ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সবুজ স্থাপত্যে বাঙালির গৃহ নির্মাণে স্বভাব ও রুচি

হোসনে আরা হ্যাপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৬, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সবুজ স্থাপত্যে বাঙালির গৃহ নির্মাণে স্বভাব ও রুচি

আগের দিনের জ্ঞানীরা গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে এ কথা বিবেচনা করতেন-

‘দক্ষিণ দুয়ারী স্বর্গবাস

উওর দুয়ারী সর্বনাশ

পূর্বে হাঁস

পশ্চিমে বাঁশ।’

ভৌগলিক বিশ্লেষণে, আমাদের গ্রীষ্ম প্রধান দেশ হওয়ায় দক্ষিণ দিক সবচেয়ে বিবেচ্য দিক। উত্তর দিক সবচেয়ে নেতিবাচক দিক। পশ্চিম দিক সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক। পূর্ব দিকও বিবেচ্য। শহরের কঠিন ও ব্যস্ত জীবনের বাইরে ইট পাথরের বদ্ধ ভবনের মাঝখান হতে নিজেকে বের করে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবুন নিঃশাস বন্ধ হয়ে যাবে। সবুজে শ্যামলে ভরা, পরিষ্কার পানি ও স্নিগ্ধতার ছোঁয়া প্রাকৃতিক আলো বাতাসের সাথে যোগাযোগ এমন পরিবেশে বসবাস করা আমাদের প্রত্যেকেরই কাম্য। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো খুবই প্রয়োজনীয়।

একটি দেশের অবকাঠামো বা স্থাপত্য পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের উপর দণ্ডায়মান। ১. ঐতিহাসিক ২. সামাজিক ৩. অর্থনৈতিক ৪. ধার্মিক ৫. ভৌগলিক। সবুজ স্থাপত্য বিশ্লেষণ করার আগে আমাদের আগে ইতিহাস জানা জরুরী। কারণ, ইতিহাস হতে সমস্ত কিছুর উৎপত্তি ঘটেছে। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব যে, টেকসই ও নিরাপদ বাসস্থানের চর্চা সৃষ্টির লগ্ন হতেই বিরাজমান। আমরাও অতীতে শিল্পসাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব ও স্থাপত্যে অনেক বেশী সমৃদ্ধশালী ছিলাম। প্রতিনিয়ত স্থাপত্যের সাথে আমাদের বসবাস। শিল্প হিসেবে স্থাপত্য শিক্ষার বিষয় হলেও স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে ষাটের দশকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে স্থাপত্যে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। আধুনিক স্থাপত্যের ভাষা, রীতি, নীতির উপকরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মৌলিকতা অভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, মুঘল আমলের স্থাপনাগুলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বগুড়ার মহাস্থান গড়, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর (র.) মাজার ইত্যাদি ধর্মীয় ভবনগুলো অলঙ্কারপূর্ণ, পরিসরগুলো দৃঢ় উচ্চ, সাবলীল ও দৃষ্টিনন্দন। আবার গ্রামীণ ঘরবাড়িগুলো ডোম টাইপের। কখনো দোচালা, চৌচালা প্রকৃতির।

কালক্রমে বিভিন্ন শাসক স্থাপত্যের বিভিন্ন বিবর্তন আনলেও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে স্থাপত্যে এসেছে পরিবর্তন। এ পরিবর্তন শুধু নগরকেন্দ্রিক বড় বড় স্থাপনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। বিভিন বিদেশী স্থপতিরা বিভিন্ন সময়ে স্থাপত্যকে দিয়েছেন নানান রূপ, নানান ভাষা। যেমন বুয়েট (রিচার্ড ভুরম্যন), ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন (রবার্ট ব্রগলি), নটরডেম (পল রদ্র), সোহরাওয়ার্দি হাসপাতাল ও জাতীয় সংসদ ভবন (লুই আই কান)।

