ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

করোনা: জানি কিন্তু মানি না

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২০, ২৭ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনা: জানি কিন্তু মানি না

চীনের উহানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর একজনের মাধ্যমে আরেক জনের, আরেক জনের মাধ্যমে আরেক জনের; এভাবে একে একে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে; মহামারি আকার ধারণ করে। দিন দিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। বাংলাদেশেও এ পর্যন্ত ৪৮ জন আক্রান্তের তথ্য জানিয়েছে আইইডিসিআর। এর মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুর খবরও নিশ্চিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

করোনা মোকাবিলায় দিন দিন বাংলাদেশ সরকারকে কঠোর হতে হচ্ছে। প্রথমে বিদেশ থেকে আসাদের স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে থাকার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এই অনুরোধ আমলে না নেওয়ায় গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যেতে থাকে। বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। আরো কঠোর হতে হয় সরকারকে। ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও সেনা মোতায়েন করতে হয়েছে। মার্কেট, গণপরিবহন, লঞ্চ, ট্রেন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন না মানাদের শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে।

এসবই করা হচ্ছে একজন থেকে অন্যজন থেকে দূরে রাখার জন্য। শুরু থেকে প্রতিদিনই আইইডিসিআর প্রেস বিফিংয়ে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে, বিদেশ থেকে আসাদের গণপরিবহন ব্যবহার না করতে, বিদেশ থেকে সবাইকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন করতে বলে আসছে। সেই সাথে বেশ কিছু দিন আগে থেকেই সভা-সমাবেশ, সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিরুৎসাহিত করা হয়।

ভাইরাসটি ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে; তার তিন ফুটের মধ্যে আসলে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেকারণেই শুরু থেকে জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। চীনের সংক্রমণ হওয়ার পর কমবেশি সবাই আমরা এ তথ্য জানি।

জানার পরও আমরা কি করেছি? এখন থেকেই একটু পেছনের দিকে যাই। ২৫ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জামিনে মুক্তি পান। তিনি কারাধীনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাকে যখন বের করা হয়, সেখানে উপস্থিত সাংবাদিক এবং বিএনপি নেতাকর্মীরা কেউই তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখেননি। বরং একজন আরেক জনের চাপে চ্যাপ্টা হয়েছেন।

বিএনপি নেতাদের কথা নয় বাদই দিলাম। তাদের প্রিয় নেত্রীর মুক্তিতে তারা তো আপ্লুত ছিলেন। কিন্তু সাংবাদিকরা? তারা? তারা কি জানেন না, করোনা কীভাবে ছড়ায়? আর যদি জানেনই, তাহলে কেন তারা মানলেন না? তারাই তো প্রতিদিন প্রচার করেন জনসমাগম এড়াতে। করোনা থেকে নিজে ও অন্যকে রক্ষার জন্য দূরত্ব বজায় রাখতে। পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার মাইকিং করা হচ্ছিল। এটাও লাইভ করছিলেন সাংবাদকিরা। কিন্তু দু’একজন সাংবাদিক এত কাছে গিয়ে লাইভ করছিলেন, যে ছয় ইঞ্চিও দূরত্ব ছিল না।

দলীয় নেতা আর সাংবাদিকদের হুমড়ি খেয়ে পড়ার কারণে দীর্ঘ দুই বছর পর জেল থেকে বের হয়ে আবার বন্দি হতে হলো খালেদা জিয়াকে। অর্থাৎ হোম কোয়ারেন্টাইনে যেতে হলো।

আরেকটু আগে যাই। গত ২৩ মার্চ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম অনলাইন লাইভ ব্রিফিং করেন আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

সেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মাইদু্র রহমান প্রধান ও আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর ছিলেন। তারা তিন ফুট দূরত্ব মানেননি। সাংবাদিকদের ঝুঁকি ও গণজমায়েত এড়াতে অনলাইন লাইভে বিফ্রিং শুরু করা হয়।

এর আগে ২২ মার্চ পর্যন্ত কখনো আইইডিসিআরে, কখনো স্বাস্থ্য ভবনে বিফ্রিং হয়েছে। কখনোই তিন ফুট দূরত্ব মানা হয়নি। চেয়ারগুলো গায়ে গায়ে লাগিয়ে বসানো ছিল। এসব দৃশ্য টিভিতে দেখে সাধারণের অনেকেই বলেছেন, তারা গণজমায়েত এড়াতে বলছেন; অথচ তারাই গণজমায়েত করছেন।

২১ মার্চ স্বাস্থ্য ভবনের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে করোনা নিয়ে জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। সেখানেই দূরত্ব বজায় রাখা হয়নি। পরে মন্ত্রী প্রেস বিফিং করেন। তখন মন্ত্রীর পেছনে অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসময় সাংবাদিকরা মন্ত্রীর পেছনে এত লোক ও এমন জনসমাগম করা নিয়ে প্রশ্ন করলে, তিনি উত্তর দিতে পারেননি। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই তা ফলো করেননি।

