ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বইমেলার বাঁক পরিবর্তনের গল্প

খান মাহবুব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বইমেলার বাঁক পরিবর্তনের গল্প

ইতিহাসের সত্যপাঠ সঠিকভাব সংরক্ষণ করে পরবর্তী সময়ের জন্য তথ্য-উপাত্তের সংযোগ এক বড় দায়িত্বের বিষয়। যদিও আমাদের জাতীয় জীবনে ইতিহাসের সঠিক চর্চা ও অনুসরণের অপ্রতুলতা রয়েছে। ফলে নিকট ইতিহাসের কোনো বিষয় সম্পর্কে বর্ণনা ও তথ্যে বিভ্রান্তি দেখা যায়- এ আমাদের জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যাকে প্রগাঢ় করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমরা কোনো বিষয়ে সমন্বয় করে সমাধান চাই না, আমরা নিজ নিজ বিশ্বাস, নিজ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করি। এ কারণেই ইতিহাসের ঘটনার বর্ণনায় বেহাল দশা দেখা যায়। পাশাপাশি তথ্যের সংরক্ষণ করার প্রবণতা না থাকায় তথ্য বিভ্রাট দেখা যায় প্রতিনিয়ত। বিবৃত বিষয় থেকে আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাসের পাঠও মুক্ত নয়। এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাঁক পরিবর্তনগুলো সঠিকভাবে সন্নিবেশ করা।

একথা গ্রন্থমেলার সঙ্গে সংযুক্ত অনেকেরই জানা ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে যথার্থ নীতিমালা প্রণয়ন করে বইমেলার আনুষ্ঠানিক ও বিধিবদ্ধ যাত্রার সূত্রপাত ঘটায়। যদিও বইমেলার আঁতুড়ঘর ১৯৭২ সালের ইউনেস্কো ঘোষিত গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষ্যে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক আয়োজিত বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায়। ১৯৮৩ -২০১৩ সাল পর্যন্ত অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই থিতু হয়ে ছিল। ২০১০ সালের পর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মেলাকে সামাল দেয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। ছুটির দিনগুলিতে বাংলা একডেমির পুকুরসংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে (বর্তমান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভবন) প্রচণ্ড ভিড় লেগে থাকত। মানুষের চাপে কখনো কখনো স্টলের নির্মাণ কাঠামো পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ২০১৩ সালে আগুন লেগে ২৪টি স্টল পুড়ে যায়।

২০১৩ সালের স্থান সংকুলানের কথা বিবেচনা করে স্টলের আকার পূর্বের ৮ ফুট বাই ৮ ফুট সাইজ থেকে কমিয়ে ৬ ফুট বাই ৮ ফুট করা হয়। ২০১৩ সালে বইমেলায় ২৯৬৩টি নতুন বই প্রকাশ হয়। বইমেলায় মোট বিক্রি হয়েছিল ১০ কোটি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।

অংশীজনদের দাবি গ্রহণ করে ২০১৪ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলা সম্প্রসারিত হয় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ২০১৪ সালে বর্ধিত পরিসরে বেশ কিছু নতুন বিষয়ের সংযোজন ঘটায় কর্তৃপক্ষ। এ বছর প্রথম শিশু কর্নার আলাদা করে শিশু বিষয়ক প্রকাশনা সংস্থাকে ৩৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৪ সালে বইমেলায় মোট বিক্রি দাঁড়ায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে স্টল ভাড়া পূর্বতন বছর থেকে বেশ খানিকটা বৃদ্ধি ঘটিয়ে একক ইউনিট ৭৩১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৪ সালেই বাংলা একাডেমি পদক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৫ সালে বইমেলাতে চিরায়ত স্টলের পাশাপাশি ১০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়।

২০১৬ সালে এসে বইমেলা পূর্বতন বছরের ২ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গফুটের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৪ লাক্ষ ৭৮ হাজার বর্গফুট করা হয়। এ বছর প্রথম গুচ্ছ পদ্ধতিতে স্টলের বিন্যাস করা হয়। এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলায় প্রবেশের জন্য নতুন গেইট তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি ২৫ জানুয়ারি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা: প্রকাশনার মানোন্নয়ন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। ২০১৬ সালে আরো কিছু নতুন বিষয়ের উপস্থিতি মেলায় দৃশ্যমান হয়- নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ওয়াচ টাওয়ার, হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, বইমেলা উপলক্ষ্যে ই-বুকের প্রকাশ ইত্যাদি।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৪ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হলেও ব্যবস্থাপনার বেশ কিছু সমস্যার যথার্থ সমাধান ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ সালেও হয়নি। তন্মধ্যে মেলার মাঠের ধূলি নিবারণের জন্য ইট বিছিয়ে রাস্তা তৈরি, মেলায় পর্যাপ্ত আলো ও প্রবেশ গেট নির্মাণ, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, গ্রন্থমেলায় বুক প্রমোশনের ঘাটতি ইত্যাদি। ২০১৭ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজনে নতুন কিছু কর্মকাণ্ড লক্ষণীয়। তবে বিভিন্ন সূত্রের দাবি অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনের জন্য এখনও বাংলা একাডেমির পর্যাপ্ত দক্ষ টিম গড়ে ওঠেনি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনার জন্য বাংলা একাডেমির বিভিন্ন দায়িত্ব ন্যস্ত ব্যক্তিবর্গের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য বহির্বিশ্বে বইমেলা পরিদর্শনের আরো অধিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ কথা প্রমাণ সত্য অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিভিন্ন অংশীজন যুক্ত থকলেও নানা কারণে তাদের ভূমিকাও প্রণিধানযোগ্য নয়।

