ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভারত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন করে কী বার্তা দিতে চাইছে?

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভারত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন করে কী বার্তা দিতে চাইছে?

ভারত সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে দেশটিতে বসবাসরত কথিত বিদেশীদের জন্য ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে দায়ী করা হয়েছে। ভারতের বর্তমান সরকারে থাকা বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহারে আসামে এনআরসি ও ভারতীয় নাগরিকত্ব বিল সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তারা বলেছিল, অবৈধভাবে ভারতে অবস্থান করা বিদেশীদের চিহ্নিত করতেই তারা নাগরিকত্ব বিল সংশোধন করবে। তবে বিদেশী বলতে তারা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশী মুসলমানদের চিহ্নিত করে ভারত থেকে বের করে দেয়ার কথাই বলেছেন। তা এতদিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর গত ১২ ডিসেম্বর স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, অর্থাৎ এটি এখন আইনে পরিণত হয়েছে। আইনের প্রতিবাদে আসাম ও ত্রিপুরা কয়েক দিন ধরেই কার্যত অচল। বিভিন্ন জায়গায় জারি করা হয়েছে কারফিউ, নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এই আইন রাজসভায় পাস হলেও পশ্চিমবঙ্গে কোনভাবেই নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হতে দেয়া হবে না। এ আইন ভারতকে বিভক্ত করে ফেলবে। যতক্ষণ আমরা ক্ষমতায় অছি, এই রাজ্যের একটি মানুষকেও দেশ ছাড়তে দেব না।’

১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে এই সংশোধনের ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে চলে আসা হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। ১২৫-৯৯ ভোটে বিলটি রাজ্যসভায় পাস হয়। ৩১১-৮০ ভোটের ব্যাপক ব্যবধানে লোকসভাতেও বিলটি অনায়াসে পাস হয়। বিজেপি সরকার ২০১৬ সালেও নাগরিকত্ব আইনের এমন একটি সংশোধনী এনেছিল। কিন্তু রাজ্যসভায় তা অনুমোদন করাতে পারেনি। ওই সংশোধনী প্রস্তাবের সাথে এবারের আইনের কিছু পার্থক্য আছে। আগের সংশোধনীতে ‘কাট-অফ-ডেট’ ছিল না। এবার স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অমুসলিম যারা ভারতে ঢুকেছেন তাদের ক্ষেত্রে এই আইনের ব্যবহার হবে। আবার পূর্বতন সংশোধনীতে পুরো দেশ নতুন বিধানের কার্যকারীতার কথা বলা হলেও নতুন আইনে উত্তর পূর্ব ভারতেও কিছু এলাকাকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হয়েছে। বিজেপির প্রাক্তন এক  নেতা টুইট করে লিখেছেন: ‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে দুটি বিষয় কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এক, এই দেশ ভাগ কয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। দুই, গণতন্ত্রে বিভাজন থাকবেই। কেউ যদি সেটা না চান, তাহলে উত্তর কোরিয়া চলে যেতে পারেন।’

