ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২০ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়

বেঁচে থাকার উপকরণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘মূল্যবোধ’। কারণ, আপনি জীবন ও মৃত্যুকে কীভাবে উপভোগ করবেন এর উপর নির্ভর করছে। একজন মানুষের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ভৌগলিক অবস্থান, জলবায়ু, শিক্ষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অনেক কিছুর সমন্বয়ে মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়। এর মাঝে পরিবারের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কিছু কিছু মূল্যবোধের বিষয় সর্বজনস্বীকৃত। যেমন, মিথ্যা বলা যাবে না; এটা পৃথিবীর সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে অবশ্য শিক্ষণীয় ও পালনীয় একটি মূল্যবোধ। আশ্চর্য হচ্ছে, আজকের দিনে আমাদের কাছে সততা একটা মূল্যবোধের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সততা মূল্যবোধ নয়, এটা মানুষের জীবনে আবশ্যিক কিছু।

মূল্যবোধ মূলত চলকের মতো। এটি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক দু’ধরনেরই হতে পারে। যে পরিবারের সন্তান ঘুষ বা অন্যান্য অবৈধ উপায়ে উপার্জন করে বিলাসী জীবনযাপন দেখে অভ্যস্ত, সে বড় হয়ে অন্যায়ভাবে টাকা উপার্জনের বিষয়টিকে নেতিবাচক মনে করবে না। এটি নিম্ন আয়ের পেশার মানুষের জন্যও সত্য। ধরুন, কেউ বাবার সাথে ব্যবসা করে। সে দেখে যে তার বাবা মিথ্যা বলে ক্রেতা ঠকায়। দুধ বিক্রেতা (হয়তো সবাই নয়) এ ক্ষেত্রে যুৎসই উদাহরণ হতে পারে। তার কাছে দুধে পানি মেশানো অন্যায় বলে মনে হবে না। এই মনে করার বিষয়টিই একজনের মূল্যবোধ।

মূল্যবোধের বিষয়টি মূলত আপনার চিন্তা, তার ফলাফল ও বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করে। এক ভদ্রলোক অফিস হতে বেশ দেরি করে বের হয়েছেন। তার সন্ধ্যা ৭.৩০ টায় এক জায়গায় পৌঁছানোর কথা। কিন্তু অতিরিক্ত যানজট থাকায় গাড়ি নিয়ে গেলে তার দেরি হয়ে যেত। ফলে তাকে হেঁটেই যেতে হলো। এর মাঝে প্রায় কাছাকাছি জায়গায় ৭ টার দিকে একজনের সাথে তার দেখা হবার কথা। তিনি যেহেতু হেঁটে গিয়েছেন তাই ঘেমে একরকম গোসল হয়ে গিয়েছিলেন। যার সাথে সাক্ষাৎ হবার কথা তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে ঐ চাকুরিজীবী ভদ্রলোক বললেন, আপনার জন্যই হেঁটে এসেছি। এটা মিথ্যাচার। কোনো মানসিক যন্ত্রণা ছাড়াই আমরা এরকম মিথ্যা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছি যা আমাদের মূল্যবোধ তৈরি করছে। আবার ধরুন, অফিসে প্রাপ্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রায় সবার মাঝে এক অশুভ প্রতিযোগিতা চলে। অন্যদের সুযোগ না দিয়ে নিজেরা বেশি বেশি পেতে চাই। বিষয়টি অন্যের কাছে অশোভনীয় হলেও যিনি বারবার সুবিধা নিচ্ছেন তার কাছে স্বাভাবিক। কারণ, তিনি এভাবেই বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন, ক) এটা তার প্রাপ্য, অথবা খ) তিনি এটা কৌশলে অর্জন করেছেন, অথবা গ) তিনি ইতোপূর্বে বঞ্চিত হয়েছেন, ঘ) কে পেল বা না পেল তাতে তার কিছু যায় আসে না, ইত্যাদি। মূলত, তিনি বিষয়টিকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন। এটাই তার মূল্যবোধ, ভাল না খারাপ সেটা অন্য ইস্যু। উদ্দেশ্য হাসিল হলে তিনি সবার কাছে দোয়া চাইবেন, যাতে পরবর্তী সময়ে আবারও কোন না কোনভাবে justify করতে পারেন।

