ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আবছা আলোয় শারমিনের আলোকিত ফল

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ৭ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আবছা আলোয় শারমিনের আলোকিত ফল

রফিকুল ইসলাম মন্টু : সব বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে অদম্য শারমিন। এবার এসএসসি পরীক্ষায় ৭ বিষয়ে এ প্লাসসহ ‘জিপিএ ফাইভ’ পেয়ে সে উত্তীর্ণ হয়েছে। তার গড় মার্কস ৮৭ দশমিক এক। হাজারো প্রতিবন্ধকতার জাল ছিঁড়ে অর্জিত এই ফলে শারমিন খুব খুশি।

উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দ্বীপ চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চরমোন্তাজ এ. সাত্তার মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে চলতি ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় শারমিন আক্তার এ ফল অর্জন করেছে। লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে তার ছিল হাজারো সমস্যা। দরিদ্র বাবার পরিবারে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া ছিল কষ্টসাধ্য। স্কুলে-বাড়িতে কোথাও ছিল না লেখাপড়ার অনুকূল পরিবেশ। সব প্রাচীর ভেঙে এগিয়েছে শারমিন। সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেছে মাধ্যমিকের চৌকাঠ।

ডাক্তার হাওয়ার স্বপ্ন শারমিনের। এই পেশায় সেবা দিয়ে মানুষের পাশে থাকতে চায়। আর তাই লেখাপড়ায় তার প্রবল মনযোগ ছোটবেলা থেকেই। স্কুলে ভর্তির পর থেকেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে সে। প্রাথমিক আর জুনিয়র পর্যায়েও তার রয়েছে সাফল্য। শারমিন পঞ্চম শ্রেণী সমাপনীতে ‘এ’ এবং অস্টম শ্রেণীর সমাপনীতে ‘এ প্লাস’ পেয়েছিল। প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত রোল নাম্বার ‘এক’ কখনও তার হাতছাড়া হয়নি। অব্যাহত সাফল্যের কারণে মেধাবী সহপাঠীরা সবসময়ই তাকে দেখেছে বাঁকা চোখে। দারিদ্র্য আর অর্থকষ্ট শারমিনকে দমাতে পারেনি। ঘরে ছিল না পড়ার পরিবেশ। আবছা আলোতে পড়ে এই বয়সে চোখটাও নষ্ট হয়েছে। কখনো না খেয়েই স্কুলে গিয়েছে। ভাগ্যে জোটেনি পুষ্টিকর কিংবা বাড়তি খাবার। কখনো স্কুলে যেতে হয়েছে না খেয়ে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের গণ্ডিতে কখনোই প্রাইভেট পড়ার সুযোগ মেলেনি। তবুও পরীক্ষায় ক্রমাগত ভালো করেছে শারমিন।

ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়া এসএসসিতে শারমিনের প্রাপ্ত মোট নম্বর ৮৭১। ঐচ্ছিক বিষয় থেকে যোগ হয়ে এই নাম্বার দাঁড়িয়েছে ৯১৭। ফল পেয়ে অনুভূতি জানাতে গিয়ে শারমিন বলে, ‘অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। অনেক সময় না খেয়ে স্কুলে গিয়েছি। আলোর অভাবে ঘরে পড়তে পারিনি। স্কুলে যেতে প্রতিদিন প্রায় ২ ঘণ্টা হেঁটেছি। চেষ্টা ছিল ভালো ফলাফলের। আমি খুবই খুশি। এত সমস্যার মাঝেও এই রেজাল্ট আমাকে উৎসাহিত করেছে। আগামীতেও এই ধারা অব্যাহত রেখে আমি সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে চাই।’

দরিদ্র পরিবারে থেকেও যে মেধার স্বাক্ষর রাখা যায়; অনেকের থেকে এগিয়ে থাকা যায়; তারই প্রমাণ শারমিন। দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের নয়ারচর গ্রামে বাড়ি। বাবা মো. ফারুক মাঝি অতিকষ্টে ৯ জনের সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। মা রাবেয়া বেগম হাজারো বাঁধা পেরিয়ে কাজ করছেন নেপথ্যে। ৭ ভাইবোনের মধ্যে শারমিন ৩য়। ছোটবেলা থেকে ওর ভালো ফল দেখে ছোট ভাইবোনেরাও অনুপ্রাণিত হয়েছে। আছমা বেগম অষ্টম, নাজমা বেগম ষষ্ঠ এবং ছোটভাই জুনায়েদ ক্লাস ওয়ানে পড়ছে। তবে বাবার আর্থিক দৈন্যতায় বড় ভাই মিজানুর রহমান আর বোন শাহনাজ বেগমের লেখাপড়া এগোয়নি। মিজান বাবার কাজের সহায়ক আর শাহনাজের বিয়ে হয়ে গেছে।
 


