ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিএনপির সঙ্গে দর কষাকষিতে জামায়াত?

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৬, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিএনপির সঙ্গে দর কষাকষিতে জামায়াত?

এস কে রেজা পারভেজ : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে মাঠে থাকায় অস্বস্তিতে পড়েছে বিএনপিসহ জোটের অন্য শরিকরা।

প্রশ্ন উঠছে, মাঠে প্রার্থী রেখে জোটের প্রধান মিত্র বিএনপিকে কি বার্তা দিতে চাইছে দলটি? যদিও জোটের অন্য শরিক নেতারা বিষয়টিকে বড় করে দেখতে চাইছেন না। তারা বলছেন, শেষ মুহূর্তে জোটের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেবে জামায়াত। তবে সূত্র বলছে ভিন্নকথা, রাজনীতির মাঠে দর কষাকষিকে সামনে রেখেই জামায়াতের এই ‘রূপ’  দেখা যাচ্ছে।

দলের নিবন্ধন বাতিল থাকলেও স্বতন্ত্রভাবে ডিএনসিসিতে নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন থেকে মনোনয়ন নিয়েছেন জামায়াতের ঢাকা উত্তরের আমির ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন। জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বৈঠকের আগে জামায়াতের এই ধরনের কর্মকাণ্ডে প্রশ্নের মুখে পড়েছে দলটি।

সূত্র বলছে, ‘জোটে জামায়াতের প্রতি বিএনপির ‘উপেক্ষা’ এই ধরনের আগ্রাসী সিদ্ধান্ত নিতে দলটিকে উৎসাহ যুগিয়েছে। জামায়াত হয়তো শেষ পর্যন্ত ডিএনসিসিতে মেয়র প্রার্থীতা থেকে সরে আসবে। তবে এর আগে বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়ায় যেতে চাইছে দলটি। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে প্রার্থী দিলেও জামায়াত বা জোটের অন্য কোনো দলকে জানায়নি। এ নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দুরত্ব তৈরি হয়। এর জের ধরে জামায়াতের ভেতরেও সৃষ্টি হয় ক্ষোভ। বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেনি জামায়াতের দায়িত্বশীলরা। তাই একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বিএনপির সঙ্গে হিসাব-নিকাশে বসতে চাইছে দলটি।

জোটের অপর একটি সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরে জোটের সঙ্গে জামায়াতের সখ্যে ভাটা পড়েছে। সরকারের সঙ্গে জামায়াতের দুরত্ব কমছে এমন খবরও রটে জোটের অভ্যন্তরে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে জোটের বৈঠকেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামায়াতকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের ফাঁদে পা না দিতে দলটির প্রতিনিধিকে বলেছেন তিনি। বিএনপি ও জোটের বিভিন্ন নেতাও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করে আসছেন, জোট ভাঙতে জামায়াতকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে সরকার। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই ধরনের অভিযোগ সবসময়ই উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিএনপি, জামায়াত ও জোটের সূত্রগুলো বলছে, ডিএনসিসিতে জামায়াতের প্রার্থী দেওয়ার উদ্দেশ্য আগামী অন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা। জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে, দলটি চায় আসন্ন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হিসেবে জামায়াতের প্রার্থীকে সমর্থন করুক বিএনপি। সিলেটে জামায়াতের সাংগঠনিক ভালো অবস্থান দলটিকে সাহস যোগাচ্ছে। এছাড়া সিটি নির্বাচনগুলোতে কাউন্সিলর পদেও ভাগ চায় জামায়াত। তারা চায় ডিএনসিসিতে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ছাড় দিক বিএনপি। তবে ডিএনসিসি মেয়র পদে জামায়াতের প্রার্থী প্রত্যাহার এবং দলটির সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কাজ করছেন। তবে ওই যোগাযোগের বিষয়ে এখনও ইতিবাচক কোনো অগ্রগিত হয়নি বলে সূত্রের দাবি। যদিও জোট নেতারা আশা করছেন, শিগগিরই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে এবং জামায়াত মাঠ থেকে প্রার্থী উঠিয়ে নেবে।

জানতে চাইলে বিএনপির জোটের অন্যতম শরিক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির সভাপতি ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জোটের বৈঠকে এ নিয়ে কথা হয়েছে। আশা করি শিগগিরই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার প্রতি শতভাগ সমর্থন জোট নেতাদের আছে।

আশা করি, সঠিক সময়ে জামায়াত প্রার্থী মাঠ থেকে তুলে নেবে। বিশ্বাস করি, দলটি কোনো ফাঁদে পা দেবে না। জোটের ঐক্য অটুট ছিলো, আছে এবং থাকবে। এই জন্য ২০ দলীয় জোট যাকে মনোনয়ন দিয়েছে জামায়াত সেই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানাবে,’ বলেন জোটের এই নেতা।

