ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

নিমককাহিনী

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২০ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিমককাহিনী

এ অঞ্চলে লবণ বড়ো স্পর্শকাতর বস্তু। কেউ কারো বাড়ি গিয়ে পানীয় আহার্য দিয়ে উদরপূর্তি করে অকৃতজ্ঞের ন্যায় যদি আচরণ করে, তাতে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু কেউ কারো নিমক বা লবণ খেয়ে ভুলে গেলে বা অস্বীকার করলে খবর আছে! লোকে তাকে দুয়ো দেবে, বলবে নিমকহারাম। সামান্য একটু লবণ, তা নিয়ে এতো বড়ো খোঁটা! বিজ্ঞানীরা বলেন, সারাদিন একজন মানুষের জন্য ৫ গ্রাম লবণ যথেষ্ট। এই ৫ গ্রাম লবণের জন্য ‘৫ টন সমগ্র বাংলাদেশ' মার্কা অপবাদ! তাহলে বুঝুন, বাঙালি জীবনে তিন আঙুলের এক চিমটি লবণের কি মহিমা!

প্রশ্ন আসতেই পারে, বাঙালির পাতে লবণ উঠল কবে থেকে?  প্রাচীণ ঋগ্বেদের মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতার লোকজনের খানাপিনা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। উনারা যব, গম, ভাত, দুধ, ফলমূল, মাছ ও মাংস নিয়মিত খেতেন। প্রিয় খাদ্য ছিল ঘি, মাখন, দই। কিন্তু সেখানে লবণের কোন বর্ণনা নেই। আর যেসব খাদ্যপদের নাম পাওয়া যায় কোনটিতেই লবণ অপরিহার্য ছিল না। অতএব ধরে নেয়া যায় লবণ সে আমলে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান ছিল না। সিন্ধু সভ্যতার লোকজন লবণ গ্রহণ করুক বা না করুক, এই সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে লবণের অবদান অনস্বীকার্য। অবাধে বৃক্ষনিধন ও নগরায়নের ফলে ভূগর্ভে পানির সংকট দেখা দেয়। ফলে ভূগর্ভস্থ লবণ উপরে উঠে আসে। তাতে মানুষ বেশিদিন আর সেখানে টিকে থাকতে পারেনি।

ভারতবর্ষে লবণের গুরুত্ব জানা যায় আলেকজেন্ডার দ্য গ্রেটের অভিযানের কাহিনী পড়ে। দিগ্বিজয়ী এই গ্রিক বীর খ্রিস্টের জন্মের ৩২৮ বছর আগে ভারতে এসেছিলেন। তার সঙ্গের সৈন্যদের যুদ্ধজয়ের পর সকল বস্তু লুণ্ঠনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কেবল তিনটি বস্তু বাদে। এই তিনটি বস্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এসব পাওয়া গেলে সম্রাটের নামে জমা দিতে হবে। এ তিন বস্তু হলো: নারী, সোনা ও লবণ। পড়ে একটু ধাক্কা খাচ্ছেন, লবণ কেন? আসলে তখনও মানুষ সেভাবে সমুদ্র থেকে লবণ আহরণ শিখেনি। মাটি খুঁড়ে লবণের পাহাড় থেকে লবণ সংগ্রহ করা হতো। লবণের দাম সোনা রুপার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।

প্রাচীন গ্রিস দেশে সৈনিকদের বেতন দেয়া হতো লবণ দিয়ে। তবে এই কিংবদন্তির সাথে একমত নই আমি। আমার ধারণা, লবণের মূল্যকে একক ধরে সেসময় সৈন্যদের মজুরি দেয়া হতো। যাই হোক, বলা হয় ‘সল্ট’ শব্দ থেকে সেলারি শব্দটি এসেছে। সেসময় গ্রিকরা দাস বেচাকেনায় লবণকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করত। গ্রিকদের দেখিয়ে দেয়া পথ থেকে পরবর্তী সময়ে আর সরে আসেনি ভারতবর্ষের রাজ-রাজন্যরা। তারা বরাবরই লবণের ব্যবসা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। নবাবী আমলে বাংলায় আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্যে অন্যতম পণ্য ছিল লবণ। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলার লবণ যেত। সুদূর কাশ্মীরের বণিকরা পর্যন্ত এসে সুন্দরবনের মুলঙ্গিদের দাদন দিয়ে লবণ সংগ্রহ করত। সেই লবণ নৌপথে সহজেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যেত। প্রচুর লবণ যেত আসামে। সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রাক-পলাশী বাংলা’ বই থেকে জানা যায়, পাঁচ-ছ’শ টনের অন্তত ৪০ টি বড়ো নৌকা যেত আসামে প্রতিবছর। এদিকে লবণের ব্যবসায় অত্যাধিক লাভের কারণে তা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকত। রাজপরিবারের লোকজন এ ব্যবসা করতেন। আলিবর্দীর বেগম শরফুন্নেসা লবণের ব্যবসা করতেন। তবে তাঁরা সরাসরি এ ব্যবসা করতেন না। আর্মেনিয় বণিকরা তাদের হয়ে বাণিজ্য চালাত। সে-সময় বাংলার সেরা ধনী (জগৎশেঠের পর) খোজ ওয়াজিদ খাজা ওয়াজিদ লবণের ব্যবসা করেই ধনী হয়েছিলেন। ইউরোপীয়দের লবণের ব্যবসা করা ছিল নিষেধ। কিন্তু কিছু স্বাধীন ইউরোপীয় ব্যবসায়ী নবাবের কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে দেদারে সে ব্যবসা করত। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে আসা খালি জাহাজ উত্তমাশার উত্তাল সাগর পার হতে পারত না বলে সেসবের খোলে প্রচুর লবণ নিয়ে আসত তারা। সেই লবণ জলের দামে কিনে বাণিজ্য করত স্বাধীন ব্যবসায়ীরা। যাদের তারা ইন্টারলুপার বলত। এ নিয়ে ইংরেজদের সাথে একাধিকার বিসংবাদ হয়েছিল বাংলার নবাবের।

