চলে গেলেন প্রকাশকদের অভিভাবক মহিউদ্দিন আহমেদ
প্রয়াণলগ্নেই পরিচিতজনেরা স্মৃতিকাতরতায় সদ্যপ্রয়াত ব্যক্তির জীবন ও কর্ম স্মরণ করেন। আজ বর্ষার এই বিরামহীন বর্ষণে প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদের (১৯৪৪-২০২১) জীবনস্মৃতির খণ্ড স্মৃতি এবং কিছু তথ্য উঁকি দিচ্ছে মনে। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগে গত ২২ জুন রাতে প্রবল বর্ষণে ধরণী যখন শান্ত এবং শীতল- সেই সময় চিরঘুমের দেশে পাড়ি জমান মহিউদ্দিন আহমেদ।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউপিএল-এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে, প্রকাশক হিসেবে মহিউদ্দিন আহমেদের পরিচিতির বাইরেও নানা আঙ্গীকে আলো ছড়িয়ে তিনি মহীরুহ। প্রকাশনাকে ব্যবসা হিসেবে নয়, সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষ হিসেবে তিনি কর্মসাধন করে তস্যদের জন্য অনুকরণীয় হয়েছেন। প্রকাশনা ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও পেশা হিসেবে প্রকাশনাকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে বাংলাদেশের তার কর্ম নিরলস ও প্রণিধানযোগ্য। কোনো পেশায় পারঙ্গমতার শীর্ষে যেতে হলে শুধু কর্মক্ষেত্রে অবিরাম লেগে থাকা ও কর্ষণ নয়, পেশায় প্রবেশের পূর্বে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ভীত মজবুত করা জরুরি। মহিউদ্দিন আহমেদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ভীত ঈর্ষণীয় ছিল। ঢাকার নটরডেম কলেজ, অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ-যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পাঠ সমাপ্ত করে পাকিস্তান কাউন্সিলের স্কলারশিপ বৃত্তি নিয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। পাঠ সমাপ্তে অল্পদিন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। অতঃপর তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাকিস্তান শাখার সম্পাদক হিসেবে যুক্ত করেন নিজেকে। প্রকাশনা কাজে যুক্ত হয়েই তিনি অপার আগ্রহে এই সেক্টরে তার স্বপ্নের বীজ বুনতে শুরু করেন।
২০০৮ কিংবা ২০১০ সালে বাংলাদেশ-ভারত উৎসবের সমন্বয়ক হিসেবে মহিউদ্দিন ভাইকে প্রকাশনা সেশনে বক্তব্য দিতে অতিথি করে টাঙ্গাইল নিয়ে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ আলাপ ও দীর্ঘসময় একসঙ্গে যাপনে তিনি তরুণ বয়সে তাঁর স্বপ্নকল্পের খানিকটা শুনিয়েছিলেন। গভীর পর্যবেক্ষণ ও ধী-শক্তির অধিকারী মহিউদ্দিন আহমেদ গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে অনুধাবন করেছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রকাশনার ভূত-ভবিষ্যৎ। প্রকাশনা চিন্তার বহুমুখিকরণ, প্রযুক্তির সংশ্লেষ, পেশাদারিত্ব ও বৈশ্বিক ভাবনার গুরুত্ব ও পরিকল্পনা ছিল তাঁর ভেতর।
প্রাগ্রসর ও গোছালো মানুষ ছিলেন তিনি, যে কারণে দেশ স্বাধীন হলে প্রথমে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালনের পর গড়ে তোলেন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। শুরু থেকেই অব্যাহতভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপে। ইউপিএল বাংলাদেশের পাঠ্যবই ও রেফারেন্স বইয়ের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। বই বিপণন এবং পাঠক প্রণোদনা কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানটি অনুকরণীয়। বাংলাদেশ থেকে বই রপ্তানির বড় অংশীজন ইউপিএল।
মহিউদ্দিন আহমেদ নিজে এবং প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করে সার্বিক প্রকাশনার উন্নয়নে তৎপর ছিলেন। গ্রন্থোন্নয়ন সংক্রান্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স এসোসিয়েশন’ আয়োজিত ওয়ার্ল্ড বুক কংগ্রেসসহ বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব স্কলারলি
