ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

করোনা ঠেকাতে কানাডা কী করেছে, আমরা কী করছি

ফজলে আজিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ৫ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনা ঠেকাতে কানাডা কী করেছে, আমরা কী করছি

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছাড়িয়ে পড়েছে। নাস্তানাবুদ বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইটালি, ফ্রান্স কিংবা স্পেনে প্রতিদিন কী ঘটছে তাও কমবেশি সবার জানা। পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনের খবরে মুহূর্তেই ভেসে আসছে রাষ্ট্র নায়কদের অসহায়ত্বের কথা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প বলেছেন, তারা আর কানাডায় এন-৯৫ মাস্ক রপ্তানি করবেন না। নিজেরাই এখন নিজেদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

বর্তমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে,  মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে মৃত্যু পথযাত্রীর সংখ্যা। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো ধনী ও উন্নত দেশগুলো কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছে না করোনাভাইরাসের বিস্তার। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ কানাডার চিত্র পুরো উল্টো। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দূরদর্শী সিদ্ধান্তে এখন পর্যন্ত কানাডায় করোনার বিস্তার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। যে হারে করোনার বিস্তার হওয়ার ধারণা করেছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সে ধারণা পাল্টে গেছে। সাধারণ মানুষের সচেতনতা আর সরকারের নানা উদ্যোগে একাত্মতায় এ দেশের মানুষ এখন অনেকটাই স্বস্তিতে আছেন। আতঙ্ক নয়, সচেতনতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কানাডার সচেতন নাগরিক ও অভিবাসীরা।

বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রেস্টুরেন্ট
কানাডার অন্যতম পর্যটন নগরী ভ্যানকুভারে এ সময় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান মুভি কিংবা সিরিয়ালের শুটিং হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে সবই আজ শূন্য। প্রকৃতি বসন্তের অপরূপ সাজে সাজলেও কেউ অপ্রয়োজনে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। অথচ বছরের এ সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকেন ভ্যানকুভারের মানুষ। ব্রিটিশ কলম্বিয়াজুড়ে বাস ভাড়া ফ্রি করে দিয়েছেন বাস মালিকরা। যাতে কম আয়ের মানুষও স্বচ্ছন্দে প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করতে পারেন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাস ছেড়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। অথচ বাসে কোনো যাত্রী নেই। করোনার বিস্তার ঠেকাতে বাসে আসন সীমিত করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে কেবল খোলা আছে সুপার স্টোর, গ্রোসারি শপ, ওষুধের দোকান আর কিছু রেস্টুরেন্ট। সরকারি নিয়ম মেনে সবগুলো রেস্টুরেন্ট টেবিলে খাবার পরিবেশন বন্ধ করে দিয়েছে। যাতে রোগের বিস্তার রোধ করা যায়। অথচ বাংলাদেশের অনেক এলাকার  চায়ের দোকানে এখন ঈদের আনন্দ বইছে। জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন অনেকেই। আমরা সচেতন হবো কবে?

বেড়ে গেছে দূরত্ব
কানাডার মানুষ আরেকটা বিষয় খুবই সতর্কতার সঙ্গে মেনে চলেন।  শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক সবাই ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। নিজের নিরাপত্তার পাশাপাশি অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবাই সচেতন। সাময়িক এ দূরত্ব তাদের রক্ষা করছে বড় কোনো বিপদ থেকে। যে কারণে রাস্তায় পুলিশ নামিয়ে তাদের সচেতন করার প্রয়োজন পড়েনি। এমনকি কেউ এখন আর দলবেঁধে পার্ক কিংবা সমুদ্রপাড়ে হাওয়া খেতে বের হন না। যদিও এ বিষয়ে সচেতন করতে কিছুদিন সরকারিভাবে জোর প্রচারণা চালানো হয়েছিলো। আর মানুষও তাতে সাড়া দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশের চিত্রটা সবারই জানা। শুনেছি কোনো একটি এলাকায় সেনাবাহিনী নেমেছে, কথাটি শোনার পর কিছু লোকের বিশ্বাস হয় নি। তাই তারা রাস্তায় নেমে বিষয়টির সত্যতা জানার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ রাস্তায় বের হয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ও দিচ্ছেন। সেরকম একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।