ইতোমধ্যে দেশের প্রথম শ্রেণির সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দপ্তরের এক কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা কাছে পেলে কাউকে ছাড়ে না- কী ডাক্তার, আর কী সরকারি কর্মকর্তা।

প্রেস ক্লাবও বন্ধ হলো সেদিন, ২১ মার্চ। তার আগে প্রতিদিনই সেখানে একাধিক সভায় অসংখ্য মানুষ অংশ নিতেন। করোনা সম্পর্কে সচেতন করতে গিয়ে আমরা অসেচতনতার মতো কাজ করতে পারি না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রচার প্রচারণা চালিয়েছে, লিফলেট বিতরণ করেছে। লোক সমাগম করে সচেতনতার এসব অনুষ্ঠান করা হয়েছে। যা করোনা ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট।

এবার আসি আমার কথায়। আমি নিজেও এসব জানি, যে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব জেনে-বোঝেও আমি কিছুই মানিনি। আসলে আমরা জানি, কিন্তু মানিনি। খালেদা জিয়ার মুক্তির দিনে ওই হুড়োহুড়ির ভেতরে থাকাদের একজন আমি নিজে। প্রতিদিনই গিয়েছি আইইডিসিআর প্রেস বিফিংয়ে। বসেছি কারো না কারো গা ঘেঁষে। যাওয়ার সময় গণপরিবহনেই গিয়েছি।

জাতীয় কমিটির বৈঠকের পর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সেই বিফ্রিংয়ে আমিও ছিলাম। যেখানে ছিলাম, আমার থেকে অন্যদের কোনো দূরত্বই ছিল না, গায়ে গায়ে লেগেই ছিলাম। প্রেস ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছি।

করোনা থেকে নিজের রক্ষার জন্য যেসব নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে, তার কোনোটাই আমি মানিনি। তবে, সবাই যে মানেনি তা নয়, সবাই যে করোনাকে গুরুত্ব দেয়নি, তা নয়। কিছু সংখ্যক লোক গুরুত্ব দিয়েছে, কিছু লোক গুরুত্ব দেয়নি। এই কিছুর মধ্যে বেশির ভাগই গুরুত্ব দেননি। আর স্বাস্থ্য বিভাগের অন্য বিষয়গুলো না হয় নাই বললাম। শুরু থেকেই যদি আমরা অধিকতর সতর্ক হতে পারতাম, তাহলে হয়তো অনেকটা ঝুঁকি কম হতো।

অনেকেই ফেসবুকে লিখেছেন- যাদের টয়লেটের পর হাত ধোয়া শেখাতে মিনা কার্টুন দেখিয়ে এক যুগের বেশি সময় লেগেছে। তারা কি বললেই কোয়ারেন্টাইন করবে? তারা কি বলার সাথে সাথে সব নিয়ম মেনে চলবে? আরো আগেই আরো কঠোর হওয়া দরকার ছিল। যারা গুরুত্ব দিয়েছেন, তারা না পারেন তো বাসার বাইরে যাননি। নিয়ম কানুন মেনে চলেছেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে- সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পরে আমরা দেখেছি, রেল, বাস, লঞ্চ টার্মিনালে উপচে পড়া ভিড়। সবাই বাড়ি ছুটছেন। কেন যাচ্ছেন? করোনা থেকে রক্ষা পেতে। কিন্তু কী করলেন তারা! এত বড় ভুল! এই ভিড়ই হয়তো বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই ভিড়ের মধ্যে থাকা কেউ আক্রান্ত থাকলে অনেকেরই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের কী করা উচিৎ ছিল? আমাদের উচিৎ ছিল, যে যেখানেই আছি সেখানেই অবস্থান করা। ভিড় না বাড়ানো।

আমার অফিসের সিদ্ধান্ত ২৫ মার্চ থেকে সবাই বাসায় বসে কাজ করবে। কিন্তু আমি কি করেছি? ২৫ মার্চও খালেদা জিয়ার নিউজ কাভার করতে গিয়েছি। তারপর দিন ২৬ মার্চ থেকে বাসায় আছি। বাসায় বসে কাজ করছি। স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে আছি বলা যায়।

কিন্তু আমার এখন এই কোয়ারেন্টাইন দিয়ে কী হবে। যদি কোনোভাবে কারো মাধ্যমে ভাইরাস আমার মধ্যে এসে থাকে, তাহলে তো আমার পরিবারের অন্যরাও আক্রান্ত হবে। মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা সময়ের কাজ সময়ে করি না। কাজটা করি, তবে তা অনেক পরে। এত পরে করি যে, তখন আর সময় থাকে না। আমরা চাইলে আরো আগে অনেক দেশের সাথে ফ্লাইট, সীমান্ত বন্ধ করতে পারতাম। কিন্তু তাও অনেক দেরিতেই করলাম। এই দেরিই যেন কাল না হয়।


ঢাকা/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়