২০১৭ সালে এসে বইমেলায় তথ্য-প্রযুক্তির বেশ কিছু সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে লটারির মাধ্যমে স্টলের বরাদ্দ, মেলায় ওয়াইফাই সুবিধা প্রদান (যদিও এই সুবিধা এখন পর্যন্ত খুব একটা কার্যকর নয়)। ২০১৭ সালে বইমেলাতে প্রকাশিত নতুন বইয়ের প্রদর্শনের জন্য বাংলা একাডেমি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মেলায় আগতদের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা, মাতৃদুগ্ধ সেবা কেন্দ্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

২০১৭ সালে বই বক্রি হয়েছিল ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ‌্যা ৩৬৪৬টি। উল্লেখ‌্য সোহরাওয়ার্দী উদ‌্যানে গ্রন্থমেলা সম্প্রসারিত হওয়ার পর থেকে বইমেলার প্রারম্ভে ২-৩ দিনব‌্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত‌্য সম্মেলনের আয়োজন লক্ষ‌্যণীয়।

২০১৮ সালে বইমেলাতে ২৪টি প‌্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়। পাশাপাশি ইউনিট বাড়ে প্রায় একশটি। ২০১৮ সালের বইমেলার প্রথম দুদিন আন্তর্জাতিক সাহিত‌্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। যুক্তরাজ‌্য, ফ্রান্স, স্পেন, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের ১৫ জন লেখক ও কবি সম্মেলনে অংশ নেয়। ২০১৮ সালের বইমেলার কবিতার বই ১৪৭২টি, গল্পের বই ৭০১টি, উপন্যাস ৬৪৩টি প্রকাশ পায়। বইমেলায় বিক্রি হয় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। বাংলা একডেমির প্রকাশনা বিক্রি হয় ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। বইমেলাতে ব‌্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত উৎকর্ষ সাধনে ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্টল তৈরিতে টিনের ব‌্যবহার, অগ্নিবীমা এবং বইমেলার নিজস্ব অগ্নি নির্বাপক ব‌্যবস্থা সুসংহত করা হয়।

২০১৯ সালে বইমেলার জন্য একটি থিম নির্ধারণ করে ‘বিজয় (৫২-৭১) নব পর্যায়’। জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম)-এর মাধ‌্যমে স্টল শনাক্তের ব‌্যবস্থা করা হয়। অনলাইনে তথ‌্য ফরম জমা নেয়া হয় এবং মেলায় স্টলের ভাড়াও ব‌্যাংক ড্রাফটের পরিবর্তে সরাসরি বাংলা একাডেমির ব‌্যাংক হিসেবে জমা নেয়া হয়। বইমেলার নান্দনিক ডিজাইনের জন‌্য শিল্পী এনামুল করিম নির্ঝর ও শিল্পী সব‌্যসাচী হাজরাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মেলার উদ্বোধনী দিনে ভারত থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ ও মিশরের লেখক ও সাংবাদিক মোহসেন আল আরিশি অংশ নেন। বইমেলার নিরাপত্তায় তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক‌্যামেরা স্থাপন করা হয়।

২০১৯ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ‌্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভকে জলাধারসহ বইমেলার অংশ করা হয়। বাংলা একাডেমির ব‌্যবস্থাপনায় লেখক মঞ্চ স্থাপন করা হয়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমমিতির উদ‌্যোগে বইমেলা কর্তৃপক্ষ দুইদিন বৃদ্ধি করে।

২০২০ সালের বইমেলা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তাঁর জন্মশত বর্ষ উপলক্ষ‌্যে উৎসর্গ করা হয়েছে। এ বারের বইমেলা ঘিরে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের স্বপ্নও অনেক। বইমেলার আয়তন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮ হাজার বর্গফুট। বাংলা একাডেমির নিজস্ব প্রকাশনা ও অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের অধিক গুরুত্ব রয়েছে। এ বছর ১৩ জানুয়ারি লটারির মাধ‌্যমে আগেভাগেই স্টলের জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। টিএসসির সংযোগ স্থলে আগতদের সুবিধার জন‌্য নতুন গেট নির্মাণ করা হয়েছে। বইমেলায় ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৭৩টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের বেশ কিছু উদ‌্যোগ থাকলেও সংশ্লিষ্টদের চাওয়া আরো বেশি। কেননা বইমেলা আরো হৃদয়গ্রাহী করা সম্ভব হলে এই মেলা বাংলা ভাষা ও সাহিত‌্যের দূত হিসেবে বহির্বিশ্বেও কার্যকর হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে নিছক একটি বইমেলা নয়। এই মেলার পরিসর অনেক ব‌্যাপক। বইমেলা ঘিরে আমাদের সাহিত‌্য ও প্রকাশনার পরিতোষণ ঘটে। সংযোগ ঘটে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মধ‌্যে। বইমেলা আমাদের এক সামাজিক পার্বণ। যা কিনা আমাদের বহমান জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

বইমেলায় অংশ নিতে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের লেখক, পাঠক, প্রকাশকরা সমবেত হন। যুক্ত হন পরিযায়ী পাখির মতো বহির্বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষ। এই বইমেলা বাংলা ভাষাতাত্বিক জাগরণের এক ঊর্বর ভূমি। বইমেলা আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার আশ্রয়স্থল। আমরা বইমেলার অংশীদার।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ‌্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়