অন্যরকম ইয়েল টাউন
কানাডার একজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতে খুব বেশি সময় লাগে না। আপনি যদি কানাডার হকি টিম নিয়ে আগ্রহ দেখান কিংবা কথা শুরু করেন তখন তারা সময়জ্ঞান ভুলে আপনার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া শুরু করবে।  কনকনে ঠাণ্ডায় যখন তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রিরও কম তখনও মাঠে গড়ায় হকি ম্যাচ। আর গ্যালারিভরা দর্শক যেন ৯০ দশকের আবাহনী আর মোহামেডান ক্লাবের ফুটবল ম্যাচের কথা মনে করিয়ে দেয়। স্টেডিয়ামের পাশের এলাকাটির নাম ইয়েল টাউন। কিছুদিন আগেও বিকেলের পর থেকে ইয়েল টাউনে স্টেডিয়ামে দর্শকের গর্জন পুরো এলাকা জমিয়ে রাখতো।  প্রায় প্রতি সপ্তাহে গ্যালারিভরা দর্শক নিয়ে আর রেস্টুরেন্টে বড় পর্দায় খেলা দেখার সে চিত্রটাও এখন বদলে গেছে।

এখন কোলাকুলি করার সময় নয়
কানাডার সংস্কৃতিতে কোলাকুলি করা সাধারণ ব্যাপার। অনেকদিন পর দেখা হলে অনেকেই কোলাকুলি করেন। খুশির খবরেও কোলাকুলি করেন। বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছাড়াও অন্যকে প্রেরণা জোগাতে কিংবা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে কোলাকুলি এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। করোনার বিস্তার রোধ করতে এখন আর কেউ কোলাকুলি করেন না। এমনকি প্রিয় বন্ধুর সঙ্গেও হাত মেলান না। মিষ্টি একটা হাসির বিনিময়ে চলে অভ্যর্থনা আর বিদায় জানানো। এমন অনেক কিছুই বদলে গেছে, যা কেউ ভাবেনি আগে। বাস কিংবা ট্রেনে উঠলেও অনেকেই কোনো কিছুতে হাতের স্পর্শ করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকেন। এমন কি বাসার দরজা, লিফট কিংবা বাইরের কোনো কিছু কেউ স্পর্শ করেন না। যেখানে সেখানে কফ থুথু ফেলা কিংবা রাস্তায় প্রকাশ্যে আড্ডা দেওয়ার মতো নির্বোধ লোক এখানে বলা যেতে পারে একেবারেই নেই।

পরিচ্ছন্নতা সবার আগে
সোশাল ডিসটেন্সিং- কথাটি এখানে জনে জনে সবাই মেনে চলেন। নিরাপদ দূরত্ব মেনে চলার পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার ওপর বাড়তি জোর দেওয়া হচ্ছে। শপিং সেন্টারগুলোতে সারাদিনই ব্লিচ দিয়ে ফ্লোর, শপিং ট্রলিগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। অনেকেই ব্যবহার করছেন হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক। সবজায়গায় একটি কথাই জোর দিয়ে বলা হচ্ছে- বেশি করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন। বাড়ি থেকে কোথাও বের হওয়ার পরে কিংবা কাজ থেকে বাসায় ফেরার পরে। কর্মস্থলে পৌঁছানোর পর কিংবা কোনো কিছু স্পর্শ করার পর। হাত দিয়ে নাখ, মুখ, চোখ, কান চুলকানো যাদের অভ্যাস তাদের মনে করিয়ে দিতে বিভিন্ন ভাষায় বাস ট্রেনে ব্যানার লাগানো হয়েছে। আর যারা শারিরীকভাবে অসুস্থ তারা সচেতনভাবে বাসা থেকে বের হন না। কিছুদিন আগে স্থানীয় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি জানান, আমার জরুরি কিছু জিনিস কেনা দরকার। তারপরও আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি না। এর কারণ, আমি জানি না, আমি এ রোগে আক্রান্ত কি-না। কারণ এ রোগের ভাইরাস শরীরে প্রায় দু’সপ্তাহের মতো সুপ্ত অবস্থায় থাকে। যেহেতু ছোঁয়াচে রোগ তাই আমি চাই না আমার দ্বারা কেউ আক্রান্ত হোক। আর পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সবকিছুর আগে।

দাম বাড়েনি কোনো কিছুর
বিষয়টা কিছুটা অবাক হওয়ার মতোই বটে। এত বড় একটা জাতীয় দুর্যোগের মধ্যেও কোনো কিছুর দাম একটুও বাড়েনি। বরং কমেছে চাল, মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। কারণ এখানকার মানুষের ব্যবসায়ের লক্ষ্য অর্থ উপার্জন হলেও সেবা দেওয়াকে তারা অগ্রাধিকার দেন সবার আগে।
লেখক: জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ, ভ্যানকুভার, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়