ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পিতার পথই অনুসরণ করে গেলেন মোহাম্মদ নাসিম

স্বদেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১৪ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
পিতার পথই অনুসরণ করে গেলেন মোহাম্মদ নাসিম

১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্টের পর পুলিশ প্রহরায় বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাপ্টেন মুনসুর আলীকে। খুনী মোশতাক তখন তথাকথিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে, ক্যাপ্টেন মুনসুর আলীকে তার সরকারে যোগ দিতে বললে অনেকটা গর্জে ওঠেন মুনসুর আলী। বলেন, দেখুন মোশতাক সাহেব, আমি হয় সম্মানের সঙ্গে বাঁচব, না হয় সম্মানের সঙ্গে মারা যাব। আর বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে কোনো আপোস আমার নেই। ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী সম্মানের সঙ্গে মারা যান। যে সম্মান এ জাতিতে মাত্র চারজনই পান। জাতীয় চার নেতার মৃত্যু দিবস প্রতি বছর পালন করে জাতি তাদের সম্মান জানায়। প্রজম্মের পর প্রজম্ম এ জাতির সন্তানরা জানবে এই মানুষেরা সম্মানের সঙ্গে মারা গিয়েছিলেন। আরো জানবে তারা একটি জাতির স্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেঈমানী করেননি।

মোহাম্মদ নাসিমও পিতার মতো আজম্ম একটি সত্য পালন করে গেলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করেননি। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে রাজনীতির অনেক টানাপড়েন গেছে। অনেক টানাপড়েনের অনেক নেপথ্য বিষয়ের আমরা কমবেশি সাক্ষী। এই আমরা কখনও একটি বিষয় দেখেনি যে, মোহাম্মদ নাসিম বঙ্গবন্ধুর রক্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে এক তিল বেঈমানী তো দূরে থাকুক, তার থেকে এক তিল এদিক-ওদিক গেছেন। মাথার ওপর শেখ হাসিনা, তারপরে মোহাম্মদ নাসিমের নিজের রাজনীতি। যখনই দলে কোনো গ্রুপিং হয়েছে, দল ভাঙ্গার চেষ্টা হয়েছে, তখনই মোহাম্মদ নাসিম শেখ হাসিনার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন।

শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হন তখন আওয়ামী লীগ ছিলো তিনভাগে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ (হাসিনা) আওয়ামী লীগ (মিজান) ও আওয়ামী লীগ ( গাজী)। মিজান অর্থাৎ মিজানুর রহমান চৌধুরী, গাজী অর্থাৎ দেওয়ান ফরিদ গাজী। ১৯৮৩ সালে দেওয়ান ফরিদ গাজী আবার শেখ হাসিনার সঙ্গে ফিরে আসেন। মিজান চৌধুরী এরশাদের সঙ্গে চলে যান। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ একটাই থাকে। কিন্তু ১৯৮৪ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আব্দুর রাজ্জাক আবার আওয়ামী লীগ ভাঙেন। এ সময়ে আব্দুর রাজ্জাক শুধু আওয়ামী লীগকে ভাঙেননি। তিনি ১৯৭৫ এরপর যুবলীগের যে নেতৃত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছিলো তাদের একটি বড় অংশকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। মোহাম্মদ নাসিমও ১৯৭৫ এর আগে যুবলীগেরই নেতা। ১৯৭৩ সালে তিনি যুবলীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ছিলেন। তাই যুবলীগের এই নেতারা অনেকেই ছিলেন তার সহকর্মী, বন্ধু এবং বড় ভাই। সম্ভবত মোহাম্মদ নাসিম যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর কনিষ্ঠ সদস্যদের একজন ছিলেন। ১৯৭৩ এর যুব লীগের সেক্রেটারিয়েটে এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের অনেকেই মোহাম্মদ নাসিমের সিনিয়র ছিলেন।