অন্যের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের গভীরতাও মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে। যার সঙ্গে আপনার মূল্যবোধ মিলে যাবে সেই আপনার প্রকৃত বন্ধু হতে পারবে। এটা মূলত নির্ভর করছে বেড়ে ওঠার উপর। দুজন মানুষকে দীর্ঘদিন একসঙ্গে রেখে প্রশিক্ষণ দিয়েও তাদের মধ্যে একই ধরনের মূল্যবোধ সৃষ্টি করা অসম্ভব কিন্তু দুটি পরিবার একই রকমের হলে তা অনেকাংশেই সম্ভব। যে পরিবারে অনেক গালাগালি হয় সেখানে ‘কুত্তার বাচ্চা’ কোন বিষয়ই নয়। বিপরীত চিত্র দেখা যাবে, যে পরিবারে গালাগালি দেয়া হয় না সেখানে। বলতে দ্বিধা নেই, মূল্যবোধ গঠনের নেপথ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের উৎস পরিবার। কারণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবার যেভাবে কাজ করছে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান (যেমন, শিক্ষা, ধর্মীয়, ইত্যাদি) সেভাবে কাজ করছে না। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আশানুরূপ ভূমিকা পালন করছে না। একটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষণীয়, যারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে service delivery দিয়ে থাকেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে আপনি প্রত্যাশিত সেবা তখনই পাবেন যখন দেখবেন তিনি কোনো ভালো পরিবার থেকে উঠে আসা কেউ। কার্যত, আমাদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিবাচক ও সঠিক মূল্যবোধ তৈরিতে খুব দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছে না।

ইতিহাস, সংস্কৃতি বিবেচনায় একেকটা দেশের মূল্যবোধ একেকরকম। একটি চমৎকার বাস্তব ঘটনা বলি। ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক লোক টিভি কিনে বাসায় ফিরেছেন। দোকানি বলে দিয়েছিল, কোন সমস্যা থাকলে সে পণ্যটি ফেরত নিবে। বাসায় আনার পর তিনি টিভি সেট করতে গিয়ে স্ক্রিন ভেঙে ফেলেন। তিনি ফন্দি আঁটেন, গিয়ে বলবেন এটি আগে থেকেই ভাঙ্গা ছিল। দোকানে গিয়ে যথারীতি তাই বললেন। সাথে উনার ছেলে ছিল। মজার বিষয় হলো, ছেলে দোকানদারকে সত্যটা বলে দেয় যে, তার বাবা বাড়িতে নিয়ে ভেঙে ফেলেছেন। লোকটি লজ্জা পায়। দোকানি তাকে নতুন একটি টিভি দিয়ে দেয়। ফেরার পথে তার উপলব্ধি হয়, তিনি সততা শিখতে পারেননি যেটা তার ছেলে এ দেশে জন্মগ্রহণ করার জন্য শিখেছে। উন্নত দেশের মানুষ অপেক্ষাকৃত সৎ, অন্তত ব্যক্তি পর্যায়ে। এখানে ভ্যালু-এর পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, দুদেশের মূল্যবোধ দুরকম। তবে এটাও সত্য যে উন্নত দেশের social structure, social capital এর সাথে আমাদের মিলবে না। ধরুন, যাত্রাপথে আশেপাশের মানুষের সাথে কোন কারণ ছাড়াই অনেক গল্প করি। এটা আমাদের সমাজের strength. ইউরোপের দেশসমূহে এরকমও হতে পারে যে দীর্ঘদিন প্রতিবেশী হিসেবে থেকেও তার সাথে আপনার কথা হয়নি। আমাদের দেশে হলে মাসে অন্তত চারবার ঝগড়া হবার আশঙ্কা বেশি। আমরা লিফটে অনেক কথা বলি যেটা হয়তো ইউরোপে বেমানান। এগুলো মূল্যবোধ গঠনে ভূমিকা রাখে। দারুণ আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ছেলে-মেয়েদের বন্ধুত্বের ধরন একেক দেশে একেক রকম। আমাদের দেশে কি হয়? চোখাচোখি হলেই প্রেম হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ধরুন, কোন মেয়ে রিকশা করে যাচ্ছে। পথে দুর্ঘটনার কারণে কোন ছেলে তাকে হাসপাতাল পৌঁছে দিল। নিশ্চিত থাকুন, বয়স আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো ইগো সমস্যা না থাকলে প্রেম হয়ে যাবে। আর যদি কারো আগের প্রেম থেকে থাকে তা হুমকির মুখে পড়বে। এরকম হাজারো উদাহরণ দেয়া যাবে। ছেলেমেয়ের সম্পর্কের ধরন বুঝাতে আমাদের চলচ্চিত্রের সাহায্য নিতে চাই, যা আসলে আমাদের সমাজ, মূল্যবোধেরই প্রতিচ্ছবি। দেখা যায়, নায়কের ধাক্কায় নায়িকার বই পরে যাবার সাথে সাথেই প্রেম শুরু হয়ে যায়। রাস্তাঘাটে, ডাক্তারের চেম্বারে, এ বাসার ছাদ থেকে ও বাসার ছাদে দেখাদেখিতে, বাসের কাউন্টারে কিংবা লঞ্চের ডেকে একটু সময় নিয়ে দেখার সুযোগ পেলে দুজন অপরিচিত ও সমবয়সী (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের বয়স কম), লাজুক কিংবা চটপটে ছেলেমেয়ের প্রেম শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। ট্রেনে ভ্রমণ করার সময় আড়চোখে পথ চলতে চলতে নেমেই বিয়ে হয়ে যেতে পারে!