এটি আধুনিক গণতন্ত্রের কথা নয়, বরং বিভক্তি ও সংখ্যালঘুদের প্রতি এক ধরনের হুমকি। ১৯৪৭ সালে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়েছিল, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে সেই তত্ত্ব আর নেই, বরং দুর্বল হয়েছে। অথচ বিজেপি সরকার সেই বিষয়টিকেই যেন সামনে নিয়ে এসে অযথা বিভক্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। এই আইন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্যও হুমকিস্বরূপ। তাই জাতিসংঘ বলেছে, মুসলমানদের বাদ দেয়ায় এ আইন মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে। নতুন আইনগত সংশোধনী সবচেয়ে জটিল অবস্থা তৈরি করেছে আসামে। সেখানে যেসব অমুসলমান ইতোমধ্যে এনআরসিতে নাগরিকত্ব হারিয়েছেন, তারা এই আইনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ আগে তারা এনআরসিতে অন্তর্ভূক্ত হতে আবেদন করেছিলেন নিজেদের ভারতীয় নাগরিক দাবি করে। এখন নতুন আইনে সুবিধা পেতে হলে আবেদন করতে হবে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। যা হবে স্পস্টতই প্রতারণামূলক ও স্ববিরোধীমূলক। বিজেপি প্রথমে দাবি করেছিল, আসামে কোটি কোটি বাংলাদেশি মুসলমান অবৈধভাবে অবস্থান করছে। পরে এনআরসির ফলে দেখা যায়, সেখানে তাদের ভাষায় অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় বিশ লাখ, যার মধ্যে বারো লাখই বাঙালি হিন্দু। এই বিশ লাখ মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই এনআরসিতে অন্তর্ভূক্তির জন্য আবেদন করেননি। সেখানে বলা হয়েছিল ২৬ মার্চ, ১৯৭১-এর পূর্ব থেকে যারা ভারতে বসবাস করছেন তার প্রমাণ দেখাতে পারলে এনআরসির অন্তর্ভূক্ত করা হবে। বাদ পড়াদের মধ্যে অনেকেই সেখানে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। এমনকি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আলী আহমদের পরিবার, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের পরিবার ও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সৈনিকও এনআরসিতে অন্তর্ভূক্ত হননি। বিজেপি যাদেরকে বের করে দেয়ার জন্য এনআরসি করেছে এবং যাদের সংখ্যা কোটি বলে দবি করেছে, এনআরসির ফলে দেখা যায়, সেই বাঙালি মুসলমানরা সংখ্যায় মাত্র দুই লাখ। যারা ১৯৪৭ এর আগে থেকেই সেখানে বসবাস করে আসছেন। এমনকি উনিশ শতকের শুরুর দিকে আসামের পতিত জমি চাষাবাদের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে তারা পূর্ববংলা থেকে সেখানে যান। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দুও রয়েছেন। ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। আসামের পাশাপাশি দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লী ও মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং, পাঞ্জাবের অমৃতসর ও গুজরাটের আহমেদাবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। এর মধ্যে দিল্লি ও শিলংয়ে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংষর্ঘ হয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিবঙ্গের মুর্শিদাবাদে রেলস্টেশনে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এই আইনের পরপরই জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ভারত সফর স্থগিত করেছেন।

ভারতের নতুন এই নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশকে এমন বার্তা দিল, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ব্যাপকহারে নিপীড়িত হচ্ছে।  ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ধারাবাহিক চমৎকার সম্পর্কের মাঝে এই নাগরিকত্ব আইন খারাপ প্রতিদানের চিহ্নস্বরূপ। ভারতকে সবাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলেই জানে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানেই হচ্ছে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বিজেপি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল। বিজেপি মানে পুরো ভারত নয়। গোটা ভারতে রয়েছে বহু উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ জনগণ ও রাজনৈতিক দল। কিন্তু এই আইনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হলো কারুর মতামতেরই কোন মূল্য নেই দেশটিতে। বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামকে দেশের মানুষ পছন্দ করে না কেন? স্বাধীনতার সময় তাদের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য। দ্বিতীয়ত, এটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল কখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে অন্য ধর্মের অনুসারীদের গুরুত্ব কমে যায় যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। অথচ সংখ্যালঘু তো পৃথিবীর সব দেশেই আছে, থাকবে।

এই বাস্তবতাকে ভারতের বর্তমান সরকার কীভাবে অস্বীকার করে? ভারত এই আইনের মাধ্যমে বিশ্বকে কী শিক্ষা দিল? অন্যান্য দেশের সংখ্যালঘুদের কী হবে?

পৃথিবী মানুষের জন্য। ভারতে এমন কিছু ঘটেনি, আইন করে অন্য দেশ থেকে যাওয়া মুসলীমদের ভারত ছাড়া করতে হবে। পৃথিবীর সমস্ত দেশ সব মানুষের। কোন নির্দিষ্ট ধর্মের বা বর্ণের মানুষের নয়। মানুষ এগুলো অযথা সৃষ্টি করে গোটা পৃথিবীতে অরাজকতা, অনিয়ম, অমানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করছে। তাহলে সভ্যতা কী? এত গবেষণা, এত চিন্তা, এত মানবিক শিক্ষা, এত বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন- এগুলোর কোনো কিছুরই কি মূল্য নেই?

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়