নয়ারচর গ্রামে কাঁচা রাস্তা আর ধানক্ষেতের ভেজা মাটি পেরিয়ে শারমিনদের ছোট্ট ঘর। পাশের জেলা ভোলা থেকে এক সময় চরমোন্তাজের এই গ্রামে তার বাবা একখণ্ড জমি কিনে ঘর বাঁধে। এখনও বাড়ি থেকে পাশের সড়কের সংযোগ মেলেনি। তাই দুর্গম পথ পেরিয়েই মূল রাস্তায় যেতে হয়। বর্ষায় অতিক্রম করতে হয় কাদাপানি। এই পথ পেরিয়ে শারমিন প্রতিদিন স্কুলে যায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘরে থাকে অন্যান্য ভাইবোনেরা। বাবা ফারুক মাঝি বিভিন্নভাবে রোজগারে সংসারের চাকা সচল রেখেছেন। বদলি মজুরির কাজ করেছেন বহুদিন। অবশেষে কয়েকজন মিলে একটি ট্রলার কিনেছেন। চরমোন্তাজের বাইলাবুনিয়া থেকে যাত্রীবাহী এ ট্রলারটি প্রতিদিন ভোলার কচ্ছপিয়া যায়। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে আবার ফিরে আসে। খরচ বাদে যে অবশিষ্ট অর্থ থাকে, এটা দিয়েই চলে ফারুক মাঝির সংসার।

বাবা ফারুক মাঝি বলেন, ‘মেয়ের লেখাপড়ায় তো অনেক কিছুই প্রয়োজন। কিন্তু তা দিতে পারি না। বইপত্র কিনে দিতে হয়। ভালো জামাকাপড় দিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার সময় হাতে কিছু টাকা দিতে হয়। তা তো ঠিকঠাক দিতে পারি না। ওর খোঁজ নিতে পারি না। আয় রোজগার যা হয়, সংসার চালাতেই কষ্ট হয়। তবুও সাধ্যমত চেষ্টা করি।’

মা রাবেয়া বেগম বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। যা চাই তা পারি না। অনেক সময় মেয়ে না খেয়ে স্কুলে চলে যায়। প্রতিদিন পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়; বর্ষায় স্কুলে যেতে খুবই কষ্ট হয়। ভালো জামাকাপড় দেওয়া প্রয়োজন হলেও তা দিতে পারি না। একটু ভালো খাবারও দিতে পারি না। ওর লেখাপড়ায় খুবই আগ্রহ। যেন লেখাপড়া করে অনেক উপরে উঠতে পারে; সেটাই চাই।’

শারমিনদের ঘরে গিয়ে দেখি, সামনের বারান্দায় ছোট্ট একটা টেবিলে সাজানো বইপত্র। এখানেই অধিক রাত পর্যন্ত পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকে শারমিন। স্কুলের পড়া তৈরির পর নিজের আরও একটু বাড়তি পড়ালেখা শেষ করে তারপর ঘুম। কিন্তু ঘরে পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় আলো নেই। সৌরবাতির আবছা আলোতে পড়তে হয় তাকে। এ কারণে এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে তার চোখে দেখা দেয় সমস্যা। তবুও থামেনি শারমিন। শারমিন জানায়, তাকে বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেয়ার মতো কেউ নেই। প্রাইভেট পড়ার টাকা নেই। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাইভেট টিউটর ছিল না। নবম শ্রেণীতে ভর্তির পর সে প্রাইভেট পড়েছে। তবে স্যারেরা তার কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি। বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে প্রতিদিন তাকে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে। শারমিন শুধু যে লেখাপড়ায় ভালো তা নয়, সৃজনশীল বিভিন্ন প্রতিযোগিতা কিংবা লেখাধুলায় শারমিন ছাড়িয়ে গেছে সকলকে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পেয়েছে অসংখ্য পুরস্কার। শারমিন আরো এগিয়ে যেতে চায়। উঠতে চায় সাফল্যের চূড়ায়। সেজন্য প্রয়োজন সবার সহযোগিতা।  

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়