ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হংকং যেভাবে করোনাভাইরাস রুখে দিলো

খালেদ সাইফুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৩, ১৪ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হংকং যেভাবে করোনাভাইরাস রুখে দিলো

গত বছর ডিসেম্বরের শেষে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রাদুর্ভাব ঘটে নভেল করোনাভাইরাসের। ভাইরাসটি দ্রুত সংক্রমিত হতে থাকে মানুষের মধ্যে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন বিশ্বের ১৩২টি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে চীনে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চীনের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইতালি। দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ১১৩ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ২৫৮ জন সুস্থ হলেও মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৬ জনে। ইরানে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৫১৪ জন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করোনার প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়েছে এবং সর্বশেষ ভারতে দুজন প্রাণ হারিয়েছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। 
বিশ্বব্যাপী এই যখন পরিস্থিতি, তখন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চলছে নানা আয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে ‘মহামারি’ ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতি উত্তরণে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো।

ফ্রান্স, জার্মানিতে সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিকারে প্রায় প্রতিদিনই দিক নির্দেশনা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গণপরিবহন এড়িয়ে চলা, লোকসমাগম থেকে দূরে থাকা, যথাসম্ভব ঘরে অবস্থান করা, হ্যান্ড স্যনিটাইজার কিংবা সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা ইত্যাদি। তবে উন্নত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশগুলো এসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সংক্রমণের হার সেখানে কমছে না।অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নাম। তবে কি এসব ব্যবস্থার কোথাও ফাঁক থেকে যাচ্ছে?

এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে হংকং-এর বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে। হংকং চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক অঞ্চল। চীনের সঙ্গে এর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। তা সত্ত্বেও সেখানে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১২২ জন। জানুয়ারি মাসের ২৩ তারিখে সর্বপ্রথম সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হয়। এরপর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে সেখানে মারা গেছেন মাত্র ৩ জন। হংকং-প্রবাসী এক বাংলাদেশী প্রকৌশলীর বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা সেখানকার করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থার বৃত্তান্ত তুলে ধরেছে। করোনা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করেনি। এটি সম্ভব হয়েছে তাদের দ্রুত পদক্ষেপ এবং জনগণের সচেতনতার কারণে।

হংকং-এর বাসিন্দারা ব্যক্তিগত সচেতনতা মেনে চলতে যথেষ্ট তৎপর। সেখানকার অফিস-আদালতে প্রবেশের পূর্বে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে তবেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিটি ভবনের প্রবেশমুখে নিরাপত্তাকর্মীরা আগন্তুকের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করছে। ভবনগুলোর প্রবেশপথে রয়েছে বিভিন্ন নির্দেশনা। এছাড়াও ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে হংকং কর্তৃপক্ষের আরো একটি উদ্যোগ বেশ কাজে দিয়েছে। হংকং-এর সাথে চীনের যাতায়াত ব্যবস্থা দ্রুত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা হয়ছে। চীনের সঙ্গে ১৪টি সীমান্ত প্রবেশমুখের মধ্যে ১০টি পয়েন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪টি পয়েন্ট দিয়ে যারা প্রবেশ করছে তাদের যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রবেশ করতে হচ্ছে। এরপরও তাদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হচ্ছে।

বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর হংকং। পার্ল নদীর ব-দ্বীপের পূর্বদিকে অবস্থিত হংকং ২৬০টিরও বেশি ব-দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ১১০৪ বর্গ কিমি’র এই অঞ্চলে প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন মানুষের বাস। সে হিসেবে এটি বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি। তারপরও তারা যেভাবে এই ভাইরাস ঠেকিয়েছে তা অন্যদের জন্য শিক্ষনীয় হতে পারে। মনে রাখতে হবে, হংকং ভাইরাস ঠেকাতে যে ব্যবস্থাগুলো নিয়েছে তা প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। তবে এসব প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা শুধু সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছে এমন মনে করা সমীচীন হবে না। হংকং এর জনগণও একে সাধুবাদ জানিয়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে তারা ধর্মঘট করেছে। যেমন চীনের সাথে সকল ধরনের যাতায়াত বন্ধ করার জন্য সেখানকার মেডিকেলসংশ্লিষ্ট পেশাজীবিরা জানুয়ারি মাসের শুরুতে একযোগে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ফলে সরকার সীমান্তের ১০টি প্রবেশপথ দ্রুত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এছাড়াও তারা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার আগে থেকেই মাস্ক ব্যবহার করছে এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে আমরা হংকং-এর জনগণের সচেতনতা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারি।

হংকং-এর মানুষ এই শিক্ষাটা নিয়েছে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সময়। তখন সার্স-এর সংক্রমণে হংকং-এ প্রায় তিনশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাই এবার আগেভাগেই যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে। অফিস-আদালতে কাজের পরিধিও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, পাবলিক লাইব্রেরি, পাবলিক জিমনেশিয়াম সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হংকং-এ প্রবেশ করা প্রত্যেক ব্যক্তিকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন-এ থাকা বাধ্যতামূলক আইন করা হয়েছে। এই আইন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হংকং পুলিশকে। হংকং-এর বাস্তবধর্মী এই পদক্ষেপগুলো সঠিক সময়ে নিতে পারার কারণেই ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীন-এর এত কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও এই ভাইরাস সেখানকার মানুষকে কাবু করতে পারেনি।

যথেষ্ট অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পারার পেছনে বড় কারণ যথাসময়ে প্রস্তুতির অভাব। সরকার এবং জনগণ যথাসময়ে সচেতন না হওয়ার ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

অনেকেই মত দিচ্ছেন উষ্ণ আবহাওয়ায় করোনাভাইরাস বিস্তার করতে পারে না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনেক বিশেষজ্ঞ এ মত নাকচ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে ভাইরাসটি বিস্তারের প্রসঙ্গে অনেকেই আবহাওয়ার কথা বলে তৃপ্তি পাচ্ছেন। কিন্তু উষ্ণ আবহাওয়ায় করোনার বিস্তার কম হয়, এটি এখনো প্রমাণিত নয়। তাই অবকাঠামোগত দিক চিন্তা করে বাংলাদেশকে সময় থাকতেই পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই জরুরি। কিন্তু সচেতনতা বেড়েছে একথা বলা যাচ্ছে না। লোকসমাগম এড়িয়ে চলতে বলা হলেও দেশের স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ করার ব্যাপারে সরকার এখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। মানুষ চলছে তাদের নিজেদের মতো করে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই জনবহুল দেশে একবার এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে রোধ করা অসম্ভব হবে। ক্ষতি হবে প্রাণ এবং অবশ্যই অর্থনীতির।

সুতরাং বাংলাদেশকে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিতে হবে। এজন্য হংকং হতে পারে সঠিক উদাহরণ।


ঢাকা/তারা/নাসিম 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়