ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অটিজম সম্পর্কে যা জানা উচিত

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৬, ২ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অটিজম সম্পর্কে যা জানা উচিত

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : অটিজম হলো মস্তিষ্কের ত্রুটিপূর্ণ বিকাশ জনিত একটি জটিল দশা। এ দশার সঙ্গে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া, ভাষা শেখা ও যোগাযোগ স্থাপনে অসামর্থ্যতা এবং জেদি ও পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণের সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের উপসর্গের কারণে বর্তমানে এ দশাকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) বলা হয়। এ দশায় আক্রান্ত শিশুদের স্বাভাবিকভাবে যে দক্ষতা অর্জন করার কথা তা অর্জিত হয় না। অটিজমে আক্রান্ত সকল শিশুর মধ্যে যে তীব্র অসামর্থ্যতা থাকবে তা নয়, কোনো কোনো অটিজম শিশুর স্বাভাবিক জীবনের কিছু উপাদানের ঘাটতি থাকে মাত্র। অসামর্থ্যতার মাত্রা হালকা হোক কিংবা তীব্র হোক, এ ধরনের শিশুদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রয়োজন হবে।

অটিস্টিক শিশুদের যোগাযোগ করতে সমস্যা হয়। তারা অন্য লোকদের কথা ও অনুভূতি বুঝতে পারে না। একারণে শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি ও স্পর্শের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয় না।

অটিজমে আক্রান্ত খুব স্পর্শকাতর শিশুরা বড় সমস্যায় থাকতে পারে। এমনকি তারা কখনো কখনো অন্যদের কাছে স্বাভাবিক এমন শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ ও বা দৃশ্যের দ্বারা ব্যথাও অনুভব করে থাকে।

অটিস্টিক শিশুরা পুনরাবৃত্তিমূলক, স্টেরিওটাইপড বা ধরাবাধা শারীরিক মুভমেন্টের প্রকাশ ঘটাতে পারে, যেমন- কোনো কিছুর চারপাশে ঘোরা, একদিক থেকে অন্যদিকে আসা-যাওয়া এবং হাত তালি দেওয়া। তারা লোকদের প্রতি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, কোনো বস্তুর প্রতি অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখাতে পারে, আচরণের ধরন বা রুটিনের পরিবর্তনে অনীহা প্রকাশ করতে পারে অথবা আগ্রাসী বা নিজের ক্ষতি হয় এমন আচরণ করতে পারে। তারা মাঝেমাঝে চারপাশের লোক, বস্তু বা প্রাণী ও কার্যক্রম লক্ষ্য নাও করতে পারে। অটিজমে আক্রান্ত কিছু শিশুর খিঁচুনিও হতে পারে, কিছু ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকালে না পৌঁছা পর্যন্ত এসব খিঁচুনির প্রকাশ ঘটে না।

কিছু অটিস্টিক শিশুদের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সাধারণ জ্ঞানের (যা দিন অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে অর্জিত হয়) ঘাটতি থাকে। সাধারণ জ্ঞানীয় ঘাটতির (যা তাদের বিকাশের দ্বারা চিহ্নিত) বিপরীতে অটিস্টিক শিশুরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা থাকতে পারে, বিশেষ করে যোগাযোগ ও অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অসামর্থ্যতা। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা অস্বাভাবিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে, যেমন- চিত্রাঙ্কন, সংগীত, গাণিতিক সমস্যার সমাধান অথবা মুখস্তবিদ্যা। একারণে অবাচনিক বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় তারা উচ্চ নম্বর পেয়ে থাকে।

অটিজমের উপসর্গ সাধারণত জীবনের প্রথম তিন বছরে প্রকাশ পেয়ে থাকে। কিছু অটিস্টিক শিশুর লক্ষণ জন্ম থেকেই দেখা দেয়। অন্যদের লক্ষণগুলো সাধারণত ১৮ থেকে ৩৬ মাসের দেখা দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, কিছু অটিস্টিক শিশুর কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার বা যোগাযোগে অসামর্থ্যতার উপসর্গ ততক্ষণ প্রকাশ পায় না যতক্ষণ পর্যন্ত না সমাজের চাহিদা তার সক্ষমতাকে অতিক্রম করে। মেয়ের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে অটিজম চারগুণ বেশি কমন। যেকোনো জাতি, উপজাতি অথবা সমাজের শিশুদের অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হতে পারে। পরিবারের আয়, জীবনধারা ও শিক্ষার মাত্রা অটিস্টিক হওয়ার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে না।

বলা হচ্ছে যে বর্তমানে অটিজমের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু এখনো এটা স্পষ্ট নয় যে কিসের পরিবর্তেনে এ ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে চলেছে। অথবা পূর্বের তুলনায় আদৌ অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বাড়ছে কিনা সেটাও পরিষ্কার নয়, কারণ তখন অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার শনাক্তকরণের জন্য তেমন সুবিধা বা জনসচেতনতা ছিল না।