জোটের আরেক নেতা বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বলেন, ‘২০ দল ঐক্যে বিশ্বাসী। সুতরাং শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে জোটের একক প্রার্থীই মাঠে আছে। এজন্য ধৈর্য ধরতে হবে। এখনও সময় আছে। আশা করছি, জোটের সিদ্ধান্তের ভেতরে থাকবে জামায়াত। সুষ্ঠু ভোট হলে বিপুল ভোটে জোটের প্রার্থীই জয়লাভ করবে।’

তবে অন্য কোনো দলের নেতা ডিএনসিসিতে মেয়র পদে প্রচারণা চালালেও বিএনপির চুড়ান্ত করা প্রার্থী তাবিথ আউয়ালই হচ্ছেন ২০ জোটের প্রার্থী এমনটি দাবি করেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

তিনি বলেন, ‘দল থেকে আমরা তাবিথ আউয়ালকে মনোনয়ন দিয়েছি। এখন নির্বাচন কমিশনে প্রার্থী হিসেবে ফাইল করা, জমা দেওয়া, বাছাই ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হলে তিনিই (তাবিথ আউয়াল) ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হবেন।’

জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মুহাম্মদ সেলিমউদ্দিনের নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, ‘আমি যেটুকু বললাম, নিশ্চয় ভিত্তির ওপর কথাটা বলছি; তাবিথ আউয়ালই ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এবার যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হয়, তাহলে তাবিথ আউয়াল জনগণের বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

২০ দলীয় জোট এবং ঢাকা উত্তরের ভোটারদেরকে বিএনপির পক্ষ থেকে তাবিথ আউয়ালের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান বিএনপি জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব।

তবে জোটের সিদ্ধান্ত ছাড়া জামায়াত কেন হঠাৎ করেই প্রার্থী দিয়েছে, এর উত্তর খুঁজতে জোটের তিনজন দায়িত্বশীল নেতাকে প্রশ্ন করা হলে তারা তাদের অভিমত জানিয়েছেন এভাবে- সরকার চায় জোট থেকে দূরে থাকুক জামায়াত। তারা যদি আলাদাভাবে প্রার্থী দেয়, ভোটের মাঠে সুবিধা পাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এজন্য সরকারের পরোক্ষ সমর্থন থাকতে পারে। এক্ষেত্রে হয়তো তারা (জামায়াত) মনে করছে, সরকারের পক্ষ থেকে কিছুটা ছাড় পাবে। নির্বাচনের ডামাডোলে দল গোছাতে এটি তাদের কৌশল হতে পারে। তাছাড়া বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় আসতেও প্রার্থী মাঠে রাখতে পারে দলটি।’

এদিকে জোটের অনুমতি না নিয়ে জামায়াতের প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা ওঠে জোটের গত বৈঠকে। বৈঠকে জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী দেওয়ায় কঠোর সমালোচনা করেন অন্য শরিকরা। জোটের সঙ্গে আলোচনা না করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) প্রার্থী ঘোষণা দেওয়ায় ২০ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের তোপের মুখে পড়েন বৈঠকে অংশ নেওয়া জামায়াতে ইসলামীর কর্ম পরিষদ সদস্য আবদুল হালিম। শেষ পর্যন্ত ডিএনসিসিতে প্রার্থী চুড়ান্ত করার বিষয়টি জোট প্রধান ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর ছেড়ে দিয়ে জামায়াতের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করতে বলেছেন তারা।

বৈঠক সূত্র থেকে জানা যায়, মো. সেলিম উদ্দিনকে জামায়াতের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি এক জোট নেতা বৈঠকে তোলেন। পরে এ নিয়ে জোট নেতাদের প্রায় সবাই উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, জোটের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠকের আগে কিভাবে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করলো। যেখানে বিএনপি এখনো প্রার্থী ঘোষণা করে নি। এ নিয়ে বৈঠকে উপস্থিত জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য আবদুল হালিম জোট নেতাদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। তিনি জোট নেতাদের আশ্বস্ত করেন, তফসিল ঘোষণার আগে প্রার্থী দেওয়া চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা হলেও আলোচনা না করে কিছুই চুড়ান্ত করা হবে না। তবে এ নিয়ে বৈঠকে খালেদা জিয়া কোনো মন্তব্য করেন নি। পরে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

জোটের একটি শরিক দলের প্রার্থী দেওয়া এবং বিএনপির অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘হতে পারে তারা বিএনপির সঙ্গে কোনো বোঝাপোড়ায় আসতে চাইছে। তবে বিএনপি জোটের পক্ষ থেকে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই আমরা চাইবো না কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী বা জোটের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকুক। সেক্ষেত্রে করনীয় নির্ধারণে কাজ চলছে। আশা করি, বিএনপি জোটের একক প্রার্থীই মাঠে থাকবে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জানুয়ারি ২০১৮/রেজা/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়