যাহোক, তারপরেও ১৯৮৪ সালে আব্দুর রাজ্জাক যখন আওয়ামী লীগ ভাঙেন; এই সময়ে মোহাম্মদ নাসিমকে দেখেছি তার যুবলীগের বন্ধুদের বাসায় বাসায় গিয়ে অনুরোধ করতে তারা যেন শেখ হাসিনাকে ছেড়ে না যান। কারণ শেখ হাসিনাকে ছেড়ে যাওয়া শুধু রাজনৈতিকভাবে ভুল হবে না, দেশের জন্যও একটি বড় ক্ষতি হবে।  এতে দেশের গণতন্ত্র ও সিভিল শাসন পুনরুদ্ধার পিছিয়ে যাবে। সেদিন আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে যারা চলে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেই আব্দুর রাজ্জাকের ফিরে আসার আগে ফিরে এসেছিলেন। তাদের অনেকের এই ফিরে আসার পেছনে মোহাম্মদ নাসিমের একটি ভূমিকা ছিলো।

এরপরে আরো দুবার আওয়ামী লীগ ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। একবার চেষ্টা করেছেন ড. কামাল হোসেন। অন্যবার কাদের সিদ্দিকী। কাদের সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে ঠিক আওয়ামী লীগ ভাঙার চেষ্টা বলা যায়  না। তারটা ছিলো একটা পাগলামী। তার বড় ভাই প্রবীন এবং জ্ঞানী আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছে যেদিন নতুন দল করার প্রস্তাব নিয়ে কাদের সিদ্দিকী যান সেদিন সেখানে আমি ঘটনাক্রমে উপস্থিত ছিলাম। লতিফ সিদ্দিকী সেদিন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো বলে দিয়েছিলেন- তোমার এ পথ ভুল। তুমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কাদের সিদ্দিকী তাকে পাল্টা বলেছিলেন, লতিফ সিদ্দিকী তার সঙ্গে যাবেন কিনা? লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, দেখ আমি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বাইরে কোনো রাজনীতি করবো না। যদি কখনও আমার জন্যে খারাপ দিন আসে আমি ঘরে বসে থাকবো, তবু শেখ হাসিনার বাইরে যাব না। লতিফ সিদ্দিকীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অপরিসীম। এবং কাদের সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে তা শতভাগ সত্য হয়েছে। তবে কাদের সিদ্দিকীর কথা এখানে বলছি এ কারণে, কাদের সিদ্দিকীর উদ্দেশ্য ছিলো জাতীয় চার নেতার পরিবার থেকে কাউকে টানতে পারেন কিনা চেষ্টা করা। কিন্তু পারেননি।

কাদের সিদ্দিকীর আগে ড. কামাল হোসেন যখন আওয়ামী লীগ ভাঙেন এই সময়ে ড. কামাল হোসেনও দিনের পর দিন চেষ্টা করেছেন জাতীয় চার নেতার পরিবারের কাউকে নিতে পারেন কিনা। ড. কামাল হোসেনও ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৯৯১ এর নির্বাচনের পরে ড. কামাল হোসেন তখন দলের ভেতর যৌথ নেতৃত্বের দাবি তুলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার একটি গোপন ষড়যন্ত্র করছেন, এই সময়ে একদিন দুপুরের দিকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এর আওয়ামী লীগ অফিসে পাই মোহাম্মদ নাসিমকে। তার পাশে আরো দু’একজন ছিলেন। আমি তাকে আলাদা কিছু একটা বলতে চাই সেটা তিনি আমার চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারেন। তিনি তাদেরকে চলে যেতে বলেন। তারা চলে গেলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, ড. কামাল হোসেন কী করছেন? তিনি আমাকে বললেন, দেখুন আপনার সঙ্গে কোনো রাখঢাক করে কথা বলবো না। কারণ, আপনি আমার ক্ষতি হয় এমন কোনো সাংবাদিকতা করবেন না। বলে তিনি বলেন, কামাল হোসেনের চেষ্টা দলের ভেতর শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। কিন্তু তিনি ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছেন, এটা তার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই তিনি এখন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি ‘দোকান’ খুলবেন। রাজনৈতিক দলের নামে এই তথাকথিত দল করাকে ‘দোকান’ হিসেবে প্রথমে চিহ্নিত করেন সাংবাদিক ও রাজনীতিক শফিকুল আজিজ মুকুল ভাই। মোহাম্মদ নাসিম আমাদের অনেকের মতো মুকুল ভাইকে শ্রদ্ধা করতেন। অনেক সময় কাটাতেন তার সঙ্গে। তাই আমরা উভয়ে এই দোকান শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম তখন।

