁয়াজের মত চাল ও ভোজ্য তেল কাণ্ড শুরু হয়ে যাবে। সে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কারণ গত এক সপ্তাহের ব্যাবধানে এ দুটি পণ্যের দামও বেড়েছে।

লেখক: সাংবাদিক




ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়