ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পশুপাখি থেকে মানুষের মধ্যে যেসব রোগ ছড়ায় (প্রথম পর্ব)

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১১, ২ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পশুপাখি থেকে মানুষের মধ্যে যেসব রোগ ছড়ায় (প্রথম পর্ব)

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : পশুপাখি থেকে যেসব রোগ ছড়ায় তাদেরকে জুনোটিক রোগ বলে। এ ধরনের রোগ বিস্ময়করভাবে কমন। আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের মতে, মানুষের মধ্যে ছড়ানো প্রতি ১০টি পরিচিত সংক্রামক রোগের মধ্যে প্রায় ৬টি রোগ ছড়ায় পশুপাখি থেকে। সাধারণত সংক্রমিত পশু বা পশুর মল থেকে জুনোটিক রোগ ছড়ায়, কিন্তু কখনো কখনো দূষিত খাবার খাওয়ার কারণেও এসব রোগ হতে পারে। সবচেয়ে কুখ্যত জুনোটিক রোগ হলো র‍্যাবিস বা জলাতঙ্ক। পশুপাখি থেকে মানুষের মাঝে ছড়াতে পারে এমন ১১ রোগ নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

* বিড়ালের কামড় বা আঁচড়ে ক্যাট স্ক্র্যাচ ফিভার হতে পারে

বার্টোনেলা ইনফেকশনকে ক্যাট স্ক্র্যাচ ফিভারও বলে। বার্টোনেলা হেলসিলে নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই ইনফেকশন হয়। এটি সাধারণত বিড়ালের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এই ইনফেকশনের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে ক্ষতস্থানে শুষ্ক রক্তের শক্ত আবরণ বা পুঁজ, কিন্তু আরো মারাত্মক উপসর্গও বিকশিত হতে পারে। এনওয়াইইউ হেলথের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ থেরেসা এম. ফিয়োরিটো বলেন, ‘এই ইনফেকশনটি সাধারণত সেলফ-লিমিটেড বা নিজে নিজে সেরে ওঠে, কিন্তু আপনার লসিকাগ্রন্থি ফুলে যেতে পারে অথবা স্পষ্ট কারণ ছাড়া জ্বর আসতে পারে। দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের লোকদের, বিশেষ করে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মারাত্মক জটিলতা হতে পারে, যেমন- এটি রক্তপ্রবাহ বা পরিপাকতন্ত্র বা হৃদপিণ্ডে ছড়াতে পারে।’ বিড়ালছানার মধ্যে বার্টোনেলা সবচেয়ে কমন। অধিকাংশ বিড়ালের আঁচড় ইনফেকশনে রূপ নেয় না এবং এর চিকিৎসা হলো অ্যান্টিবায়োটিকের একটি সাধারণ কোর্স। বিরলক্ষেত্রে চোখের ইনফেকশন, তীব্র মাংসপেশি ব্যথা অথবা মস্তিষ্কে ফোলা হতে পারে।

* গরু, ছাগল, ভেড়া ও হরিণ থেকে অ্যানথ্রাক্স ছড়াতে পারে

বায়োটেরোরিজমের সঙ্গে অ্যানথ্রাক্সের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি হলেও প্রকৃতপক্ষে এ বিরল রোগটি ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়ে থাকে এবং এটি গৃহপালিত পশু ও বন্যপ্রাণী উভয় দ্বারা ছড়াতে পারে। লোকজন অ্যানথ্রাক্স স্পোরে শ্বাসগ্রহণ করলে অথবা দূষিত খাবার খেলে অথবা আক্রান্ত পশুর ছেঁড়া ত্বকের সংস্পর্শে আসলে অ্যানথ্রাক্সে সংক্রমিত হয়। কে কিভাবে এ রোগে সংক্রমিত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে উপসর্গ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো কালো বৃত্তসহ ফোস্কা বা ক্ষত, জ্বর, মাথাব্যথা, বমিবমি ভাব, শরীরে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কনফিউশন ও গেলার সময় ব্যথা। চিকিৎসার মধ্যে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিটক্সিন বা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। অ্যানথ্রাক্স হলো একটি মারাত্মক দশা যা প্রাণনাশক হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গরু, ভেড়া, ছাগল ও হরিণ হলো প্রাণী-সংক্রামক অ্যানথ্রাক্সের সর্বাধিক কমন উৎস। যারা প্রাণী বা প্রাণীজ প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করেন তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, যদিও এটি এখনো বিরল।