পরবর্তীতে নব্বই দশকে স্থাপত্যে আমূল পরিবর্তন সাধন করে, নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন বাংলাদেশের স্থাপত্যের জনক মাজহারুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, লাইব্রেরী, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এসব ভবনে তার স্থাপনা পরিচয় মেলে।

মাজহারুল ইসলামের লক্ষ্য ছিল, স্থাপত্যের কাঠামোগত দিক ঠিক রেখে সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ঐতিহ্যকে যথাযথ মূল্যায়ন করা। পরবর্তী সময়ের স্থপতিরা এ ধারাকে অব্যাহত রেখে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বশিরুল হক, শামসুল ওয়ারেস, নাহাস খলিল, সাইফ-উল- হক, জালাল আহমেদ প্রমুখ। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা বিশ্বের দুর্বল দেশ হিসাবে চিহ্নিত। জলবায়ু পরিবর্তন, উচ্চতর নির্গমন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, দিগুণ ঘনবসতি, শহুরে বাস্তুতন্ত্রের উপর চাপসৃষ্টি ও পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো এর জন্য দায়ী। ২০১৯ সালে এসেও অবসবাস যোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছি। আর এ প্রয়োজন থেকেই বর্তমানে সবুজ স্থাপত্যের চর্চা খুব জরুরী।

বর্তমানে আমাদের দেশে সবুজ স্থাপত্যের চর্চা শুরু হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো সবুজ স্থাপত্য কী? আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা, জলবায়ু প্রতিরোধক, প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রকৃতির সাথে মানব মনের সংযোগ স্থাপনই সবুজ স্থাপত্য। যদিও বর্তমান সময়ে ছাদে বা ব্যালকনিতে কিছু গাছ লাগানোকে ‘সবুজ স্থাপত্য’ বলি। সবুজ কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ মূলধারার স্থাপত্য হতে আলাদা। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সানোয়ার আজম (লিড) এর কর্মসূচির মাধ্যমে ‘সবুজ স্থাপত্য’র প্রস্তাব প্রনয়ন করেন। (লিড) এর কাজ হলো নকশা প্রনয়ন, নির্মাণ কাজ ও সনদ প্রদান করা। তারপর থেকে সবুজ স্থাপত্য চর্চায় স্থপতিরা তৎপর হয়ে উঠেছে। সবুজ স্থাপত্য চর্চার মাধ্যমে স্থাপত্যের বিকাশ, প্রসার ও প্রচার সম্ভব।

প্রযুক্তিনির্ভর সবুজ স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। প্রথমত: দেয়াল; যেটা সূর্যের তাপ প্রতিরোধক, তাপমাত্রা উপযোগী উপাদান, সূর্য কতটুকু অংশ বিকরিত হবে তার উপর নির্ভর করে কালার বা (কোডিং) ব্যবহার, শব্দ নিয়ন্ত্রক ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত: তাপমাত্রা উপযোগী তাপ প্রতিরোধী জানালা, বহুমাত্রিক প্যানেল যা অটোমেটিক আলো বাতাস সমন্বয়ক। তৃতীয়ত: (রুফ বা ছাদ) সূর্যে সবচেয়ে তীব্র ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় রুফ বা ছাদ। এ জন্যই তাপ প্রতিরোধী উপাদান, সূর্যরশ্মি হতে রক্ষার জন্য অনেকগুলো লেয়ার বা প্রলেপ তৈরি করা যেতে পারে।