আমি ওই সময়ে তাকে বলি, এই দোকান খোলার জন্যে ড. কামাল হোসেন মুকুল ভাইকে তার গাড়িতে নিয়ে প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা লং ড্রাইভে ছিলেন। দূর দিয়ে দিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তার লাইন বিটুইনে মুকুল ভাই বুঝতে পেরেছেন, ড. কামাল দল ভাঙতে চান এবং তিনি যুব নেতাদের তার পাশে চান। কিন্তু মুকুল ভাই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিবারই প্রসঙ্গ পাল্টে গেছেন। মোহাম্মদ নাসিম ততক্ষণে বুঝতে পারেন, আমি মূলত তার কাছে গিয়েছি, ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে তার কোনো কথা হয়েছে কিনা এটা জানার জন্যে। তাই তিনি হেসে বলেন, ড.কামাল হোসেনের ওই সাহস নেই যে শেখ হাসিনার দল ভাঙবেন আর সেই কথা মোহাম্মদ নাসিমকে বলবেন। আমি ততক্ষণে সাংবাদিক হিসেবে আমার তথ্য আরো কনফার্ম করে ফেলি যে, ড. কামাল হোসেন দল ভাঙছেন। কারণ, এর আগে যাদের সঙ্গে ড.কামাল হোসেন আলোচনা করেছেন এমন তিন-চার জনের কাছ থেকে জেনেছি, বেশ কিছু ডকুমেন্টসও হাতে চলে এসেছিলো। যাক সে কথা। বাস্তবে এই ছিলেন মোহম্মদ নাসিম। অর্থাৎ যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন তারা কেউই মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে ওই বিষয়ে কথা বলতে সাহস পাবেন না।

১/১১ এর পরে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার চেষ্টায় সেদিন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে পাওয়া গেলেও মোহাম্মদ নাসিমকে পাওয়া যায়নি। বরং সেদিন তাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিলো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলানোর জন্যে। যে নির্যাতন সহ্য করতে গিয়েই মোহাম্মদ নাসিমের ব্রেইন স্ট্রোক হয় সেদিন। পরবর্তী জীবনটুকু তিনি সেই অসুস্থতা নিয়েই কাটিয়ে যান। এবং দ্বিতীয়বার সেই স্ট্রোক করেই মারা গেলেন। মোহাম্মদ নাসিমের প্রথম স্ট্রোকটা যদি ওই নির্যাতনের কারণে না হতো, তাহলে এবার হয়তো করোনার ভেতর তার স্ট্রোক হতো না। তিনি মারা যেতেন না। তবুও প্রথমের ওই স্ট্রোক ও পরবর্তী জীবনের অসুস্থতা বয়ে চলে মোহাম্মদ নাসিম প্রমাণ করে গেছেন তিনিও তার পিতার পথ অনুসারী। তারা পিতা জীবন দিয়ে গেছেন তবু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেঈমানী করেননি। মোহাম্মদ নাসিমও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছেন তবুও শেখ হাসিনার সঙ্গে বেঈমানী  করেননি।

আজ তার মৃত্যুর আগে ও পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, এ সময়ে মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকলে অনেক ভালো করতেন। তিনি জনমানুষের নেতা ছিলেন। তাই মানুষের কষ্ট বুঝতেন, মানুষের কথা শুনতেন, সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য জানতেন- সর্বোপরি ডাক্তারদের অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন তিনি। কারণ, জীবনের এই প্রান্তে এসে অন্তত এই সত্যটুকু বুঝতে শিখেছি যে, শেষ অবধি রাজনীতিবিদরাই নেতৃত্বটা সঠিকভাবে দিতে পারেন যে কোনো ক্রাইসিসে। সে গুণ মোহাম্মদ নাসিমের ছিলো।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়