পাবলিশার্স ও আফ্রো-এশিয়ান বুক কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
প্রকাশকদের পেশাগত আন্দোলনে তিনি অগ্রণী। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি গঠনে তার প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সভাপতি ছিলেন। সৃজনশীল প্রকাশকদের সংগঠন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কর্ম হিসেবে মহিউদ্দিন আহমেদ প্রকাশনা বিষয়ক লেখালেখিতে যক্ত ছিলেন। তাঁর নিবন্ধ ‘আফ্রো-এশিয়ান পাবলিশিং– কনটেম্পোটারি ট্রেন্ডস ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমেদের দু’টি গ্রন্থ রয়েছে- মুদ্রণ শিল্প (বাংলা একাডেমি, ১৯৮৬) এবং ও বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশনা (ইউপিএল, ১৯৯৩)।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮১ সাল থেকে মোট ১৬ বার তাঁর প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রবর্তিত পুরস্কার অর্জন করেছে। তিনি নিজে ১৯৯১ সালে প্রকাশক হিসেবে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। অ্যারিজোনার বেনসনে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ১৯৮৮ সালে মহিউদ্দিন আহমেদকে সম্মানসূচক পাবলিশিং ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে কালচারাল ডক্টোরেট ডিগ্রি প্রদান করেন। ২০১৪ সালে প্রকাশকদের দ্বারা তিনি ভূষিত হন ইমেরিটাস প্রকাশকদের সম্মানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ খোলার বিষয়ে আমাদের তিনি সবসময় উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়েছেন। একাধিকবার তিনি আগ্রহ নিয়ে আমার সঙ্গে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলেছেন, মিটিং করেছেন। প্রকাশনা সেক্টর খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার একজন চিন্তক ছিলেন তিনি। সব সময় প্রকাশনার উন্নয়নে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছুরি-কাঁচি চালিয়েছেন উৎকর্ষ সাধনে। নিজ প্রতিষ্ঠান ইউপিএলসহ সামগ্রিক সেক্টরের উন্নয়নে তাঁর চিন্তার ক্যানভাস সব সময়ই প্রশস্ত ছিল। প্রকাশনার উন্নয়নে তিনি আমাদের আশার বাতিঘর।
বাংলা প্রকাশনা জগতের এই মহীরূহ পুস্তক প্রকাশনা গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনার জগত তার প্রচুর সমস্যা ও বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার বিশ্বাস এই যে, আমরা উদ্যোগী হলে আমরা কোন একদিকে সমস্যাগুলোকে কমিয়ে আনতে পারি তেমনি সম্ভাবনার দিগন্তকে উম্মোচন করতে পারি। জাতীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু নীতিমালা সরকারী ও বেসরকারী খাতের মধ্যে সমন্বয় এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে আমাদের দেশের পুস্তক প্রকাশনা জগতের দ্রুত রাহুমুক্তি ঘটবে এবং একইসঙ্গে এই খাতটি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সামর্থ্যও অর্জন করবে।’
এ রকম অভিভাবক আমরা আর কোথায় পাবো? বাংলাদেশের ইংরেজি বই প্রকাশনায়ও ইউপিএল এক বিশ্বস্ত নাম। এই নামের আদলে শুধু ইউপিএল নয় মহিউদ্দিন আহমেদও একটি প্রতিষ্ঠান। এমন মানুষের প্রয়াণ প্রকাশনার সামগ্রিক অগ্রগতি স্লথ করবে। প্রকাশনা ক্ষেত্রে সংযুক্তদের সম্মিলিত সংহতি ও সামষ্টিক উদ্যোগের মাধ্যমে এখন প্রয়োজন মহিউদ্দিন আহমেদের পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের সামনে তিনি অনাগত দিনেও বাতিঘর হয়ে থাকবেন।
লেখক: প্রকাশক ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা/তারা