* ছাগল ও ভেড়া থেকে ওরফ ভাইরাস ছড়াতে পারে

ওরফ ভাইরাস সাধারণত ছোট রোমন্থনকারী পশুকে আক্রমণ করে, যেমন- ভেড়া ও ছাগল। সংক্রমিত পশু অথবা দূষিত আইটেম থেকে এই ভাইরাস মানুষের মাঝেও ছড়াতে পারে। ডার্মাটোলজিস্ট ডা. সুসান বার্ড বলেন, ‘ওরফ সাধারণত পুঁজ নিয়ে আবির্ভূত হয় যা শেষপর্যন্ত ক্ষতে পরিণত হয়, বিশেষ করে হাতে। ছাগ যোগব্যায়াম (গোট ইয়োগা) জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে মানুষের মাঝে এ ভাইরাস ছড়ানোর হার বেড়ে গেছে, কিন্তু কোনো খামার পরিদর্শন করলেও আপনি এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। সংক্রমিত গবাদি পশু, পশুর কামড় অথবা সামগ্রীর মাধ্যমে এ ভাইরাস মানব দেহে ছড়াতে পারে। এ ভাইরাসে সৃষ্ট ক্ষত যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু এটি ছয় সপ্তাহের মধ্যে নিজে নিজে নিরাময় হয়ে যায়- যদি আক্রান্ত স্থানকে পরিষ্কার, শুষ্ক ও ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন থেকে মুক্ত রাখা হয়। ওরফ ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে না। সাধারণত ওরফ ভাইরাস বিপজ্জনক নয়, কিন্তু কখনো কখনো কিছু মারাত্মক জুনোটিক রোগ ওরফের মতো দেখাতে পারে, যেমন- অ্যানথ্রাক্স। যদি মনে করেন যে আপনার ইনফেকশনটি কোনো ভেড়া বা ছাগল থেকে হয়েছে, তাহলে ডাক্তার দ্বারা মূল্যায়ন করুন।

* পোষা প্রাণী থেকে জিয়ার্ডিয়া ছড়াতে পারে

জিয়ার্ডিয়া হলো একটি আন্ত্রিক পরজীবী যা মানুষ বা পশুর সংক্রমিত মলে থাকে। সংক্রমিত বর্জ্যের সংস্পর্শে আসা যেকোনো কিছু থেকে এ পরজীবী ছড়াতে পারে, যেমন- পানি, বরফ, মাটি ও গৃহস্থালি সামগ্রী। পশুচিকিৎসক জিম ডি. কার্লসন বলেন, ‘কোনো পোষা প্রাণী সংক্রমিত হলে আপনার ঘরের বিভিন্ন জিনিসে জিয়ার্ডিয়া লেগে যেতে পারে। যদি আপনার পোষা প্রাণীর ডায়রিয়া, পেটে গুড়গুড় শব্দ অথবা বমি হয়, তাহলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।’ জিয়ার্ডিয়াতে আক্রান্ত মানুষের ডায়রিয়া, গ্যাস, তৈলাক্ত ও ভাসন্ত মল, বমিবমি ভাব ও পেট ব্যথা হতে পারে। জিয়ার্ডিয়ায় সংক্রমিত শিশু ও গর্ভবতী নারীর তীব্র পানিশূন্যতা হতে পারে। ইনফেকশনের তিন সপ্তাহের মধ্যে উপসর্গ প্রকাশ পায় এবং সাধারণত দুই থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই ইনফেকশন প্রেসক্রিপশন ওষুধ দিয়ে নিরাময় করা যায়। ডা. কার্লসনের পরামর্শ হলো সংক্রমিত পোষা প্রাণীর সংস্পর্শে আসার পর মেঝে, আসবাবপত্র, খেলনা ও বিছানাপত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। চিকিৎসার পরও পোষা প্রাণীকে পুনরায় টেস্ট করা গুরুত্বপূর্ণ, যেন নিশ্চিত হওয়া যায় যে ইনফেকশনটি পুরোপুরি নিরাময় হয়েছে।

* বিড়াল থেকে টক্সোপ্লাসমোসিস ছড়াতে পারে

কখনো কখনো টক্সোপ্লাসমোসিসকে বার্টোনেলা ভেবে বিভ্রান্ত হতে হয়, কিন্তু উভয়টাই বিড়াল দ্বারা ছড়ায়, যা ভিন্ন অণুজীব দ্বারা সৃষ্টি হয়। টক্সোপ্লাসমা গোন্ডি নামক পরজীবী দ্বারা টক্সোপ্লাসমোসিস বিকশিত হয়। সংক্রমিত বিড়ালের মল বা মূত্রের মাধ্যমে মানুষের মাঝে এই ইনফেকশন ছড়াতে পারে। এই পরজীবী সুরক্ষিত ত্বকের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না, তাই সাধারণত মুখ বা উন্মুক্ত ক্ষতের মাধ্যমে এ ইনফেকশন ছড়ায়। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ নিধি জিলদয়াল বলেন, ‘সাধারণত এ রোগটি তেমন তীব্র নয়, কিন্তু এটি কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মারাত্মক হতে পারে। গর্ভবতী নারী, কেমোথেরাপির রোগী অথবা দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের লোকেরা এ রোগে তীব্রভাবে ভুগতে পারে। উপসর্গের মধ্যে ক্লান্তি, মাংসপেশি ব্যথা, মাথাব্যথা ও জ্বর অন্তর্ভুক্ত যা একমাসেরও বেশি সময় থাকতে পারে।’ স্বাস্থ্যবান লোকদের ক্ষেত্রে এ ইনফেকশন চিকিৎসা ছাড়াই কয়েক মাসের মধ্যে সেরে ওঠে। কিন্তু তীব্র টক্সোপ্লাসমোসিস মস্তিষ্ক, চোখ ও অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। এ ইনফেকশন কিছু বছর পর পুনরায় সক্রিয় হতে পারে। টক্সোপ্লাসমোসিস থেকে রক্ষা পেতে ডা. কার্লসন লিটার বক্স পরিষ্কার করতে এবং বিড়ালের মল পরিষ্কারের সময় সবসময় গ্লাভস ও ক্লিনিং অ্যাজেন্ট ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। মাটিও সংক্রমিত হতে পারে, তাই আপনার বাগানে বিড়ালের আনাগোনা থাকলে বাগানে কাজ করার সময় গ্লাভস পরুন।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জুলাই ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়