বাঙালি এখন গৃহ নির্মাণে অনেক বেশি আগ্রহী ও সচেতন। স্থাপত্যের দু’টি দিক রয়েছে। এক- ব্যবহারিক দিক, দুই- নান্দনিক দিক। মানুষ রুচি, পছন্দ ও সামর্থ অনুযায়ী গৃহ নির্মাণ করে। বিগত দশ বছর ধরে সবুজ স্থাপত্যের  চর্চা শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য স্থাপত্যের প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন হলেও মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে স্থপতিরা ব্যাপক চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে সমাজ কাঠামোতে ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবুজ স্থাপত্যের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে চেয়েছেন।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হওয়ার কারণে আমাদের দেশে প্রচুর ঘাম হয়। ঘাম শুকানোর জন্য ঘরে আলো বাতাস চলাচলের জন্য জানালা ও ছাদ ব্যবহার করা হয়। গ্রামীণ অবকাঠামোর দিকে তাকালে দেখতে পাব যে, যে সব উপাদান দিয়ে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয় তা সহজলভ্য ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন বাঁশ, কাঠ, খড় ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু শহরের দিকে তাকালে ভিন্ন চিত্র দেখতে পাব। বিন্যাস ও কাঠামোগত ভিন্নতা। নাগরিক জীবনকে কেন্দ্র করে আমাদের সবুজ স্থাপত্য গড়ে উঠলেও স্থাপত্যেও আত্মা ও নিজস্ব পরিচয়ের পৃথক একমাত্র দেশজ ইটের ঢালাও ব্যবহারের পাশাপাশি কংক্রিটের ব্যবহার হচ্ছে। তাপমাত্রার ভিন্নতার জন্য সবুজ স্থাপত্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আমরা জানি যে, সূর্য প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর দিক পরিবর্তন করে।

বেলা ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সূর্যের প্রখরতা বেশি হওয়ায় পশ্চিম পাশে দেয়ালের পুরুত্ব ৫ ইঞ্চির পরিবর্তে ১০ ইঞ্চি দেয়াল অথবা কংক্রিট ব্যবহার করতে পারি যাতে বিকরিত তাপ শোষিত হয়ে ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। এ ছাড়া শোষণ প্রতিরোধক বা সৌন্দর্য বর্ধনে কালার কোড এবং শব্দ নিয়ন্ত্রণ একুসটিক ওয়াল ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া জানালায় তাপের প্রখরতার কথা বিবেচনা করে বহুমাত্রিক প্যানেল বা উলম্ব জানালা ব্যবহার করা যেতে পারে। ছাদ বা রুফ একটি ভবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। ছাদে লেয়ারকৃত উপকরণের বা কালার কোডিং-এর মাধ্যমে তাপ প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

বর্তমানে যে সব সবুজ স্থপতিরা অবদান রাখছেন তাদের মধ্যে কাশেফ মাহবুব চৌধুরী (ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার), মেরিনা তাবাচ্ছুমের (বাইতুর রউফ মসজিদ), রফিক আজমের ( মেঘনা রেসিডেন্স, নিকুঞ্জ, রেইন ফরেস্ট) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাচ্ছুম তাদের কাজের জন্য আগা খান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন যা স্থাপত্যে নোবেল পুরস্কার নামে পরিচিত।

এ সম্পর্কে স্থপতি রফিক আজম বলেন, ‘এমন একদিন আসবে যেদিন বাঙালি তার আবাসস্থল থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত সবুজ স্থাপত্যে নির্মাণ করবে।’ এখন প্রশ্ন হলো- সবুজ স্থাপত্য ব্যয়সাপেক্ষ কিনা? আমরা প্রতিবছর ৪০ শতাংশ কাঁচামাল বাইরে থেকে আমদানি করি। আমরা নিজেদের কাঁচামালগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ কমিয়ে সহজলভ্য করে তুলতে পারি। সংস্কৃতির স্রোতধারায় অন্যতম অঙ্গ স্থাপত্য শিল্প আজ বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। মানুষের জন্য মানুষ, মানুষের জন্যই স্থাপত্য, প্রয়োজনের জন্য স্থাপত্যের প্রয়োজন। পাশ্চাত্য প্রভাব পরিহার করে, দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির লালন পালনে অগ্রসর হতে পারি। সবুজ স্থাপত্য চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবন‐যাপনকে নিরাপদ ও আরামপ্রদ করে তুলতে পারি। সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারি।

লেখক: স্থপতি, স্থাপত্য অধিদপ্তর


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়