অটিজমকে বর্তমানে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের (এএসডি) অধীনে বিবেচনা করা হয়। পূর্বের যেসব ব্যাধিকে এএসডি’র শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে তা হলো:

* অটিস্টিক ডিসঅর্ডার: এটি সেটাই যা অধিকাংশ লোক ‘অটিজম’ শব্দটি শুনলেই বুঝতে পারে। এটি সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া, কথাবার্তা বা যোগাযোগ ও তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের কল্পনাপ্রবণ খেলাধুলার অসামর্থ্যতাকে বুঝিয়ে থাকে।

* এসপারজার্স সিন্ড্রোম : এ ধরনের শিশুদের কথাবার্তা বলতে সমস্যা হয় না। প্রকৃতপক্ষে, তারা বাচনিক বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় গড় বা গড়ের ওপর স্কোর পেয়ে থাকে। কিন্তু তাদের অটিস্টিক শিশুদের মতো একই সামাজিক সমস্যা অথবা আগ্রহের ক্ষেত্র সীমিত থাকে।

* পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার (পিডিডি) : এটিকে অ্যাটিপিক্যাল অটিজমও বলে। এ ব্যাধির শিশুদের কিছু অটিস্টিক আচরণ থাকে এবং তাদেরকে অন্য কোনো ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।

* চাইল্ডহুড ডিসইন্টিগ্রেটিভ ডিসঅর্ডার : অন্তত দু বছর ধরে এ ধরনের শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ হয় এবং তারপর তারা কিছু বা অধিকাংশ যোগাযোগ বা সামাজিক দক্ষতা হারায়। এটি একটি বিরল ব্যাধি এবং পৃথক দশা হিসেবে এর অস্তিত্ব নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

* রেট সিন্ড্রোম : পূর্বে এ ব্যাধিকে এএসডি’র শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে রেট’র কারণ বংশগত। এটি এখন আর এএসডি গাইডলাইন্সের অন্তর্ভুক্ত নয়। রেট সিন্ড্রোমের শিশুদের (প্রধানত মেয়ে) বিকাশ স্বাভাবিকভাবে শুরু হলেও একটা সময়ে এসে তারা যোগাযোগ ও সামাজিক দক্ষতা হারাতে থাকে। ১ থেকে ৪ বছরের মধ্যে পুনরাবৃত্তিমূলক হাতের নড়াচড়ার পরিবর্তে উদ্দেশ্যমূলক হাতের নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায়। রেট সিন্ড্রোমের শিশুদের জ্ঞানীয় কার্যক্রম খুব বেশি ব্যাহত হয়।

* অটিজমের কারণ কি?
যেহেতু অটিজম পরিবারের মধ্যে বহমান, তাই গবেষকরা ধারণা করেন যে কিছু জিনের সমন্বয় কোনো শিশুকে অটিজমে আক্রান্ত করতে পারে। কিন্তু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় রয়েছে যা অটিস্টিক হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।

* যেসব পুরুষ বা নারী দেরিতে বাচ্চা নেন, তাদের শিশু অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

* গর্ভবতী নারী কিছু ওষুধ বা রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসলে তাদের শিশু অটিস্টিক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অ্যালকোহলেরর ব্যবহার, ডায়াবেটিস ও স্থূলতার মতো ম্যাটারনাল মেটাবলিক কন্ডিশন এবং গর্ভাবস্থায় খিঁচুনিবিরোধী ওষুধের ব্যবহার শিশুকে অটিস্টিক হওয়ার ঝুঁকিতে রাখতে পারে।

* কিছু ক্ষেত্রে অটিজমের সঙ্গে অচিকিৎসিত ফেনিকেটোনুরিয়া (একটি এনজাইমের অনুপস্থিতি জনিত একটি ইনবর্ন মেটাবলিক ডিসঅর্ডার) এবং রুবেলা বা জার্মান হামের সংযোগ পাওয়া গেছে।

* কেউ কেউ মনে করেন যে টিকা দেওয়ার কারণে অটিজম হতে পারে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত শিশুকে টিকা দিলে অটিজম হয় এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ঠিক কি কারণে অটিজম হয় তা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি, কিন্তু গবেষণা ধারণা দিচ্ছে যে ইন্দ্রিয়ানুভূতি গ্রহণ ও ভাষা প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত মস্তিষ্কের অংশের অস্বাভাবিকতা থেকে এর উৎপত্তি হতে পারে।

শিশুর মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ (যেমন- শিশুর সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করা হচ্ছে) অটিজম সৃষ্টি করতে পারে কিনা তার কোনো প্রমাণ গবেষকদের কাছে নেই।

তথ্যসূত্র : ওয়েব এমডি

পড়ুন :
        * অটিস্টিক শিশুর যত্ন      





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ এপ্রিল ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়