আমাদের সমস্যা হলো, ছোটবেলা থেকেই একটি বড় রকমের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছেলেমেয়ে, মহিলা-পুরুষের সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। ফলে এক ভিন্নমাত্রার অনুভূতি নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি। উন্নত দেশ ভ্রমণ করলে লক্ষ্য করবেন- মেয়েরা অবলীলায় সবার সাথে হাত মিলাচ্ছে, hug করছে। আমরা কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রস্তুত হই। মেয়েদের সাথে শারীরিক স্পর্শের বিপরীতে আন্দোলিত হবার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে যার যার মূল্যবোধের উপর। আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা যদি ইউরোপের কোন দেশ হলে দেখা যাচ্ছে আপনি কোন সুন্দর, সুশ্রী মেয়ের সাথে আলিঙ্গন করেও কোনভাবেই শিহরিত হচ্ছেন না। আবার জন্ম যদি বাংলাদেশে হয় তাহলে রাস্তায় হেঁটে যাবার সময় কোন মেয়ের সাথে ন্যূনতম স্পর্শেও আপনি শিহরিত হতে পারেন। পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে আপনার মূল্যবোধের উপর। ঠিক এ কারণেই সমাজে ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ বেশি হচ্ছে। মহিলা বা মেয়েদেরকে আপনি যতই আপনার বিছানার সঙ্গী ভাববেন আপনি ততই শারীরিকভাবে অস্থিরতার মধ্যে থাকবেন। যদি শুধু মানুষ হিসেবে ভাবেন তবে এ অপ্রাসঙ্গিক অস্থিরতাটুকু থাকবে না। ছেলেদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় বলছি, মেয়েদের মা, বোন কিংবা সন্তানের মতো দেখলে নিজের শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সুযোগ তৈরি হবে। জৈবিক চাহিদা নিয়ে পুরুষ কিংবা নারী হয়ে বেড়ে ওঠা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এর বাইরে আমাদের মানুষ হয়ে উঠতে হবে। মানুষ হবার প্রক্রিয়া সহজ নয় বরং, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ সকল প্রতিষ্ঠান মিলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করলেই কেবল মানুষ তৈরির পথ সুগম হয়। আর এভাবেই একটি জাতির মূল্যবোধ গড়ে উঠে।

আমাদের দেশে অনেকক্ষেত্রেই একজন মানুষের (পরিবারে যিনি অধিক ভূমিকা রাখেন) মূল্যবোধের উপর একটা পরিবারের মূল্যবোধ নির্ভর করছে। বিশেষ করে, পিতা কিংবা মাতার উপর। তাই সন্তানদের সঠিক পথে নিয়ে চলতে নিজেদের মূল্যবোধের কোন ব্যত্যয় করা চলবেনা। পরিবারের সমষ্টি হলো সমাজ। পরিবারগুলোর মূল্যবোধের উপর সমাজ এবং বৃহৎ অর্থে রাষ্ট্রের মূল্যবোধ নির্ভর করে। শুরুতে যে চলকগুলোর কথা বলেছিলাম তার সাথে আরও কয়েকটি বিষয় মূল্যবোধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ধর্মীয় অনুশাসন এবং রাষ্ট্রের আইন। উদাহরণস্বরূপ, জনসাধারণের মধ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ হবার আগ পর্যন্ত একজন ধূমপায়ীর কাছে যানবাহনে কিংবা অফিস/আদালতে ধূমপান না করে থাকাটা অনেক কষ্টকর। কিন্তু আইন হবার পর অনেক স্বস্তিতে থাকা যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে সামাজিকভাবে আমাদের দুটি বিষয় মূল্যবোধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। এক. সর্বক্ষেত্রে সততার অভাব, দুই. পরচর্চা কিংবা পরনিন্দা। সততার সংজ্ঞা কী? চিন্তা, ভাষা ও কর্মে সৎ থাকাই প্রকৃত সততা। মজার বিষয় হচ্ছে, সততার চর্চা একটা যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে অথচ সবাই সৎ হবে সেটাই বিশ্বজগতের নিয়ম। পরচর্চার বিষয়টি খুবই ভয়ানক। সারাক্ষণই আমরা এর-তার বদনাম করে যাচ্ছি এবং আরাম পাচ্ছি, পরশ্রীকাতর হচ্ছি। যে সামনে নাই, সেই সবচেয়ে বেশি খারাপ; আমরা যারা সামনে বসে আছি তারাই জগতের সেরা। এ মূল্যবোধগুলো আমাদের মাঝে বেড়ে উঠছে এবং আমরা একে লালন করছি। বিশ্বায়ন ও বিশ্বব্যাপি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার আবশ্যিক উপস্থিতির কারণে শুধু লাভের পিছনে ছুটতে গিয়ে মানুষের মূল্যবোধের ধরণ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুকে উপভোগ করতে হলে নতুন করে ভাবতে হবে।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়