লবণ নিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ বিদ্রোহ-সংগ্রাম কম হয়নি। ১৭৮২ ও ৮৫ সালে এই লবণকে ঘিরে ইংরেজদের সাথে চাকমাদের যুদ্ধ হয়েছিল। চাকমা রাজা চট্টগ্রামে লবণ পানি জাল দেয়ার জন্য জ্বালানি কাঠ সরবরাহ বন্ধ করে দেন। ইতালির দুই বিখ্যাত নগররাষ্ট্র ভেনিস ও জেনোয়ার মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল লবণের খনি দখলকে কেন্দ্র করে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে লবণের অবদান স্বীকার না করলে সেটা বিরাট নিমকহারামি হয়ে যাবে। ব্রিটিশ সরকারের লবণ করারোপের প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করেন। ১৯৩০ সালের মার্চে মহাত্মা গান্ধী আহমেদাবাদের কাছে সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করেন। ২৪ দিনে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার হেঁটে এসে তিনি ডান্ডি গ্রামে বিনা-করে সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরি করেন। তার সাথে লংমার্চে আসা অগণিত মানুষও একই কাজ করেন। মূলত রাজকর না দিয়ে লবণ উৎপাদন থেকে শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন। তবে এই লবণের কল্যাণে ঔপনিবেশিক ভারতে অনেকেই আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছিলেন। জোড়াসাঁকোর এই শান শওকতের পেছনে লবণের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের অন্যতম ব্যবসা ছিল লবণের ব্যবসা।

বিজ্ঞানীরা জানান খ্রিস্টের জন্মের অন্তত ৬০০০ হাজার বছর আগে চিনের লোকজন মাটি খুঁড়ে লবণ উত্তোলন শিখেছিলেন। তখন থেকেই তাঁরা লবণ ব্যবহার করতেন। তবে লবণ নিছক খাদ্যসহায়ক উপাদন হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে না। এর বিচিত্রগামিতা রীতিমতো বিস্ময়কর!প্রাচীন বনচারী মানুষরা মাংস সংরক্ষণের জন্য লবণ ব্যবহার করতেন। মিশরীয়রা মমি তৈরিতে লবণ ব্যবহার করেছিলেন। তারা মরুভূমিতে যাত্রা করার আগে লবণ ছিটিয়ে দিতেন। যাতে লবণ খেয়ে মরুভূমির দেবতা তুষ্ট থাকেন। তবে নুনের সাথে কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার সম্পর্ক সম্ভবত মিশরীয়রাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাঁরা দুই দলের মধ্যে সন্ধি করার আগে একে অপরকে লবণ খাইয়ে দিত। মানে তুমি যদি এখন কথা না রাখো তাহলে নিমকহারামি হবে।

লবণের সাথে ধর্ম বিশ্বাসও মিশে আছে। মায়া সভ্যতায় অ্যাজটেকরা লবণের দেবীকে পূজা করতেন। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষার সময় জল দিয়ে স্নান করানো হয়। তাতে সামান্য লবণ মিশিয়ে দেয়া হয়। দীক্ষার পর নবদীক্ষিতের মুখে লবণ ছোঁয়ানো হয়। বৌদ্ধরাও লবণকে পবিত্র জ্ঞান করেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর মৃতের পরিবারবর্গ লবণ ছিটিয়ে গৃহে প্রবেশ করে। যাতে অপবিত্র আত্মা তাদের পিছু না নেয়। কৃষি কাজে লবণের ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকে। খনার বচন আছে:

‘নারিকেল গাছে নুনে মাটি,
শীঘ্র শীঘ্র বাধে গুটি।’

অর্থাৎ নারিকেল গাছের গোড়ায় নোনা মাটি দিলে দ্রুত ফল আসে। আবার খনা দাঁতের চিকিৎসার জন্য নুনের কথা বলেছেনে:

‘আঁতে তিতা দাঁতে নুন, উদর ভরো তিন কোন।’

লবণ মূলত সোডিয়াম ক্লোরাইড। এতে ৪০ ভাগ সোডিয়াম ও ৬০ ভাগ ক্লোরাইড থাকে। ক্লোরাইড আমাদের দাতেঁর জন্য উপকারী। আবার ক্লোরাইডের মূল উপদান ক্লোরিন জীবাণুনাশক। আবার সোডিয়াম আমাদের শরীরের খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। সোডিয়াম আমাদের স্নায়ুর কার্যক্রম সচল রাখে। মাংসপেশীর সংকোচন প্রসারণে ভূমিকা রাখে। সোডিয়াম শরীরের জন্য দরকারি ইলেক্ট্রোলাইট। প্রতিদিন আমাদের শরীরে এক থেকে আড়াই হাজার মিলিগ্রাম সোডিয়ামের প্রয়োজন।

জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ইলেক্ট্রোলাইট, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম অপরিশোধিত লবণে পাওয়া যায়। শরীরে লবণ বেড়ে যাওয়া বা লবণের পরিমাণ কমে যাওয়া দুটিই বিপজ্জনক। তবে বাংলাদেশের মানুষের লবণপ্রীতি নিয়ে চিকিৎসকরা খুবই আতঙ্কিত। পত্রিকার এক রিপোর্টে দেখা যায়, যেখানে একজন মানুষের দৈনিক ৫ গ্রাম লবণ খাওয়া উচিত, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ ৬ থেকে ১০ গ্রাম লবণ খাচ্ছে। ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ (বিজিএস) এর প্রদত্ত তথ্য মতে বাংলাদেশ লবণ উৎপাদনে ২৭ তম। পৃথিবীর ০.৫২ শতাংশ লবণ বাংলাদেশ উৎপাদন করে। প্রাচীন কাল থেকে বাংলায় সমুদ্রের জল শুকিয়ে লবণ উৎপাদন হয়ে আসছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুলঙ্গী নামের একটি সম্প্রদায় কক্সবাজার থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলাঞ্চলে এ প্রক্রিয়ায় লবণ উৎপাদন করে আসছিল। বর্তমানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সমুদ্রের জল শুকিয়ে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত লবণ উৎপাদন করা হয়। তবে এতোক্ষণ লবণ ঘিরে শুধু রাজ-রাজড়াদের গল্প শুনালাম। অথচ লবণ এখন একান্তই আমাদের খাদ্যপদ। পান্তা ভাতের সাথে একটু লবণ হয়ে গেলে আমরা যেন কোন প্রকারে বর্তে যাই। আমাদের লড়াই শিউলি ফুলের মতো সাদা ভাতের পাশে মতিচূর্ণের মতো সাদা একটুখানি লবণের সংস্থাপন করার। তাই তো জয় গোস্বামী লিখেছেন:

‘করি তো কার তাতে কী?
আমরা তো সামান্য লোক।
আমাদের শুকনো ভাতে
লবণের ব্যবস্থা হোক।’

কিন্তু বিধিবাম। এই লবণটুকুও নির্ভেজাল পাবার অধিকার যেন আমাদের নেই। লবণের ভেজাল অবশ্য আজকালকার ব্যাপার নয়। মধ্যযুগে লবণের খাদ্যমান বাড়ানোর জন্য পর্তুগিজরা কড মাছের তেল লবণের সাথে মিশিয়ে দিত। এখন মেশানো হয় আয়োডিন। সমুদ্রদূরবর্তী অঞ্চলের মানুষের শরীরে আয়োডিনের অভাব পূরণে লবণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। লবণে বাড়তি জিনিসের মিশ্রণ ছিল সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু এদেশের ব্যবসায়ীরা লবণে ভেজাল মিশিয়ে জাতির সাথে করছে চরম নিমকহারামি। বিদেশ থেকে কম দামে আনা সোডিয়াম সালফেট (যাকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট বলে) সাধারণ লবণের সাথে মিশিয়ে প্যাকেট করে বিক্রি করা হচ্ছে। ইউনিসেফ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে কম আয়োডিন দেয়া হচ্ছে। তাই লবণ খেয়ে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারছি না। বলতে পারছি না- আপনার বিশুদ্ধ নিমকের জন্য চিরজীবন বিশুদ্ধ কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে যাব।

 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, নিউ মার্কেট, ঢাকা

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়